কলকাতার রাস্তায় ধুন্ধুমার ডুয়েল! হেস্টিংস-ফ্রান্সিসের টক্কর হার মানাবে সিনেমাকে

আজ থেকে প্রায় আড়াশো বছর আগেকার কথা। ইংরেজ হুকুমতের মানদণ্ড তখন সবে সবে পরিণত হয়েছে রাজদণ্ডে। বাংলার গভর্নর জেনারেল পদে  বেশ জাঁকিয়ে বসলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। সে সময়কার ইতিহাস বিষয়ে অবগতজন বিলক্ষণ জানেন, বজ্রকঠিন প্রশাসক হওয়ার পাশাপাশি হেস্টিংস সাহেবের  গুণের অন্ত ছিল না। যেমন ধরা যাক ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ। ইংরেজ শাসনে সংস্কৃতের মূল্যায়ন যতটুকু হয়েছে,  হেস্টিংসরই সৌজন্যে। বিলিতি পড়ুয়াদের তিনি সংস্কৃত পাঠে ভরপুর উৎসাহ দেন, এবং তাঁর সূত্র ধরেই ১৭৮৯ সালে উইলিয়াম জোন্স 'শকুন্তলা' অনুবাদ করেন ইংরেজিতে। ঠিক তার দু বছর পর, অর্থাৎ, ১৭৯১ সালে জর্জ ফস্টারের হাত ধরে কালিদাসের কাব্যখানা পৌঁছে যায় সুদূর জার্মানিতে, এবং গ্যেঠে তার সুধারস পান করে ভূয়সী প্রশংসা করেন। সংস্কৃতের মাধুর্যে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন সাহেবরা যে ১৭৮৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে উইলিয়াম জোনস কবুল করেন, এ ভাষাকে তিনি গ্রিক এবং লাতিনেরও ঊর্দ্ধে রাখতে চান। তা যাই হোক, যে বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের দৌলতে ভারতের এই ধ্রুপদী ভাষা পরম আদরে পৌঁছে গিয়েছিল ইংরেজদের দরবারে, তিনি কিন্তু চৌরাস্তার মোড়ে বন্দুকও ধরেছেন বীরবিক্রমে। সিনেমাও হার মানবে কলকাতার বুকে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কাছে।

বাংলায় তখন হেস্টিংসের প্রখর প্রতাপ। তিনি খান-দান, বাঁশি বাজান। মধ্যে মধ্যে সস্ত্রীক ইংরেজ খিদমতগারদের নিমন্ত্রণসভা আলো করে বসে থাকেন। কিন্তু, রাতের সব তারা যেমন থাকে দিনের আলোর গভীরে, তেমনই তাঁকে টেক্কা দিতে এক 'দুর্ধর্ষ দুশমন'  নিঃশব্দে বেড়ে উঠছিলেন গোকুলে। নাম তাঁর ফিলিপ ফ্রান্সিস। অনেকেই জানেন, ইংরেজ সরকারের এই দুই অনুগত একে অন্যকে দু চক্ষে দেখতে পারতেন না। থেকে থেকেই কাজিয়া-কোন্দল লাগত। এর প্রধান কারণ ছিল, হেস্টিংসের কাজে ফিলিপ ফ্রান্সিসের নিয়ত হস্তক্ষেপ। যে চার সদস্যের কাউন্সিল থেকে থেকেই হেস্টিংসকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করত, তার অন্যতম নেতা ছিলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। এর ফলে ফ্রান্সিস সাহেবের প্রতি অনেকদিন ধরেই হেস্টিংস মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিলেন। অবশেষে গরমাগরম বাক্যবিনিময়ের পর ১৭৮০ সালের ১৫ অগাস্ট তিনি মোক্ষম চালখানা চেলে দিলেন।

এদিন বিলেতের উপরমহলে ফ্রান্সিসের বিরুদ্ধে একটি নোট পাঠান হেস্টিংস। অকথ্য কুৎসায় ভরা ছিল সেই অভিযোগপত্র। দিন কয়েক আগেই ম্যাডাম গ্রান্ডের সঙ্গে পরকীয়া করতে গিয়ে ধরা পড়ে তাঁর স্বামীর কাছে ফ্রান্সিসকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যে হেস্টিংস আগাগোড়া 'আপন মনের মাধুরী মিশায়ে' কুৎসাকাব্য রচনা করেছিলেন, তা মনে করার কোনও কারণ নেই।

আরও পড়ুন-এক বাঙালের কন্যার দু’চাকার দুনিয়াদারি মুক্তির পথ দেখাচ্ছে লক্ষ মেয়েকে

হেস্টিংসের চিঠির খবর চাপা থাকল না। অচিরেই তা ফ্রান্সিসের কানে গিয়ে পৌঁছল এবং ব্যাঘ্রগর্জনে তিনি হেস্টিংসকে জানালেন, 'অলরাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইট!' ঠিক হল দু'জনের মধ্যে ডুয়েল হবে। কলকাতার রাস্তায় সে সময় ডুয়েল খুব অস্বাভাবিক কোনও বিষয় নয়। বউ পরপুরুষের সঙ্গে ভেগেছে? লাগাও বন্দুকের খেল। হিকিসাহেবের কাগজ ঘাঁটলে এমন ঘটনার বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু, হেস্টিংস ফ্রান্সিসের এই ডুয়েল উপাখ্যান ইংরেজ মহলের আনাচেকানাচে বর্ণিল তামাশার বিষয় হয়ে উঠেছিল।

বর্তমানে যেখানে আলিপুর ব্রিজ, তার পাশেই দু'জনের রণক্ষেত্র বাছা হল। ঠিক হল, এখানেই পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় রানী ভিক্টরিয়ার দুই তাবড় কর্মচারীর জীবন মরণের ফয়সালা হবে। পরের দিন সময় মতো দুজনে পৌঁছলেন নির্ধারিত জায়গায়। ইলাইজা ইম্পের বাড়ির সামনের একটা বটগাছকে কেন্দ্র করে চোদ্দ পা তফাতে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর, 'ফায়ার'। দুটি বন্দুক থেকে গুলি ছুটল একই সময়, কিন্তু ফ্রান্সিস এক উইকেটও পেলেন না।  বরং ওয়াইড বল করে বসলেন। গুলি বেরিয়ে গেল হেস্টিংসের শরীরের অনেকটা দূর দিয়ে।  হেস্টিংস কিন্তু লক্ষভ্রষ্ট হননি। আগ্নেয় অস্ত্রবিদ্যায় আনাড়ি ফ্রান্সিসের শরীর তাঁর গুলির আঘাতে সেদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন।

আঘাত যদিও গুরুতর ছিল না। তবু, আলপিন নয়, কাঠ পিঁপড়ে নয়, জলজ্যন্ত একটা গুলি তো। ফ্রান্সিসকে সাহায্য করতে ছুটে গেলেন হেস্টিংস। অনুশোচনায় মাথা নামিয়ে বললেন ফ্রান্সিস যদি কোনও ভাবে মারা যান, তবে তিনি সোজা শেরিফের কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করবেন। ফ্রান্সিস সাহেব মুখে কিছু বলেননি ঠিকই, কিন্তু মনে মনে বলেছিলেন, 'এত আস্পর্ধা?' এরপর শুরু হল খেলার দ্বিতীয়ার্ধ। বিলেতে ফিরে হেস্টিংসের নামে মনের সুখে কুৎসা রটাতে লাগলেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। অল্পদিনের মাথাতেই অনুষ্ঠিত হয় 'ইমপিচমেন্ট অফ ওয়ারেন হেস্টিংস'। যাঁর নামে নাকি এককালে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত, তাঁর তখন 'শ্যাম রাখি না কূল রাখি' অবস্থা।

কলকাতার ডুয়েলবাজদের বাঙালি মনে রাখেনি। আজকের দিনেও আলিপুরের একপাশ দিয়ে 'ডুয়েল এভিনিউ' নামক একটা রাস্তা গেছে বটে, তবে তা দেখে কারুর বোঝার উপায় নেই যে এখানেই একসময় ঝলসে উঠেছিল দুটি সাহেবি ধাঁচের  রিভলভার। শিহরণের স্মৃতি বিজড়িত সেই রাস্তার উপর আজ মল মাল্টিপ্লেক্সের কোলাহল। গল্পকথারা তবু থেকে যায়।  ইতিহাসের দেওয়ালে দেওয়ালে 'ধূসর শূন্যের আজান গানের' মতো জমে তাদের জলছাপ। 

More Articles