দুর্গাপুজো যাদের কাছে এক অভিশাপ

আশ্বিনের শিশির ভেজা কোমল ঘাসে পা রেখে উমা যেন প্রায় চলেই এসেছেন বাপের বাড়ি। পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে ইতিমধ্যেই। রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলা শোনামাত্রই বাঙালিদের পুজোর শুরু হয়। গোটা বাংলায় এ বড় সুখের সময়। উমার মতই এই সময় ঘরে ফেরে বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা আরও কত বাঙালি সন্তান। পুজোর এই ক'টা দিন তাই সব ভুলে আনন্দের জোয়ারে গা ভাসায় আট থেকে আশি  সকলেই।

যেখানে সারা বিশ্বের বাঙালি আজ পুজোর আনন্দে মাতোয়ারা, সেখানে এই পশ্চিমবঙ্গের বুকেই এক জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্গা পুজোর আগমনে নেমে আসে শোকের ছায়া। মহালয়ার দিন থেকেই তাঁরা নিজেদের গৃহবন্দি করে ফেলেন। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া পুরুলিয়া, পশ্চিম-মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির চা বাগানের নানান জায়গায় তাঁদের বসবাস। এরা আসলে ‘অসুর’ জনজাতি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী জানা যায় এ রাজ্যে প্রায় চার হাজার ‘অসুর’ জনজাতির মানুষ বসবাস করেন। ১৯৯১ সালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, অসুরদের ৫২.৭২ শতাংশ চা-বাগানের শ্রমিক, ১৫.৬৫ শতাংশ কৃষক এবং ১৩.৬ শতাংশ খেতমজুর। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার নাগরা কাটার ক্যারন, আলিপুরদুয়ার জেলার মাঝেরডাবরি, নিমাতিঝোরা এবং শিলিগুড়ির নকশালবাড়ি চা বাগানে মোট ৬০০ টি অসুর পরিবার বাস  করেন। অসুর বংশের সদস্য সুষমা অসুরের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় খনি থেকে লোহা তোলার কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই অসুর উপজাতির সদস্যরা। মূলত তাঁরা চা বাগানের সাদরি ভাষা বোঝেন।    

মহিষাসুরের বিক্রমে যখন একদিকে দেবকুলের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল,  আবার মর্ত্যলোকে ঘনিয়ে এসেছিল বিপদের ঘন মেঘ, তখন সেই প্রবল শক্তিশালী মহিষাসুরকে নিধনের উদ্দেশ্যে সমগ্র দেবকুল এবং মানবকুল শরণাপন্ন হয়েছিল দেবী দুর্গার। অসুর নিধনের এই কাহিনিই আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি। কিন্তু এই ‘অসুর’ জনজাতি আসলে মহিষাসুরকে তাঁদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করেন। রামায়ণের রাম এবং রাবণকে নিয়ে যে আর্য–অনার্য চিন্তাধারার কথা শোনা যায়, এই ক্ষেত্রটিও সেই একই সূত্রে গাঁথা। এই মানুষদের মতে তাঁরাই এই দেশের প্রাচীন জনজাতি। তাঁদের নেতার নাম ছিল ‘হুদুর দুর্গা’ বা ‘মহিষাসুর’। দুর্গা সাঁওতালি ভাষায় পুংলিঙ্গ। ‘হুদুর’ কথার অর্থ হল প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলা বাতাস বা ঝড় এবং ‘দুর্গা’ কথার অর্থ যিনি দুর্গকে রক্ষা করেন। কেউ কেউ আবার এই হুদুর দুর্গাকে রাজা হিসাবেও কল্পনা করেছেন। তিনি ছিলেন প্রবল শক্তির অধিকারী। তাঁর রাজ্যে নারীরা ছিলেন তাঁদের যোগ্য সম্মানের অধিকারিণী। হুদুর দুর্গার শাসনকালে কোন নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং অসহায় মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা নিষিদ্ধ ছিল। আর্যরা যখন ভারতে আসেন, তখন সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি বিভিন্ন জাতি-উপজাতি তাঁদের ঘোর বিরোধীতা করেন। শোনা যায়, পরপর সাতবার চেষ্টার পরেও যখন আর্যরা এই হুদুর দুর্গকে পরাস্ত করতে বিফল হন , তখন ইন্দ্র এক ছলনার আশ্রয় নেন। তিনি বারাঙ্গনা দেবীকে হুদুর দুর্গার কাছে পাঠান, প্রথমে তিনি এই দেবীকে প্রত্যাখান করলেও অবশেষে তাঁকে বিয়ে করেন। বিয়ের নবন দিনে এই দেবীর দ্বারা নিহত হন হুদুর দুর্গা। হুদুর দুর্গাকে হত্যা করে তিনি হন দেবীদুর্গা। তথ্যচিত্র নির্মাতা সুমিত চৌধুরী এই বিষয়ে বলেছেন, “এক গৌরবর্ণা নারীই যে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন তা হিন্দু পুরাণে আছে। দেবী দুর্গার যে প্রতিমা গড়া হয়, সেখানে দুর্গা গৌরবর্ণা, টিকালো নাক, যেগুলি আর্যদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। দুর্গার আরেক নাম সেজন্যই গৌরী। অন্যদিকে মহিষাসুরের যে মূর্তি গড়া হয় দুর্গা পুজায়, সেখানে তার গায়ের রঙ কালো, কোঁকড়ানো চুল, পুরু ঠোঁট। এগুলো সবই অনার্যদের বৈশিষ্ট্য।” যদিও এ শুধুমাত্র এক কাহিনি, এর কোন পোক্ত ভিত্তি নেই।  

পুজোর এই ক'টা দিন তাই শোক পালন করেন অসুর জনজাতির মানুষেরা। কোথাও পালিত হয় অরন্ধ্রন , আবার কোথাও জানলা-দরজা বন্ধ করে ঘরেই বসে থাকেন তাঁরা। অনেকে আবার এই শোক পালনের প্রতীকী হিসাবে পরিধান করেন সাদা বস্ত্র , কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় গোটা বাড়ি। পুজোর ঢাকের শব্দ যাতে কানে না আসে, তাই ভূয়াং বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। এই সময় তাঁরা দাসাই নাচ করেন। পুরুষেরা নারী যোদ্ধার ছদ্দবেশ ধারণ করে কান্নার সুরে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রামে গ্রামে। এই গানের মধ্যে দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খোঁজ চালানো হয় হুদুর দুর্গার, এই নাচে কোন মেয়ে অংশ নেন না। দশমীর দিনে বন্দনা করা হয় মহিষাসুরের। ২০১১ সালে গোটা পশ্চিমবঙ্গে দুশোটির মত অসুরের পুজা বা স্মরণসভা আয়োজিত হয়েছিল, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাতশোরও কিছু বেশি।

তবে সময়ের সঙ্গে অনেককিছুই আর আগের মত নেই। এখনকার খুদেরা দুর্গাপুজোয় আর নিজেদের গৃহবন্দি করে রাখে না। বাকিদের সঙ্গে পা-এ পা মিলিয়ে তারাও সামিল হয় ঠাকুর দেখার ভিড়ে। কিন্তু, আজও গ্রামের বৃদ্ধ মানুষেরা ঘরেই থাকেন, দেবী দুর্গা আজও তাঁদের কাছে এক হত্যাকারিণী।

তথ্যসূত্র-

১. https://www.bbc.com/bengali/news-54690291

২. https://aajkaal.in/news/title/asur-durga-mt1s

৩. https://eisamay.com/west-bengal-news/others/asur-tribals-mourn-martyr-mahishasur/articleshow/71451088.cms

৪. https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/ei+muhurte-epaper-eimuhur/durga+pujo+nay+asurer+aaradhanay+maten+janggalamahaler+basindara-newsid-n316588690?listname=topicsList&index=0&topicIndex=0&mode=pwa

More Articles