আফ্রিকায় বোধন দেবী দুর্গার! কীভাবে সম্ভব হলো?

Durgapuja in Masaimara: হঠাৎ সুদূর আফ্রিকায় মাসাইদের হাতে পুজো শুরুর কারণ কী?

সিংহর দেশে পাড়ি দিলেন দেবী দুর্গা। এই প্রথম মাসাইমারার জঙ্গলে বসবে দুর্গাপুজোর আসর। ভাবাই যায় না, বলুন! মা দুর্গার এই অভিনব অভিযান 'চাঁদের পাহাড়'-এর শঙ্করের অভিযানের মতোই রোমাঞ্চকর। পুজোর বহুদিন আগে থেকেই কুমোরটুলিতে তাই তোড়জোড় শুরু হয়েছিল জোরকদমে। কলকাতার মানুষ যখন দুর্গাপুজোর আনন্দে গা ভাসিয়েছেন তখন মাসাইরাও বা দূরে থাকে কেন! কিন্তু হঠাৎ সুদূর আফ্রিকায় মাসাইদের হাতে পুজো শুরুর কারণ কী? এর পিছনেও রয়েছে এক বাঙালির হাত। দুর্গাপুজোর সময় কলকাতায় থাকতে না পারার দুঃখ বাঙালি খুব ভালোমতোই জানে। কোনওভাবেই মিস করতে চান না তাঁরা। তাই মা দুর্গাকেই নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে করে।

মাসাইদের কথা
পূর্ব আফ্রিকার এক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নাম মাসাই। এককালে কেনিয়া ও তানজানিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে তাঁদের বসবাস ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আধিপত্যের বৃত্ত কমলেও একেবারেই ফিকে হয়ে যায়নি। এককালে নাইলো-সাহারান অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে সমতলভূমির আশায় পা বাড়ান মাসাইরা। দীর্ঘপথ পেরিয়ে কেনিয়া, তানজানিয়া অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে এই জনগোষ্ঠী। বিশাল এই পথ পেরোনোর কারণ পশুপালনের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করা। রক্তপান মাসাইদের একটি ঐতিহ্যবাহী কাজ। দুধের সঙ্গে রক্ত মিশিয়ে পান করার পাশাপাশি টাটকা রক্ত পান করে মাসাইরা। মাসাইরা একেশ্বরবাদী।

মাসাইদের দুর্গাপুজো
উত্তর পশ্চিম কেনিয়ায় অবস্থিত মাসাইমারা অভয়ারণ্য আফ্রিকার অন্যতম বড় সংরক্ষিত বনাঞ্চল। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ঘাসজমি এবং মাঝেমধ্যে ঝোপঝাড়ে পশুরাজ বা চিতার আনাগোনা- মাসাইমারা ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে মূল আকর্ষণ। শুধু সিংহ-চিতা নয়, নানা প্রজাতির জীবের মুক্ত চারণভূমি এই মাসাইমারা। তাই প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক আসেন এই জঙ্গল ঘুরে দেখতে। মাসাইমারা জঙ্গলে ৯০টিরও বেশি স্থলজ প্রাণী রয়েছে। এই জঙ্গলে এখনও প্রায় তিনশোর বেশি চিতা রয়েছে। হরিণ, সিংহ, হাতি, জিরাফ, জেব্রা, জলহস্তী, লেপার্ড- কী নেই! এককথায় জীববৈচিত্র্যে ভরপুর মাসাইমারার জঙ্গল। সুবিস্তৃত সবুজ প্রান্তরে বন্য জন্তুদের দেখতে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় করেন মাসাইমারার জঙ্গলে।

আরও পড়ুন: বাঙালিয়ানার টইটম্বুর দুই রাজধানী, স্বাধীনতার আগে থেকেই পালিত হয় দিল্লির বাঙালিদের দুর্গাপুজো

অক্টোবরের শুরুতেই একদল বাঙালি পর্যটকদের নিয়ে মাসাইমারা যাচ্ছেন পর্যটন-ব্যবসায়ী রাখি মিত্র সরকার, 'হোম অ্যাওয়ে ট‍্যুরস অ্যান্ড ট্রেকস' সংস্থার পক্ষ থেকে। যতই কাজের কারণে কলকাতা ছাড়তে হোক, দুর্গাপুজো ছাড়া যাবে না কোনওভাবেই। তাই রাখি এবং তাঁর দল ঠিক করেছেন মাসাইমারায় ঘুরতে গিয়ে সেখানেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করবেন তাঁরা। প্ল্যানমাফিক প্রতিমাও কিনে ফেলেছেন রাখি। এই প্রতিমা তৈরি করেছেন কুমোরটুলির শিল্পী মিন্টু পাল। আটপৌরে একচালার সাবেকি প্রতিমার উচ্চতা ২৪ ইঞ্চি, প্রস্থে ২০ ইঞ্চি। রাখি এবং তাঁর দল নাইরোবিতে পৌঁছানোর পর প্রতিমাকে স্বাগত জানাবেন সেখানের বাঙালি সংগঠনের সদস্যরা। তারপরেই মাসাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন তাঁরা। শুধু বাঙালি নয়, মাসাইমারার পুজোয় যোগদান করবেন বিদেশি পর্যটকরাও। সংবাদমাধ্যমকে রাখি জানিয়েছেন, কলকাতা থেকেই পুজোর সব সামগ্রী কিনে নিয়ে যাব। ওখানে যে মাসাইদের জঙ্গলে থাকব, সেখানে আগে থেকে কথা হয়েছে। সবাই মিলেই পুজো করব ওখানে। তবে পুজোর আচার-অনুষ্ঠান যেসব নিয়ম মেনে করা সম্ভব হবে না তাও মেনে নিয়েছেন রাখি। তাঁর কথায়, "পুজোর আচার-অনুষ্ঠান কম, উৎসব বেশি- এটাই মাথায় রেখে আমরা বেরিয়েছি। তবে পুজোশেষে প্রতিমা বিসর্জনের উপযুক্ত জায়গা না পাওয়া গেলে মাসাইদের জঙ্গলেই রেখে আসা হবে দেবীকে।" এরপর আবার ডিসেম্বর মাসে একদল পর্যটক নিয়ে মাসাইমারায় যাবেন রাখি, তখনই ফিরিয়ে আনা হবে দেবীকে।

এই সংস্থার আর এক কর্ণধার রাজা দাশগুপ্ত জানান, "জঙ্গলের রাজা সিংহর দেশে স্বয়ং সিংহবাহিনী দেবীর পৌঁছে যাওয়ার মাধ্যমে এক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অভিনব উদ্যোগ আমরা নিলাম। এতে মাসাইমারার মানুষজনের পাশাপাশি আমরাও খুবই খুশি।"

শিল্পী মিন্টু পালের কথায়, "এই প্রথম মাসাইদের দেশে দেবী দুর্গা যেতে চলেছেন। এর আগে ফাইবারের দুর্গা আমেরিকা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পাঠানো হলেও মাসাইমারায় এই প্রথম। আর একচালার এই দুর্গাপ্রতিমা তৈরি মাটি দিয়ে। ওজন মাত্র পাঁচ কেজি। তাই বিমানে নিয়ে যেতেও সমস্যা হবে না।"

আচার-অনুষ্ঠান সেভাবে পালন না করা গেলেই ধুপ-ধুনো, প্রদীপ, পিতলের ঘণ্টা, শঙ্খ- সবই থাকছে এই পুজোতে। মাসাইদের সবকিছু শিখিয়ে নেবেন বাঙালি পর্যটকরা। বাহনের দেশে দেবীর আগমনে যে পশুরাজ ও জঙ্গল দুইই আনন্দে মেতে উঠবে পুজোর দিনগুলিতে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

More Articles