শুভ জন্মদিন মাননীয়া, আপনার যাত্রাপথের দিকে চেয়ে আছে নীতাদের ভাইয়েরা

অরবিন্দনগর, বিজয়গড়়, বিক্রমগড় কলোনির মধ্যে দিয়ে গেলেই আমার অবধারিত ভাবে ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা' ছবিটার কথা মনে পড়ে। খুঁজতে থাকি নীতাকে,যে ক্ষয়িষ্ণু মেয়েটি সংসারের জন্য় অনেকটা ত্যাগ করেছে। এই সময়টায় বহুবার আপনার মুখটা মাথায় চলে আসে। এক সাংবাদিক একবার আপনাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার মেজাজটা এত রুক্ষ কেন? আপনি উত্তরে বলেছিলেন, " সকালে উঠেই ভাইবোনদের জন্য কলের লাইনে দাঁড়িয়ে জল তুলতে হতো। তারপর দুধের ডিপোতে দুধ দেওয়া। এসব সেরে কলেজ।" জীবনের এই আবর্তনই মেজাজটাকে রুক্ষ করে দিয়েছে। এই একটা ছোট গল্পই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে আপনি কোথা উঠে থেকে এসেছেন, আপনি কাদের প্রতিনিধিত্ব করতে রাজনীতিতে এলেন, কেন আপনি জনপ্রিয়, কেন আপনাকে নিয়ে সরস্বতীর সাবর্ণসন্তানদের গাত্রদাহ, কত দূর যেতে পারেন আপনি।

কত দূর যেতে পারেন, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে জানি। কিন্তু যে বিন্দু থেকে আপনি শুরু করেছিলেন, যে মাইলফলকগুলি আপনি পেরিয়ে এলেন, তা মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখে চমকে উঠি। আশুতোষ কলেজের ছাত্রনেত্রী থেকে ৩৫ বছরের একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে মূল থেকে উপড়ে ফেলে রাজ্যের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, বঙ্গরাজনীতির ইতিহাসের এ এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়। কোনও উপমা, কোনও কাব্যিই আপনার এই উত্থানকে কুর্ণিশ করার জন্য যোগ্য নয়। এ পথ ভাঙতে মার খেতে হয়েছে অনেক। প্রকাশ্য মার তো রয়েছেই, চোরাগোপ্তা ছুরি চলেছে শুনেছি বহু অগ্রজ সাংবাদিকের থেকে। যেমন আপনার প্রথমবার ভোটে দাঁড়ানোটাই। যাদবপুর কেন্দ্রটায় নাকি আপনাকে ঠেলে দেওয়াই হয়েছিল আপনি দাপুটে বামনেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না বলে। কিন্তু আপনি 'নিয়তির আলেখ্য'-টাই বদলে দিলেন। কেউ কেউ বলেন, সেবার ইন্দিরার মৃত্যুই আপনার সহায়ক হয়েছিল। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি যাদবপুরের কলোনিগুলোর বাবা-মায়েরা সেদিন মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিল আপনার মধ্যে। এই ঘটনার ৩৭ বছর পর আপনার দলের নির্বাচনী স্লোগান হবে- বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়।

গোটা নব্বই দশকটা রাজপথ কাঁপিয়েছেন আপনি। ১৯৯০ সালের ১৬ আগস্ট আপনি যখন মাথায় আঘাত পেলেন তখন এই কলমচির মাতৃস্তন্য পান করার বয়স। সিপিআইএম অধ্যুষিত এলাকায় বড় হওয়ার সময়ে এই ঘটনা এবং তাকে ঘিরে সত্য-মিথ্যের বাহাস শুনতে শুনতে বারবার ভাবতাম একদিন সত্যিটা জানব। পরে জেনেছি, চিকিৎসক মনোজ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আপনার কোমা স্কোর সেদিন ১৫/৫০ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুও হতে পারত লাঠিটা সরাসরি মাথায় পড়লে। বেঁচে গিয়েছিলেন বরাতজোরে। এর পরে সেই একুশে জুলাই। আবারও মার খেলেন আপনি। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হল ১৩ জনের। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, "ওরা মহাকরণ দখল করতে এসেছিল। পুলিশ গুলি চালিয়েছে।"

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মমতার উত্থান আখ্যান। অলংকরণ- দীপ হাওলাদার।

আসলে আপনার রণংদেহী, ডাকাবুকো মেজাজটাকে একটু একটু করে ভয় পেতে শুরু করেছিলেন বাংলার মসনদে প্রতিষ্ঠিত সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মান্যবর্গ। আর বাড়ছিল বেফাঁস কথা। ভদ্রলোকের ভূমিকায় অভিনয় করা নেতারা যে ঔদ্ধত্য, আস্ফালন সেদিন দেখাতেন, যে ভাবে রুচিহীন বাক্যবন্ধ উচ্চারণ করতেন, তাতে আসলে কনফিডেন্স নড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল। মানুষ সবটা বুঝতে পারছিল। ফলটা একটু একটু করে রিফ্লেক্ট করা শুরু করে ভোটবাক্সে।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষিপ্রতাই আপনাকে অনন্য করেছে। বড় ম্যাচে বেশ কিছু ফুটবলারের কাজই থাকে বড় খেলোয়াড়কে মাঠ ছেড়ে দেওয়া, যাতে বলটাকে তিনি সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারেন। তেমনটা হচ্ছিল না বলে রাতারাতি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়লেন। বড় নেতারা অনেকেই দুয়ো দিয়েছিলেন, তাঁরা অবশ্য আপনার উত্থানকাহিনি গিলতে বাধ্যই হয়েছেন। বল জালে জড়ানোটা যে আপনার মজ্জাগত তা বুঝিয়ে দিল ২০০০ সালের কলকাতা পুরভোটের ফল।

ক্রোনোলজি লিখে কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। কিন্তু এখানে ছুঁয়ে যেতেই হবে সিঙ্গুরের কথা। আপনি একটি ছোট্ট বিক্ষোভের মধ্যে অজুত সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন। অনশনকে সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় আর কোনও ভারতীয় নেতাই এভাবে ব্যবহার করেননি। সেদিন আপনার শারীরিক ভালো থাকা না থাকা বাংলার বহু মানুষের আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। বহু শুভাকাঙ্খী উদ্বেগে দিন কাটিয়েছেন। আপনি জেদ থেকে নড়েননি। ২০০৬ সালে আপনি ঠিক ছিলেন তা প্রমাণ হল ২০১৬ সালে এসে। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়ে জানিয়ে দিল জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া অবৈধ ছিল। আপনার হাসিমুখটা সেদিন ৩০ গজ দূর থেকে দেখেছিল এই কলমচি। আর ভেবেছিল চাষার ক্ষোভ বোঝার কথা ছিল যে দলের, যে দল কৃষককে জমির পাট্টা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল তাকে আপনি নিখুঁত দানে কতটা পিছনে ফেলে দিয়ে, এগিয়ে এলেন কয়েক হাজার মাইল। সিঙ্গুর আন্দোলন ঠিক না ভুল এই নিয়ে আজও প্রশ্ন আছে অনেকের মনে। কিন্তু দেওয়ালে দেওয়ালে বুদ্ধ আসছে জমি কাড়তে- এই স্লোগানটা দেওয়ালে লেখা হয়েছিল আপনার চাণক্যবুদ্ধির দৌলতে, ব্র্যান্ড বুদ্ধকে কিস্তিমাত দিতে পেরেছিলেন আপনি, একথা মানি। যেমন মানি কৃষকসভার অস্তিত্ব না থাকাটা সেদিন কাল হয়েছিল সিপিআইএম-এর জন্য।

ক্ষিপ্রবুদ্ধি আর অবিরাম হাঁটার স্পিরিট-কিস্তিমাতের দুই মোক্ষম অস্ত্র। অলংকরণ-দীপ হাওলাদার।

এই যে উড়ালের শুরু, বৃত্তের বিন্যাস, তা সম্পূর্ণ হল নন্দীগ্রামে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণ, আপনার প্রতি আন্দোলনকারীদের আনুগত্য,শঙ্কর সামন্তদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বুঝিয়ে দিয়েছিল, আর দেরি নেই, আপনি বাংলার মহাসনে অধিষ্ঠিত হতে চলেছেন। রাস্তার রাজনীতি আপনাকে বাংলা শাসনের অধিকার দিল। দেশ অসংখ্য দামাল নেত্রী পেয়েছে। কিন্তু ইন্দিরাদের যে পেডিগ্রি ছিল, আপনার তা ছিল না। জয়ললিতার ছিল গ্ল্যামার। আপনি বাংলার অতি সাধারণ, হতভাগ্য পরিবারের সন্তান যিনি পরে চাকতির খেল ঘুরিয়ে দেবেন।

প্রথম দু'বার আপনি যে নির্বিঘ্নে জিতবেন, সারদা নারদাতেও যে বিশ্বাস টাল খাবে না তা অনেকেই বিশ্বাস করত। কিন্তু তৃতীয়বারে সেই বিশ্বাসে টলে গিয়েছিল বহু নেতাদের। বহু পোড়খাওয়া সাংবাদিকের। আর এই প্রথমবার আমি দেখলাম আপনি আসলে কতটা একা। আপনার আশেপাশে বিশ্বস্ত লোকের কী অভাব! আখের গোছানের ধান্দায় আপনার চারপাশে কত কীটানুকীটই না ঘুরে বেরিয়েছে। আবার তাঁরাই ভয়ে-লোভে রাতগভীরে নানা বিশ্বাসঘাতকতার চুক্তিপত্রে সই করেছে। অবশ্য এই একাকিত্বই আপনার শক্তি। বাংলার মানুষ এবার ভোট দিয়েছে একক মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে। তারা এখন আপনার দিকে চেয়ে আছেন। উন্নয়ন চাইছেন, সন্তানের চাকরি চাইছেন, কোভিড মোকাবিলায় সুব্যবস্থা চাইছেন স্রেফ আপনার কাছে। কোনও নেতার দাদাগিরি চাইছেন না।

প্রতিটি প্রশাসনিক সভায় আমি অবাক হয়ে দেখি আপনি লোক ধরে ধরে ধরে নাম মনে রাখেন। আপনার স্মৃতির এক্সেল শিটটাকে আমি রীতিমতো ঈর্ষা করি। চাই আপনার দলের নেতারাও আপনার থেকে এই গুণটি অর্জন করুন। নেত্রী আপনার দলটির প্রতি আমার আনুগত্য়ের দায় নেই। বরং দলীয় পতাকাকে সামনে রেখে যারা তোলা তোলে, সিন্ডিকেটবাজি করে তাদের আমি ঘৃ্ণাই করি। এই মুহূর্তে প্রশাসনিক নানা সংকট নিয়েও আমার বহু দ্বিধা রয়েছে। শূন্য় রাজকোষ পূর্ণ হবে কোন পথে আমি তাঁর উত্তর জানি না। রাজ্যের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন কোনও গোলগোল কথায় হবে না তা বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি আমার আছে। কিন্তু আজ কোনও বিরোধাভাস রাখতে চাই না। আজ খাতায় কলমে আপনার জন্মদিন। আজকের দিনে বরং যে কথা না বললেই নয় তা হল, আপনার মস্তিকপ্রসূত স্বাস্থ্যসাথী আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পগুলি যে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করেছে সে বিষয়ে আমার মতো অনেকেরই কোনও দ্বিধা নেই। এই তো আমার চেনা এক পরিচারিকা ক'দিন আগেই বাবার গলার ক্যান্সারের চিকিৎসা করালেন নিখরচায়। দেখা হতে বললেন," দাদা বাবার যাতায়াতের ভাড়াটাও লাগেনি চিকিৎসার সময়টাতে। বাবা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।" এই মানুষগুলির আশীর্বাদ, ভালোবাসা আপনি পেয়েছেন। আমি স্রেফ কুর্ণিশ করি আপনার যাত্রাপথটা। মনে হয় এ যেন এক আনন্দগান হয়ে গিয়েছে।

এবারের নির্বাচনে আপনার পা ভেঙে গিয়েছিল। তা নিয়ে বিস্তর কুরুচিকর মন্তব্য শুনেছি। কিন্তু এও শুনেছি ডাক্তার আপনাকে অত্যধিক হাঁটাহাঁটি করতে বারণ করেছেন। ইদানিং আপনি যখন মঞ্চে ওঠেন বা হাঁটেন আমার মনে হয় আপনি ইষৎ খোঁড়াচ্ছেন। হয়তো ভুল মনে হয়। কিন্তু মন ভার হয়ে যায়। আপনি মানেই তো লম্বা পথ হাঁটা। সে হাঁটা যেন বন্ধ না হয় এই কামনাই করি। শরীরের যত্ন নেবেন। আপনার যাত্রাপথে এখনও বহু মাইলফলক ছোঁয়া বাকি। সেসব দেখতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে যাদবপুর, অরবিন্দনগর- আরও কত কত কলোনির নীতাদের ভাইয়েরা।

More Articles