ইলিশের পেটে বালি, পাল্টে যাচ্ছে স্বাদ! বাঙালির প্রিয় মাছ বয়ে আনছে দুঃসংবাদ

শিল্পাঞ্চলের দূষিত জল পরিশোধন করার কোনও চেষ্টাই করা হচ্ছে না। সেই বিষাক্ত জলের অগাধ বিচরণ মারাত্মক প্রভাব ফেলছে ইলিশের গঠন এবং স্বাদের ওপর।

বাঙালির মুখে হাসি ফুটছে আবার। একেই আকাশের মুখ দিনের বেশিরভাগ সময়ই এখন ভার, বর্ষার ভরা আমেজ মাঝেমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এর মাঝে ভোজনরসিক বাঙালি পেয়েছে এক দারুণ সুখবর। গ্রীষ্মের দুপুরে দাবদাহে জর্জরিত হওয়ার পর সন্ধের কালবৈশাখীর মতো স্বস্তি দিয়ে বাজারে এখন ইলিশের ছড়াছড়ি। বর্ষাকালে একটু ইলিশের স্বাদ না পেলে বাঙালির চলবে কী করে? তাই জোগান বেড়ে যাওয়ায় এবং তার ফলে বাজারের নিয়মে ইলিশের দাম কমায় চারদিকে বেশ খুশির বাতাবরণ। সব সংবাদমাধ্যম ফলাও করে খবরও করছে সেই বিষয়ে। কিন্তু ইলিশ-সংক্রান্ত সব খবর সামনে আসছে কি?

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের স্বাদে চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার খবর হয়তো এখনও অনেকেরই অজানা। চর্চা হচ্ছে না, কীভাবে নদী দূষিত হচ্ছে এবং তার ফলস্বরূপ নদীর জলে কমছে ইলিশের খাদ্য। সামনে আসছে না ইলিশের পেটে অতিরিক্ত বালি এবং বর্জ্যপদার্থ পাওয়ার খবর।

সম্প্রতি বাংলাদেশের চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় হওয়া গবেষণায় জানা গেছে, ইলিশের পেটে এখন প্রায় ৩৬ শতাংশ বালি এবং অন্যান্য নানা অবশিষ্টাংশ পাওয়া যাচ্ছে। নদীতে দূষণের কারণে ইলিশের খাদ্য কমে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে তার খাদ্যাভ‍্যাস এবং তার জেরেই এমন বিপর্যয়। রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের ইলিশের খাদ্যের মধ্যে ৪২ শতাংশ শৈবাল, এবং তারপরেই আছে বালি এবং অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ।

আরও পড়ুন: ইলিশের নামে আসলে কি বিষ খাচ্ছেন? কীভাবে বুঝবেন…

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। বাড়ছে নদীদূষণ। বেপরোয়া বালি উত্তোলন ছাড়াও নদীর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন, সেই সঙ্গে জলে তৈলাক্ত ও বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ যত দিন যাচ্ছে, বাড়ছে। শিল্পাঞ্চলের দূষিত জল পরিশোধন করার কোনও চেষ্টাই করা হচ্ছে না। সেই বিষাক্ত জলের অগাধ বিচরণ মারাত্মক প্রভাব ফেলছে ইলিশের গঠন এবং স্বাদের ওপর।

অথচ ইলিশের উৎপাদন অনেক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০০৮-'০৯ অর্থবর্ষে ইলিশের উৎপাদন ছিল দুই লক্ষ আটানব্বই হাজার টন। ২০২০-'২১ অর্থবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টনে। কিন্তু এই পরিসংখ্যান খুশি করছে না বিশেষজ্ঞদের। বরং চিন্তার কারণ বাড়ছে, কারণ এই পরিসংখ্যান সামনে আনছে না প্রাপ্তবয়স্ক ইলিশের সংখ্যা।

দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে অপরিণত ইলিশের সংখ্যা বেশ অনেকটাই। তার থেকেও বেশি চিন্তার হলো, এই অপরিনত ইলিশের ২৭ শতাংশের পেটে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। এমনকী, মাত্র ১৭ সেন্টিমিটারের ইলিশের পেটেও দেখা যাচ্ছে ডিম। এই প্রবণতা আগামী দিনে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে আগামীদিনের ইলিশ উৎপাদনে।

এর কারণ হিসেবে নদীর দূষণ তো উঠে আসছেই। যা তাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এনেছে, এবং তাপমাত্রাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অসম্পূর্ণ পরিযান বা Migration। ইলিশের একটি মাইগ্রেশন সাইকেল আছে, তারা নদী থেকে সমুদ্রে যাবে এবং ফের তারা সমুদ্র থেকে নদীতে ফিরে আসবে। কিন্তু নদীর দূষণ, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত পলি এবং চড়া পড়ে যাওয়া সেই প্রক্রিয়াকে চূড়ান্তভাবে ব্যাহত করছে।

ইলিশের জীবনচক্র নিয়ে বলা হয়েছে, মাছটি নদীর মিঠে জলে জন্ম নেয়, নদীতে ছয় থেকে সাত মাস অবস্থান করে, তারপর বর্ষার শুরুতে নদীর জল যখন ঘোলাটে হয়ে যায়, তখন তারা সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করে। পরিণত হওয়ার পর যখন প্রজনন করার সময় আসে, তখন আবার নদীতে ফেরত আসে।

কিন্তু মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপ এই সমস্ত প্রক্রিয়াকে ব্যহত করছে, বাকি সমস্ত প্রাণীর মতো ইলিশের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করছে। বাঙালি কি নিজের স্বার্থেই একটু দূষণ কমানোর চেষ্টা করবে না?

More Articles