যাঁর কাছে মৃত্যুও হার মেনেছিল

মহাভারতে আমরা পড়েছিলাম, পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন। আজ যাঁর কথা বলব, তিনি এই বর পাননি ঠিকই,  কিন্তু মৃত্যুকে তিনি একাধিকবার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। 

ভায়োলেট কন্সট্যান্ট জোসেফ, তিনি জন্মেছিলেন আর্জেন্টিনার বাহিয়াব্লাঙ্কার নামক এক স্থানে। তিনি ছিলেন আইরিস অভিবাসী উইলিয়াম এবং ক্যাথলিন জোসেফের প্রথম সন্তান। তাঁর পিতা পেশায় ছিলেন মেষশাবক ।  জন্মলগ্ন থেকেই মৃত্যু যেন তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছেলেবেলাতেই ভায়োলেট যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। সেই সময় ডাক্তাররা বলেছিলেন আর কয়েকটি মাসই হয়তো তিনি এই পৃথিবীর আলো দেখতে পারবেন। তিনি এই অসুখ কাটিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন।  পিতার মৃত্যুর পর তাঁরা ব্রিটেনে ফিরে আসেন এবং সাতজন মানুষের সংসার চালনার জন্য তাঁর মা ‘রয়্যাল মেল লাইন’-এ সেবিকার কাজ নেন।  ভায়োলেটের পড়াশুনা চলতে থাকে একটি কনভেন্ট বিদ্যালয়ে। তবে, এই পড়াশুনা বেশিদিন তিনি চালাতে পারেননি।  তাঁর মায়ের স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকলে তিনি তাঁর পড়া ছেড়ে মায়ের দেখানো পথই অনুসরণ করেন এবং ‘রয়্যাল মেল লাইন’ই সেবিকা হিসাবে যোগদান করেন। পরে ‘হোয়াইট স্টার’  কোম্পানিতে যোগ দেন।

ভায়োলেট প্রথমে এই সংস্থায় কাজ করতে চাননি। আবহাওয়ার কারণে উত্তর অ্যাটল্যান্টিকের উপর দিয়ে তিনি যাত্রা করতে চাইতেন না। তৎসত্ত্বেও তিনি এই কাজে যোগদান করেন। দিনে ১৭ ঘন্টা কাজ করার বিনিময়ে মাসিক ২ পাউন্ড ১০ সিলিং বেতন পেতেন। টাইটানিকে যোগদানের আগে তিনি 'অলিম্পিক' নামক এক জাহাজে ১ মাস কাজ করেন। এই অলিম্পিককে বলা হত টাইটানিকের বোন। ১৯১১ সালে, মাঝ সমুদ্রে এই জাহাজের সঙ্গে এইচ এম এস হক (HNM hawk)-এর ধাক্কা লাগার সময় তিনি এই জাহাজেই কর্মরত ছিলেন। কিন্তু, এ যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এই জাহাজটির আসলে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ হয়নি। পরে নাকি আবার জাহাজটিকে মেরামত করা হয় এবং নিজের রূপে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

জোসেফ এই জাহাজের কাজ ছাড়তে চাননি। মূলত বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে তিনি টাইটানিকের সেবিকা হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু ভাগ্য, বলা ভালো দুর্ভাগ্য, এখানেও তাঁর পিছন ছাড়ল না। টাইটানিকের সলিল সমাধির কাহিনি আমাদের কারও অজানা নয়। ১৯১২ সালে টাইটানিক যখন হিমশৈলর সঙ্গে ধাক্কা খায়, তখন তিনি নিদ্রারত অবস্থায় ছিলেন। প্রথমে তিনি ঠিক বুঝতেও পারেননি কী ঘটে গিয়েছে, কিন্তু মানুষের আর্তনাদ ক্রমেই সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়।এই সময় তিনি নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে অন্তত দক্ষতার সঙ্গে বহু মহিলা এবং শিশুকে লাইফ বোটে তুলে দেন এবং শেষে নিজে ১৬ নং নৌকাতে উঠতে সক্ষম হন। এই সময় অচেনা এক শিশুকে তাঁর কোলে দিয়ে বলা হয়েছিল শিশুটির খেয়াল রাখতে, তিনি রেখেওছিলেন। সারারাত নৌকায় ভাসার পর অবশেষে পরেরদিন কার্পাথিয়া নামে একটি জাহাজে আসে তাঁদের উদ্ধারের কাজে এবং এবারেও তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর জীবন এবং জীবন-যুদ্ধ এখানেই থেমে যায়নি।

 এরপর ১৯১৪-তে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।  এই সময় আবারও একবার তিনি সেবিকা হিসাবে যোগদান করেন ‘ব্রিটিশ রেড ক্রস’ এ। ফের একবার তাঁর দর্শন ঘটে মৃত্যুর সঙ্গে। তিনি  কাজ করতে গিয়েছিলেন ‘ব্রিটানিক’ নামে একটি জাহাজে। এই জাহাজটিও ঘটনাক্রমে সমুদ্রে ডুবে যায়। তিনি আত্মকথনে বলেছেন, এইসময় প্রাণ রক্ষা করার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়োছিলেন তিনি এবং জাহাজের তলদেশে আটকে পড়েন। এতকিছুর পরেও তিনি জীবিত ছিলেন। এ কেবলমাত্র সৌভাগ্য ছাড়া আর কী! এই জাহাজডুবিতে প্রায় তিরিশজনের মৃত্যু ঘটে। চল্লিশ বছরের কাছাকাছি সময় তিনি বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হন কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর স্বামীর নাম জানা যায়নি। এরপরেও ৩৪ বছর অন্যান্য সুবিশাল জাহাজে সেবিকা  হিসাবে তিনি কাজ করেছিলেন এবং ৬৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর কর্মজীবন থেকে শেষমেশ অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর, তিনি গ্রেট আস্ফিল্ডের এক অতি সাধারণ কুঁড়ে ঘরে বাকি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, হয়তো সারাজীবন জৌলুসপূর্ণ জাহাজ এবং বারংবার মৃত্যুর হাতছানিতে ক্লান্ত হয়েই শেষে তিনি এই অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিয়েছিলেন। টাইটানিকের গল্প আমাদের সবার জানা। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই এমন কিছু মানুষের কথা আমাদের অজানা থেকে যায়, যারা নিজেদের প্রাণের পরোয়া না করেই অন্যকে সাহায্য করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভায়োলেট জোসেফ সেরকমই এক মানুষের উদাহরণ যিনি সারা জীবন অন্যের সেবায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছিলেন। তাই হয়তো জাহাজে তিন-তিনবার মৃত্যুর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েও তিনি শেষ অবধি এই কাজ ছেড়ে যেতে পারেননি।

 

তথ্যসূত্রঃ

১. https://www.encyclopedia-titanica.org/titanic-survivor/violet-constance-jessop.html

২. https://museumhack.com/violet-jessop/

৩. https://www.nationalarchives.gov.uk/titanic/stories/violet-constance-jessop.htm

৪. https://www.mentalfloss.com/article/61663/unsinkable-violet-jessop

More Articles