খুন-ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা চোখের সামনে, কী প্রভাব পড়ে মনে?

বছর ১৬-র মেয়ে পিয়ালী, মেঘ করে এলেই জামাকাপড় তুলতে যাওয়ার নাম করে বৃষ্টিতে গা ভিজিয়ে নেওয়া, রামধনু দেখতে পেলে হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে দৌড়ে বারান্দায় ছুটে যাওয়া, এমনকী, দুপুরে সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর মিষ্টিজাতীয় কিছু চুরি করে খাওয়া, জীবনের কোনও স্বাদ থেকেই নিজেকে বঞ্চিত করার মেয়ে নয় সে। গণ্ডির মধ্যে থেকেই নিষিদ্ধ যা কিছু, তার চেখে দেখার প্রবণতা আছে। বাংলা মিডিয়াম হয়ে আলাদা করে বাংলা টিউশন নেওয়ার হুজুগও আছে, এতেও কিন্তু লুকোনো স্বাদ আছে, সেই স্বাদ জুটেছে মাসছয়েক। মাঝেমধ্যেই টিউশন কেটে গঙ্গার ঘাট। মন-হরমোনের সমীকরনের অঙ্কেও বিশেষ আগ্রহ আর উত্তেজনা এখন। তবে এসবের মধ্যে পরীক্ষার চাপও আছে। বয়স শুনেই হয়তো আন্দাজ করা গেছে, সামনেই মাধ্যমিক। আর পাঁচ জন বন্ধুর মতো তারও পরীক্ষার প্রস্তুতি তুঙ্গে। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ালেও পিয়ালীর পড়াশোনায় আছে প্রবল আগ্রহ। চোখে স্বপ্ন, সাদা অ্যাপ্রন আর গলায় স্টেথোস্কোপ। বেশ মায়াময় কাটছিল দিনগুলো। লুকিয়ে প্রেম, পড়াশোনা, টিউশন পালিয়ে দেখা করা, মক টেস্টের চাপ।

 

তারপর হঠাৎ ফুরফুরে সিনেম‍্যাটিক জীবনে নেমে এল অন্ধকার। সমস্তকিছু এক নিমেষে শেষ করে দিল ৪ মে-র রাত। বসন্তের হাওয়া তখন মাঝে মাঝেই জোরে বইছে, অ্যালজেব্রার অঙ্ক শেষ করে খানিক মগজের বিশ্রাম দিতেই পিয়ালী এসে দাঁড়ায় প্রিয় ব্যালকনিতে। এই অবসরে, এই হাওয়ায় সদ্য শুরু হওয়া প্রেমই তখন সারা শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই প্রবল চিৎকারের আওয়াজ। পিয়ালীর চোখের সামনেই খুন করা হয় সুতপাকে। খুন করেন তার পাঁচ বছরের প্রেমিক সুশান্ত। সুতপার সম্পর্ক না রাখতে চাওয়া, সম্পর্কে চিড় ধরার পরিণতি ভয়ংকর মৃত্যু। অসহায় সুতপা মাটিতে লুটিয়ে সাহায্য চেয়েছিল পিয়ালীর কাছে। সেই তাকানোয় সুশান্তের দৃষ্টিও সেই সময় পিয়ালীর দিকে যায়, যা কিনা আরও ভয়ংকর এবং নৃশংস, কিন্তু হঠাৎ এই আকস্মিকতায় সে বুঝে উঠতে পারেনি কী করবে? রাস্তায় ছিল তখন বেশ কিছু মানুষ। আমরা জানি একটা খুনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, এবং তা কেন অস্বচ্ছ, তা নিয়ে মানুষের দুঃখপ্রকাশও আছে। ভিডিও তোলা গেছে সেসময়, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়ানো যায়নি। তার একটা বড় কারণ যদিও সুশান্তের হাতের নকল পিস্তল, যা আসল ভেবে ভয়ে এগোয়নি অনেকেই।

 

এবার প্রশ্ন আপনাকে। যদি সুশান্তের হাতে পিস্তল না থাকত আর আপনি থাকতেন সেই স্থানে, আপনি এগোতেন? মনে পড়ছে 'দহন'-এর কথা, ১৯৯২ সাল, রাস্তার ওপর প্রকাশ্যে ঘটে ধর্ষণের চেষ্টা, শাড়ি খুলে দেওয়া হয়, ৩/৪ জন মিলে মেয়েটির শরীরের বিভিন্ন জায়গা স্পর্শ করতে থাকে, বহু বিদ্দ্বজ্জন গাড়ির কাচ নামিয়ে দেয়, দূর থেকে সহানুভূতি দেয়, ভ্রু কুঁচকে দেখেও, না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অবশেষে একটি মেয়ে একা বাঁচাতে যায় তাকে। তাকে নিয়ে খবর হয়, সাহসিকতার পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু কেন? এ তো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ‘ মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’, শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়া কি তাহলে শুধুই জমাটি আড্ডা ভরপুর করার জন্য? বোধের জন্য নয়? জীবনে কাজে লাগানোর জন্য নয়? ঠিক কবে থেকে আমরা এতটা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠলাম?

 

আরও পড়ুন: ভালবাসার মানুষের প্রতি বিশ্বাস নেই, কেন প্রেমের সম্পর্কে থাকতে চান না কিছু মানুষ?

 

সমাজ-মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় bystander effect। মূলত কেউ বিপদে পড়লে সাহায্য না করতে যাওয়া। এর এক ধরনের মনস্তত্ত্ব আছে। তারও আবার পাঁচটি ধাপ আছে। হ্যাঁ, হাস্যকর হলেও একথা সত্যি বলেও প্রমাণিত। প্রথম ধাপ হলো, না দেখার ভান করা। পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে চলে যাওয়া। দ্বিতীয় ধাপ হলো, সকলে মিলে সাহায্য 'না' করা। Pluralistic ignorance বলা হয় একে। জরুরি অবস্থা প্রত্যক্ষ করার পর কেউ যদি সাহায্যের হাত না বাড়ায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাকিরা আর এগোন না অথবা ধরে নেওয়া হয়, বিশেষ কিছু সমস্যা নয়, আর কেউ যখন এগোচ্ছেন না। তৃতীয়ত, মনে হয় অন্য কেউ নিশ্চয় এগোবেন। এই ক্ষেত্র বিশেষ করে দেখা যায় যখন মানুষ বা পশু রাস্তায় অসুস্থ হয়ে থাকে। চতুর্থ ক্ষেত্রে অনেকেই বুঝতে পারেন না, সেই সময়ে কী করবেন, সাহস বা আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে। আর সর্বোপরি, নিজে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার, অস্বস্তিতে পড়ার ভয়, থানা-পুলিশের ভয় তো আছেই। যা সাক্ষীর সঙ্গে ঘটে থাকে। মনে করে দেখতে পারেন, 'দহন'-এ মেয়েটিকেও অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন ও অবস্থানের মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তাই একধাপ সাহায্যের হাত বাড়ানোর আগে আমাদের মনকে পেরোতে হয় এতগুলো ধাপ, খুব চটজলদি। এই ধাপগুলোই আমাদের আটকে দেয় অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।

 

এ তো গেল আমার-আপনার সমস্যার কথা। আর প্রথমে যে মেয়েটির গল্প দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। সদ্য প্রেমে পড়া, স্বপ্ন দেখা মায়াবী দুটো চোখ, এখন শুধুই আতঙ্কের, ভয়ের। মনোবিদ্যার ভাষায় Post traumatic stress disorder-এ ভুগতে থাকা মনে এখন শুধুই সেদিনের ঘটনার প্রতিচ্ছবি, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া বা ঘুম না হওয়া, থম মেরে যাওয়া, প্রায়শই চিৎকার করে ওঠা, সাহায্য না করতে পারা অপরাধপ্রবণ মন, পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগিতা আর তার সঙ্গে ভালোবাসার এই ভয়ংকর পরিণতি তার নিজস্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন জাগিয়েছে। সময়ের নিজস্ব নিয়মে পিয়ালী ঠিক হয়ে উঠবে, ওর বৃষ্টিতে ভেজা, রামধনু দেখা, বসন্তের হাওয়া সারা গায়ে মাখা- এসব ওর অনুভূতিপ্রবণ মনেরই ইঙ্গিত আসলে, তাই এই ঘটনার প্রভাবও কিঞ্চিৎ প্রকট অন্যদের তুলনায়। তবে এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় আছে,উত্তরণ আছে। আমরা জীবনে কম-বেশি সকলেই ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাই। যা সময়ের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে মিলিয়ে না গেলেও, দ্রবীভূত হয়, আবছা হয়। ওর ক্ষেত্রেও হবে, তা নিশ্চিত। যেহেতু এই ঘটনার তীব্রতা অনেকটাই বেশি, তাই মনোবিদের সাহায্য নিতেই হবে ওকে। কারণ ধামাচাপা দিয়ে এই যন্ত্রণা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়, বহন করা দিয়ে সম্ভব (সত্যি ঘটনা অবলম্বনে, পিয়ালীর নাম ও চরিত্র কাল্পনিক)।

 

এবার আসি নিজস্ব বিবেকের প্রশ্নে। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন, সাহসের সঙ্গে এগোনো ছাড়া আমাদের করণীয় কোন উপায় নেই। কিন্তু আমি-আপনি-আমরা- সকলেই অন্য কেউ যখন বিপদে পড়বে, সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে তৎপর হব কতটা? প্রশ্ন এখানেই। আর ভয়টাও এখানেই, কারণ এটা কে বলতে পারেন, bystander effect-এর শিকার আপনি হবেন না?

More Articles