জানুন কেন বিখ্যাত বারাসাতের কালিপুজো!

দীপাবলি না কালী পুজো? আমাদের উৎসব আসলে কোনটা ? রাক্ষস দমন করতে থাকা মা কালীর পা হঠাৎ শিবের বুকেই বা পড়লো কেন? কোথা থেকে ছড়িয়ে পড়লো এই পুজো সারা ভারতে? পুরাণের হাজারও গল্প, কিন্তু আমরা কি জানি এই আলোর উৎসবের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে আরও কত গল্প! আসুন জেনে নেওয়া যাক।


দীপাবলি মানেই আলোর উৎসব, দীপাবলি মানে চারিদিকে সেজে ওঠে মণ্ডপ, আতসবাজি তে রঙীন হয়ে ওঠে রাতের আকাশ, সমগ্র অন্ধকার গ্রাস করে ফেলে ঘরে ঘরে জ্বলা প্রদ্বীপের আলো। প্রতিবছর শরতের সাথে সাথে আগমন ঘটে দেবী দুর্গার, সারাবছরের কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে এক প্রশান্ত শ্বাস নেওয়ার জায়গা। শরতের সাথে সাথে মা দুর্গার ঘরের ফেরায় এক শূন্যতা ঘিরে ধরে বাঙালিদের মনে। আর ঠিক তখনই হেমন্তের রাতে আলোয় সেজে ওঠে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ।একদিকে যেমন চলে 'দেওয়ালি' উৎসব অর্থাৎ মা লক্ষ্মীর আরাধনা অন্য দিকে তেমনি চলে মা কালীর পূজো। দুর্গা পুজোও যেমন শুধু বাঙালি বা বাংলায় সীমাবদ্ধ নয়, ঠিক তেমন ভাবেই কালী পুজো বা দীপাবলির বিস্তার আরও বেশি, আরও বিরাট। তবে কালী পুজোর এই আজকের যাবতীয় দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য, চাকচিক্য, আধুনিকতার পেছনে কিছু কাহিনী আছে যা হয়তো অনেকেরই অজানা। 

যেমন দুর্গাপুজো বললে মানুষ কলকাতা বোঝে, জগদ্ধাত্রী পুজো বলতে মানুষ চন্দননগর চেনে তেমনই সবচেয়ে বিখ্যাত কালী পুজো বললে সবার প্রথমেই আসে বারাসাতের পুজোর কথা। তবে এই বারাসাতের পুজোর ইতিহাস জানবার আগে আমরা সংক্ষেপে জেনে নেবো মা কালী ও সেই সংক্রান্ত গল্পগুলির সম্ভাব্য ইতিবৃত্ত। হিন্দু পুরাণ মতে বিভিন্ন কাহিনী প্রসিদ্ধ হলেও সব থেকে বেশি প্রচলিত কাহিনীগুলি অনুযায়ী একবার রাক্ষসদের ত্রাসে ভিত হয়ে ওঠে দেবলোক। দেবরাজ ইন্দ্র সহ সকল দেবতাকে পরাজিত করেন রক্তবীজ। যারা হিন্দু পুরাণ বা দেবদেবীর গল্প ঘেঁটে দেখায় অভ্যস্ত তারা জানেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহাদেব অনেক সময়ই ধ্যানরত রাক্ষসদের এমন বরদান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন যে তাতে দেবতাদের বিপদের সম্মুখীন হতে হতো। যেমন, ব্রহ্মা কে প্রসন্ন করতে নিজের ন'টি মাথা ধর থেকে আলাদা করে ফেলেন রাবণ, দশম অর্থাৎ শেষ মুন্ড টি দেহ থেকে আলাদা করার আগেই প্রকট হন ব্রহ্মা এবং রাবণকে একটি বর দিতে রাজি হন। রাবণ চেয়ে বসে অমরত্ব। কিন্তু ব্রহ্মা অমরত্ব দিতে নারাজ হলে রাবণ শর্ত রাখেন কোনও দেবতা বা রাক্ষস, জন্তু জানোয়ার বা অপ্সরা কেউ তাকে মারতে পারবেন না। যদিও রাবণের মৃত্যু হয় রামের হাতে যাকে পুরাণে আর্য মানব হিসেবে বর্ণনা করা হয়। একই ভাবে জানা যায় হিরণ্যকশ্যপের কথা, যিনি বর পেয়েছিলেন দেবতা বা রাক্ষসের হাতে তার মৃত্যু হবে না, তাকে না দিনে মারা যাবে না রাতে, না মাটিতে মারা যাবে না আকাশে। ভগবান বিষ্ণু নর এবং সিংহের মিশ্রিত রূপে আসেন, হাওয়ায় ভাসমান অবস্থায় নিজের কোলে রেখে ভর সন্ধ্যা বেলায় তার বধ করেন। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতেই পারে রাক্ষসেরা চালাক হলেও আমাদের দেবতারা সব সময় এক পা এগিয়েই ছিলেন। ঠিক তেমন ভাবেই রক্তবীজের আশীর্বাদ ছিল তার শরীর থেকে পড়া প্রতি ফোঁটা রক্ত থেকে জন্ম নেবেন আরও রক্তবীজ। সুতরাং দেবতাদের পক্ষে তাকে হারানো হয়ে উঠলো কার্যত অসম্ভব। অনেকে এক্ষেত্রে রক্তবীজের পরিবর্তে শুম্ভ নিশুম্ভের কথাও বলে থাকেন। যাই হোক, দেবতারা এই সময় মা দুর্গার শরণাপন্ন হলেন, মতান্তরে পার্বতী বা আদ্যাশক্তির কথাও শোনা যায়। দেবী ক্রুদ্ধ হয়ে তখন মহাকালের স্ত্রী লিঙ্গ রূপে রাক্ষস বধে নেমে এলেন। কিন্তু বিপদ হয়ে দাঁড়ালো ব্রহ্মার বরদান। দেবী যতবারই রক্তবীজের মুন্ড দেহ থেকে আলাদা করে দেন ততবারই আরও অনেক অনেক রক্তবীজ জন্ম নেয়, ক্রোধিত দেবী তখন বিনাশে নেমে আসেন এবং চার হাতের একটিতে হাতে খড়গ অন্য একটি হাতে বড় পাত্র নিয়ে রক্তবীজের মুন্ড দেহ থেকে আলাদা করেন এবং সেই রক্ত মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই পাত্রে ধারণ করেন এবং পান করে নেন। একে একে বিশাল রাক্ষসকুল ধ্বংস করে দেবী যখন বিনাশের তুমুল মাত্রায় চলে গেলেন তখন দেবীর তাণ্ডবে ধ্বংস হতে শুরু করে ত্রিলোক। দেবতারা আরও ভিত হয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হলে ভোলেনাথ মা কালীর পথে এসে শুয়ে পড়েন। তান্ডবলীলা চালিয়ে যেতে থাকা দেবীর পা এই সময় পড়ে মহাদেবের বুকে এবং পলকে ক্রোধ লজ্জায় পরিণত হয়। মা এই সময় ধিক্কারে জিভ কাটেন এবং তারপর থেকে এই মূর্তিই পূজিত হয় ধরাধামে। এতেও আবার ভাগ রয়েছে, ডান পা যেখানে শিবের বুকে উত্থিত তাকে জানা যায় দক্ষিণা কালী নামে, আবার যে প্রতিমার বাঁ পা উঠেছে তার স্বামীর বুকে তাকে জানা যায় বামাকালী নামে, ইনি নাকি আরও ভয়ানক, ক্রোধি এবং ধ্বংসপ্রিয়া। কিন্তু এ তো গেল পুরাণের গল্প, ভারতে কেন তার পুজো হয় এবং কীভাবে তার প্রসিদ্ধি জানতে হলে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে সময়ে, আনুমানিক আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে।

বলা হয় সম্রাট আকবর বাংলার সুবেদার হিসেবে নিযুক্ত করেন তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মান সিংহ কে, যিনি বারো ভূঁইয়াদের এক ভূঁইয়া প্রতাপাদিত্য কে পরাজিত এবং বন্দী করেন। তার সঙ্গেই বন্দী রূপে আসেন প্রতাপাদিত্যের ব্রাহ্মণ সেনাপতি তথা প্রধান উপদেষ্টা শঙ্কর চক্রবর্তী। বন্দী দশায় প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু হয় এবং শঙ্কর চক্রবর্তী কে যাবতজীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। আকবরের মৃত্যুর পর কোনও এক সময়ে পিতৃ তর্পণ করতে চাইলেন শঙ্কর, কিন্তু আকবর পুত্র জাহাঙ্গীর তাতে রাজি না হওয়ায় অনশন শুরু করেন তিনি। এই সময় আকবর স্ত্রী যোধা বাঈ এর অনুরোধে যমুনায় পিতৃতর্পণ দিতে অনুমতি দেওয়া হয় শঙ্কর চক্রবর্তীকে। কথিত আছে দেবী দুর্গার স্বপ্ন দেখেন যোধা এবং তার পুনঃ অনুরোধেই শঙ্করকে মুক্তি দেন জাহাঙ্গীর। শঙ্কর চক্রবর্তী ফিরে এসে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যায় নিজের বাসস্থান বারাসাতের দক্ষিণপাড়ায় কালীর পুজো শুরু করেন। পরবর্তীকালে আঠারো শতকে কৃষ্ণচন্দ্র আগম্বাগিসের উদ্যোগে নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে কালী পুজোর প্রসার বাড়তে আরম্ভ করে।  বড় প্রত্যাবর্তন ঘটে উনিশ শতকে, যখন রামকৃষ্ণ কালীর উপাসনা কে অন্য মাত্রার উচ্চতায় নিয়ে চলে যান। 

মা কালী শক্তির প্রতীক, তিনি একাধারে যেমন ধ্বংস তেমন অভয়ের প্রতীক। এদিকে গলায় মুন্ডমালা, বাম হাতে খড়্গ ও রাক্ষসের মুন্ডু, তেমনই ডান হাতে অভয় এবং আশীর্বাদের মুদ্রা। কালীপুজো শুধু বাংলার বা হিন্দুদের উৎসব নয়, আসাম, ওড়িশা, মহারাষ্ট্রতেও এই উৎসব উদযাপিত হয়। এই সময় সারা ভারতে দীপাবলি উৎসব পালন করা হয়। পুরাণ অনুসারে রামচন্দ্র সিতা এবং লক্ষণকে সঙ্গে নিয়ে চোদ্দ বছরের বনবাস কাটিয়ে, রাবণকে পরাজিত করে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন এই তিথিতেই। এছাড়া কালী যেহেতু শক্তির আরেক রূপ, তাই বিভিন্ন ধর্মে তন্ত্রের সাধকরা কালীর উপাসনা করে থাকেন। 

মহাশক্তি নানা রূপে নানা নামে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে এসেছেন অসুর নিধনে। জননী রূপে রক্ষা করে চলেছেন এ পৃথিবীকে। নানা স্থানে নানা রূপে পূজিত দেবীর পৌরাণিক  কাহিনী খতিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে আরও অনেক গল্প। কোথাও রঘু ডাকাতের গল্প টেনে নিয়েছে মানুষের আকর্ষণ, আবার কখনও ফাটাকেষ্টর বিখ্যাত পুজো হয়েছে নজরকাড়া, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর তো থাকছেই। পৌরাণিক যে কোনও চরিত্র এবং তাদের সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে হাজারো মতভেদও রয়েছে। রামকৃষ্ণ মতান্তরের কথা বলেছিলেন, তাই সেই পার্থক্য গুলির কথা থেকে বেরিয়ে যে বিষয়টা অনস্বীকার্য তা হল দেবী কালী প্রায় সকলেরই আরাধ্য। শুধু ধার্মিক বা আধ্যাত্মিক জায়গাটা এড়িয়ে গেলেও দীপাবলির আলো হাজার হাজার মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিতে পারে অর্থনৈতিক দিক থেকেও, তা সে প্রদীপ বিক্রেতা ছোটো মেয়েটি হোক বা বয়স্ক কোনও ফুলঝুরি বিক্রেতা। সমস্ত বিষাদ জলাঞ্জলি দিয়ে সেজে ওঠে ঘর, বারান্দা, বাড়ির ছাদ, রাস্তা। কে জানে, এই রোশনাই টুকুই হয়তো মনের তথা জাগতিক সমস্ত অন্ধকারকে একদিন ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে। 

 


Story source :

  • https://youtu.be/dh_wngUJFys
  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kali_Puja
  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/Diwali#:~:text=The%20religious%20significance%20of%20Diwali,Ravana's%20army%20of%20evil.

More Articles