ভারতে ইন্টারনেটের জনক, মন্ত্রী-আমলাদের বিরোধিতাতেও অটল ছিলেন বিকে সিঙ্গাল

ইন্টারনেট শুরুর দিন থেকে আজ প্রায় ২৭ বছর পর ভারতে ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মোবাইল ব্রড‌ব্যান্ড গ্রাহক রয়েছে। এই কৃত্বিতের একমাত্র দাবিদার বিজেন্দ্রকুমার সিঙ্গাল।

এক লহমায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয় ইন্টারনেট। ভারতে ডিজিটাল ইন্ডিয়া, রিলায়েন্স জিও-র দৌলতে প্রান্তিক ভারতীয়দের কাছেও পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট পরিষেবা। কিন্তু নয়ের দশকেও এতখানি সহজলভ্য ছিল না ইন্টারনেট। তবে আজ ইন্টারনেট যেভাবে ভারতীয়দের জীবনের সঙ্গে জুড়ে গেছে, তার নেপথ্য কারিগর বিজেন্দ্রকুমার সিঙ্গাল। ভারতে ইন্টারনেটের জনক হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাল। তাঁর হাত ধরেই ভারতের টেলিকম ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে গেছে। মন্ত্রী, আমলাদের প্রবল সমালোচনার মুখেও উপমহাদেশের প্রথম ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন সিঙ্গাল। তবে শরীরের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়েছেন সিঙ্গাল। চলতি মাসের ৯ জুলাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের ইন্টারনেট এবং ডেটা সার্ভিসের জনক বিজেন্দ্রকুমার সিঙ্গাল।

সিঙ্গালের পরিবারের তরফে ট্যুইট করে জানানো হয় তাঁর মৃত্যুর খবর। ট্যুইটে লেখা, "দীর্ঘ অসুস্থতার সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের পর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন বিকে। প্রতিদিনই তাঁর পরিবার তাঁর অভাব অনুভব করবে।" সিঙ্গালের বাবা ছিলেন একজন বেসরকারি কর্মচারী এবং মা গৃহবধূ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তান থেকে দিল্লিতে চলে আসেন তাঁর পরিবার। সিঙ্গাল দেশের শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খড়গপুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে (আইআইটি) পড়াশোনা করেন সিঙ্গাল। ১৯৯১ সালে পরিবার ও বন্ধুদের অবাক করে লন্ডনের চাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন সরকারি সংস্থা বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেড-এর (বিএসএনএল) চেয়ারম্যান পদে। পরের সাত বছরে বিএসএনএল কোম্পানিকে আমূল বদলে দেন সিঙ্গাল। মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলারের কোম্পানিকে সাত বছরের মধ্যে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত করেছিলেন তিনি। দেশের কমিউনিকেশন জায়েন্টের রূপ নেয় বিএসএনএল।

ভারতীয় আমলা, তিনটি সরকার এবং পাঁচ জন টেলিকম মন্ত্রীর বিপক্ষে একা সিঙ্গাল। ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট সকলের মতবিরোধের পরও ভারতে ইন্টারনেট চালু করেন বিজেন্দ্রকুমার সিঙ্গাল। ভারতের পাঁচ শহর- দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই এবং পুনেতে ইন্টারনেট চালু করেন। সংবাদপত্রগুলি উচ্ছাসের সঙ্গে এই দিনটিকে ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে অভিহিত করেন। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতেই প্রথম বাণিজ্যিক ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়। কিন্তু উচ্ছাস খুব দ্রুতই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ডায়াল আপ অ্যাকসেস, মোডেম ব্যবহার এবং খারাপ সংযোগের কারণে সংযোগে সমস্যা, প্রতি তিন মিনিটে কল ড্রপ হতে থাকে। এত প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং ভোক্তাদের অসন্তোষের ফলে এক মাসের মধ্যে সংসদে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মিডিয়ার সামনেই মাত্র ১০ সপ্তাহ সময় চেয়ে নেন তিনি সরকারের কাছে। তিনি বলেন, "আমি বোকামি করেছি। আমাকে ১০ সপ্তাহ সময় দিন, আশা করি, আপনি এরপর থেকে গর্ববোধ করবেন।"

আরও পড়ুন: এককালে ভারতের সর্বোচ্চ ধনী, একা হাতে মুম্বইয়ের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন পালোনজি মিস্ত্রি

সিঙ্গাল এবং তাঁর দলের প্রচেষ্টাতেই বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হল সার্ভার, উন্নত সংযোগ ব্যবস্থা, ভালো মানের মোডেম, তামার তারের পরিবর্তে ফাইবার কেবলের পাশাপাশি আগের তুলনায় অর্ধেক খরচে ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়। সরকারি সংস্থার দুর্বল মার্কেটিংয়ের জায়গায় নিয়ে এলেন বেসরকারি কোম্পানিকে। এই কোম্পানিই সিঙ্গালকে ইন্টারনেট পরিষেবা বেচতে সাহায্য করেছিল। ব‍্যস, আট সপ্তাহের মাথাতেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেন সিঙ্গাল। ভারতীয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের উৎসাহ জোগাতে বলিউড অভিনেতা শাম্মি কাপুরকেও এর সঙ্গে যুক্ত করেন তিনি। শাম্মি কাপুর ১৯৯৪ সাল থেকে অ্যাপল-এর উপহার দেওয়া বিটা অনলাইন পরিষেবা ব্যবহার করতেন।

আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ভারতীয়দের। ১৯৯৭ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অন্যতম মিডিয়াকে জানিয়েছেন, "আমরা সফটওয়্যার তৈরিতে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কোনওভাবেই প্রতিযোগিতাতেও ছিলাম না। কিন্তু আজ আমাকে বিদেশি কোম্পানিরা একসঙ্গে কাজ করার জন্য এসএমএস করেন।" এখানেই ধীরে ধীরে জিতে যান সিঙ্গাল। ভারতীয় সফটওয়্যার তৈরিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে ইন্টারনেট। ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের অন্যতম কারিগর হরিশ মেহেতা বলেছেন, "সিঙ্গাল বছরের পর বছর ডেটা লিঙ্ক সরবরাহ করে ভারতীয় শিল্পের জন্য অসামান্য কাজ করেছেন।"

১৯৯৮ সালের জুন মাসে আমেরিকান ম্যাগাজিন 'বিজনেস উইক'-এ ধীরুভাই আম্বানি এবং দীপক পারেখের সঙ্গে 'এশিয়ার ৫০ তারকা' হিসেবে সিঙ্গালের নাম প্রকাশ করা হয়। এই ম্যাগাজিনে তাঁকে 'বুলডোজার' নামে অভিহিত করা হয়, যিনি একের পর এক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ভারতকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছন। কিন্তু এর ঠিক দু'দিন পরেই স্পষ্টভাষী সিঙ্গাল রাজনৈতিক চাপের সামনে মাথা নত না করায় তাঁকে ফ্যাক্স পাঠিয়ে বরখাস্ত করা হয়। তাতে অবশ্য কোনওভাবেই ছোট হয়ে যায়নি তাঁর কৃতিত্ব। পরবর্তীকালে রিলায়েন্স টেলিকম এবং বিপিএল কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান পদে কাজ করেছেন তিনি।

ইন্টারনেট শুরুর দিন থেকে আজ প্রায় ২৭ বছর পর ভারতে ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মোবাইল ব্রড‌ব্যান্ড গ্রাহক রয়েছে। এই কৃত্বিতের একমাত্র দাবিদার বিজেন্দ্রকুমার সিঙ্গাল।

 

More Articles