নিরামিষ বিশ্বকাপ! বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কী কী চরম নিষিদ্ধ কাতারে?

FIFA World Cup 2022 Qatar: ফ্যানদের খোলামেলা পোশাক নৈব নৈব চ! কাতারের আইন অনুযায়ী এমনটা করলে, মহিলাদের যেতে হবে সোজা শ্রীঘরে! আর যদি পুরুষরা পুরোপুরি টপলেস হয়ে যান, তাহলেও দিতে হবে মোটা টাকার জরিমানা।

এক যুগ বা ১২ বছরের অপেক্ষার অবসান। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত আসর কোথায় বসবে তা ঠিক হয়েছিল ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর। নানা জল্পনা-কল্পনা আর সমালোচনার ঢেউ ঠেলে অবশেষে নির্ধারিত বন্দরে নোঙর ফেলল জাহাজ। সাগর ঘেরা ছোট্ট দেশ কাতারকে বিরাট এক বন্দরই বলা চলে। খেলার সংখ্যা আর খেলোয়াড় সংখ্যায় অলিম্পিক গেমস গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ হলেও, দর্শক সংখ্যায় পৃথিবীর সবথেকে বড় আসর এই বিশ্বকাপ ফুটবল। আর এবারের আসরটি বসেছে বিশ্বের এমন একটি দেশে যার জনসংখ্যা আগের সব আয়োজক দেশের থেকে কম। বলতে গেলে আরব বিশ্বেও ফুটবল বিশ্বকাপ এবারই প্রথম।

প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজিত হলেও, প্রায় শতবর্ষে এই ফুটবল প্রতিযোগিতায় এবার অনেক কিছুই নতুন। শুরুর সময় থেকেই শুরু ব্যতিক্রমের। এবারের আসর শুরু হল নভেম্বরের শেষ দিকে। এই সময় কাতারের তাপমাত্রা মোটামুটি ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে। দিন তারিখের হিসেবে কয়েক মাস আগে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আসর। কিন্তু এবারে ব্যাপারটা একটু আলাদা। এমনিতে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হয় জুন মাসে আর শেষ হয় জুলাই মাসে। বিভিন্ন দেশের ফুটবল লীগের উপর যেন কোনও রকম প্রভাব না পড়ে, তার জন্য এই নিয়ম তৈরি করেছে ফিফা। সাধারণত ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে সমস্ত ফুটবল লিগ তখন শেষ হয়ে যায়। আর নতুন লীগ শুরু হয় অগাস্টে। পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চলে এই সময় আবহাওয়া থাকে সহনীয়। কিন্তু এবারের আয়োজক দেশের আবহাওয়ার কারণে সময়ের অনেকটা হেরফের করতে হয়েছে ফিফাকে। আসলে, জুন জুলাইতে কাতারের তাপমাত্রা মোটামুটি ৪০° সেলসিয়াসের উপরে চলে যায়, যা শীত প্রধান দেশগুলির জন্য একেবারে নরকসম। আর সেই কারণেই এবারের বিশ্বকাপ শুরু হল নভেম্বর মাসে।

কিন্তু এবার যে সময় বিশ্বকাপ হচ্ছে তাদের ফুটবলপ্রধান দেশগুলোর প্রতিটিতেই লীগের খেলা বাধাগ্রস্ত হতে চলেছে। তাই প্রায় এক যুগ আগে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসেবে কাতারের নাম সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল বিতর্ক। তবে, ইচ্ছে থাকলে টাকায় কী না হয়। সেই সব বিতর্কের জাল ছিন্ন করে, সমস্ত বেড়াজালকে টপকে শুরু হল কাতার বিশ্বকাপ, ক্রীড়া জগতের ইতিহাসে যা কার্যত এক বিস্ময়।

আজ অবধি ইতিহাসে এত ছোট দেশ কখনও এত বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে পারেনি। আয়োজক হওয়ার সাহসও দেখায়নি কোনও দেশ। কাতার অবশ্য এর আগে সামর্থ্য প্রমাণের জন্য এশিয়ান ফুটবল প্রতিযোগিতা এবং এশিয়ান গেমস আয়োজন করেছিল সফলভাবেই। ১২,০০০ কিলোমিটারের কম আয়তন যে দেশের, যে দেশের রাজধানী থেকে সব থেকে দূরের স্টেডিয়ামের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার, সেই দেশেই এবার হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন। অর্থের জোরেই সম্ভব হয়েছে এই সমস্ত কিছু। বিশ্বমানের দশটি স্টেডিয়াম বানানো থেকে শুরু করে স্টেডিয়ামের বিরাট অংশ জুড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সব কিছুই রয়েছে এই কাতার বিশ্বকাপে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও কাতার বিশ্বকাপ অন্যান্য বিশ্বকাপের থেকে অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। কাতার বিশ্বকাপে রয়েছে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা। দেশটিতে রয়েছে এমন কিছু আইন, যা ভারত বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে কার্যত অবাক করার মতোই।

আরও পড়ুন- একটুর জন্য ফসকাল বিশ্বকাপ! তীরে এসে তরী ডোবার সে দুঃখ আজও ভোলেনি বাঙালি

কোন কোন বিষয়ে উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কাতারে?

ড্রাগস

ড্রাগসের ক্ষেত্রে পুরো কাতার দেশটিতে চলে জিরো টলারেন্স। গাঁজা এবং বাকি ধরনের নেশার সামগ্রী ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ কাতারে। এই সমস্ত জিনিস বিক্রি বা ব্যবহার সবকিছুই সম্পূর্ণ বেআইনি। যদি আপনি ড্রাগস নিয়ে কাতারে হাতেনাতে ধরা পড়েন তাহলে শুধু মোটা অঙ্কের জরিমানা নয়, জেল পর্যন্ত হতে পারে। এমনকী মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এতদিন বিশ্বের যে সমস্ত দেশে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে, সেখানে ড্রাগস বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক। বিশ্বকাপ ফুটবলের পাশাপাশি ড্রাগস পার্টি আকছার দেখা যেত বিশ্বকাপ আয়োজক দেশগুলিতে। কিন্তু সেই সমস্ত দেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কাতার। ড্রাগ ট্রাফিকিং, ড্রাগ স্মাগলিং অনেক দূরের কথা, আপনার কাছে ন্যূনতম পরিমাণ ড্রাগ পাওয়া গেলেও আপনাকে কাতারে হাজতবাস করতে হবে, দীর্ঘ সময়ের জন্য।

অ্যালকোহল

আপনি মদ কিংবা অ্যালকোহলযুক্ত কোনও পানীয় অন্য দেশ থেকে কিনে তা নিয়ে কাতারে প্রবেশ করতে পারবেন না। যদি অ্যালকোহল জাতীয় কোনও দ্রব্য নিয়ে কাতারে প্রবেশ করেন তাহলে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে। এমনকী হাজতবাস হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এই মুহূর্তে শুধুমাত্র লাইসেন্স যুক্ত হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং বারে অ্যালকোহল মেলে। তাও অতিরিক্ত অনুমতি বা ছাড়পত্র নিয়ে তবেই প্রবেশ করতে হবে সেসব জায়গায়। তার পাশাপাশি টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময় কয়েকটি ফ্যান জোনে মদ্যপানের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে দোকান থেকে অ্যালকোহল কেনা যাবে না।

যত্রতত্র মদ্যপান করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রক্ষণশীল কাতারে। দোহার বাসিন্দা অমুসলিমরা লাইসেন্স নিয়ে বাড়িতে মদ্যপান করতে পারবেন। স্টেডিয়াম চত্বরে নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সমর্থকরা বিয়ার খেতে পারবেন। কাতারে মদ্যপান নিয়ে নিয়ম অত্যন্ত কড়া। তবে এবার বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে অনেকটাই শিথিল করা হয়েছে।

পর্নোগ্রাফি

মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে কাতার পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে অত্যন্ত কড়া। কোনওরকম পর্নোগ্রাফিক দ্রব্য অন্য দেশ থেকে কাতারে নিয়ে আসা যায় না। যে কোনও ধরনের সেক্স টয় থেকে শুরু করে কোনও পর্নোগ্রাফিক মেটেরিয়াল, কোন কিছুই কাতারে নিয়ে যেতে পারবেন না। কাতার বিমানবন্দরে প্রবেশ করার সময় এরকম কোনও জিনিস যদি যাত্রী সঙ্গে থাকে তাহলে তাঁর মোটা টাকা জরিমানা হতে পারে। এমনকী, কাতার দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারা অনুযায়ী সেই ব্যক্তির ছয় মাস পর্যন্ত হাজতবাস হতে পারে।

যৌনতা

স্বামী-স্ত্রী বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে এসে যদি অবৈধ যৌনমিলন রত অবস্থায় কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে কাতারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে কঠিন শাস্তি। কাতার অত্যন্ত রক্ষণশীল দেশ হওয়ার কারণে, অবাধ যৌনতা এই দেশে গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু অবাধ যৌনমিলনই নয়, কাতারে সমকামী সম্পর্কও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সাধারণত ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে যৌনতার আসর বসে ফি-বছর। অনেকেই সেই মেলায় অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে কাতারের বিশ্বকাপে সেরকমটা হবে না।

কাতারে একবার যদি কেউ দোষী হিসেবে প্রমাণিত হয় তাহলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটলে সমস্যা নেই তবে প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠ হলে, সমস্যা বাড়বে বৈকি।

খোলামেলা পোশাক

ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই গ্যালারিতে স্বল্পবসনা ললনাদের ভিড়। ফুটবল বিশ্বকাপে এরকম রঙিন ছবি দেখতে অভ্যস্ত সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তরা। তবে মধ্যপ্রাচ্যর এই দেশের ফতোয়া মহিলা ভক্তদের পোশাকের ক্ষেত্রেও রয়েছে। নিষেধের বেড়াজালে বাধা এখানকার সংস্কৃতি থেকে পোশাক আশাক সবকিছুই। এবারে যদি আপনাকে কাতারের স্টেডিয়ামে বসে বিশ্বকাপ দেখতে হয় তাহলে শরীর প্রদর্শনকারী পোশাক থেকে বিরত থাকতে হবে। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফ্যানদের খোলামেলা পোশাক নৈব নৈব চ! কাতারের আইন অনুযায়ী এমনটা করলে, মহিলাদের যেতে হবে সোজা শ্রীঘরে! আর যদি পুরুষরা পুরোপুরি টপলেস হয়ে যান, তাহলেও দিতে হবে মোটা টাকার জরিমানা। স্লিভ লেস ট্যাঙ্ক যেমন পরা যাবে না, তেমনই আপত্তিকর স্লোগানেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

শুয়োরের মাংস

মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে শুয়োরের মাংস কাতারে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তাই অন্য কোনও দেশ থেকে শুয়োরের মাংস বা সেই জাতীয় কোন দ্রব্য নিয়ে কাতারে আপনি প্রবেশ করতে পারবেন না। যদি ধরা পড়ে যান তাহলে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে। এই অপরাধের জন্য অবশ্য আপনার জেল কখনই হবে না, তবে সমস্ত খাবার নষ্ট করে দেওয়া হবে কাতার সরকারের তরফ থেকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এয়ারপোর্ট থেকেই আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন- এই প্রথমবার শীতকালে আয়োজিত হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ, নেপথ্যে কোন কারণ

ধর্মীয় গ্রন্থ

মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারণে কাতারে অন্য কোনও ধর্মের চর্চা আপনি করতে পারবেন না। যদি আপনি অন্য ধর্মাবলম্বী হন, তাহলেও নিজের ধর্মের চর্চা করা কাতারে অসম্ভব। অন্য কোনও ধর্মের বই এবং ধর্মীয় জিনিসপত্র এয়ারপোর্টে আটকে রাখা হবে। আবার যখন আপনি ফেরত যাবেন তখন আপনি নিজের জিনিস নিয়ে যেতে পারেন।

ই-সিগারেট/ ভেপ

আপনি ভেপ ব্রিট নিয়ে কাতারে প্রবেশ করতে পারবেন না কারণ এই ধরনের জিনিস কাতারে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই ধরনের জিনিস নিয়ে কাতারে প্রবেশ করেন অথবা সেই জিনিস বিক্রির চেষ্টা করেন তাহলে কাতার দণ্ডবিধির ১০ নম্বর ধারার ৭ নম্বর আর্টিকেল অনুযায়ী টোব্যাকো কন্ট্রোল আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে এবং তাঁকে ১০ হাজার রিয়াল জরিমানা গুনতে হবে। যদি তিনি জরিমানা না দিতে পারেন তবে কাতারের জেলে তিন মাস বন্দি থাকতে হবে।

তাই যদি  ধূমপানের অভ্যাস থাকে তাহলে আপনি নিকোটিন পাউচ ব্যবহার করতে পারেন কাতারে। এই ধরনের নিকোটিন পাউচ কাতারে নিষিদ্ধ নয়। যে সমস্ত নিকোটিন পাউচে তামাকজাত পদার্থ নেই, সেগুলিকে নিয়ে আপনি কাতারের প্রবেশ করতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকেও, এবছর কাতারের এই পদক্ষেপকে সম্মানিত করা হয়েছে।

প্রেসক্রিপশন

ঘুমের ওষুধ, ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ বা পেইনকিলার, অ্যান্টি ডিপ্রেশন ট্যাবলেট এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ড্রাগ কাতারের সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আপনি যদি এই সমস্ত ওষুধ নিয়ে কাতারে প্রবেশ করেন তাহলে আপনাকে এয়ারপোর্টে গ্রেফতার করা হতে পারে, এবং জেলহাজত পর্যন্ত হতে পারে। তাই যদি এই ধরনের কোনও ওষুধ নিয়ে আপনি কাতারে প্রবেশ করেন তাহলে এর সঙ্গে আপনাকে অবশ্যই একটি প্রেসক্রিপশন রাখতে হবে এবং থাকতে হবে হাসপাতালের অনুমতি পত্র।

তবে এমনটা হলেই আপনি যে কাতারে প্রবেশ করতে পারবেন, ব্যাপারটা ততটা সহজ নয়। আপনাকে প্রথমত কাতার এমব্যাসির কাছ থেকে আপনার প্রেসক্রিপশনের জন্য একটি পারমিশন নিতে হবে। এই পারমিশন সর্বাধিক ৩০ দিনের জন্য গ্রাহ্য করা হবে।

More Articles