চলচ্চিত্রে কিছু সমাপতন ও অকাল প্রয়াণের গল্প

চলে যাওয়া একধরনের কথকথার জন্ম দেয়। যে আছে ভীষণভাবে তার চলে যাওয়াগুলো হয়ত অন্যদের থেকে আরও বেশি দাগ কেটে যায়। চলচ্চিত্রাভিনেতাদের ক্ষেত্রে এই দিক থেকে একটা অন্য প্রিভিলেজ কাজ করে। চরিত্রগুলো, মুখগুলো একদিক থেকে অমরত্ব পাওয়ার কারণে অভিনেতাদের নিজেদের পাশাপাশি কোথাও কোথাও জায়গা করে নেন চরিত্ররা। মৃত্যু তখন অন্য দ্যোতনায় ফুটে ওঠে। যেন চরিত্রের ডিপ্রেশন, কাজকর্ম কোথাও অভিনেতাকেই টানেলের শেষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রাভিনেতাদের প্রয়াণ এবং বিশেষ করে অকাল প্রয়াণের এই তালিকা শতাধিক মুখ এনে হাজির করলেও এঁদেরই মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কিছু মৃত্যু। সম্ভবত জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়, কখনও ক্রমশ পিকপয়েন্টে ওঠা – এমনই একটা সময়ে হঠাৎ মৃত্যু। জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ দেখেও দেখতে না পারা। এমনই তিন তিনটে ঘটনা, ছবি, চরিত্র এবং সর্বোপরি সেই ব্যক্তিত্ব। অ্যাকশন ...
অ্যালফ্রেড হিচককের ঝকঝকে কেরিয়ারের অন্যতম মাইলস্টোন একটি ছবি এবং তার অন্যতম এক কেন্দ্রীয় চরিত্র। ট্রেন, দুটি মানুষ, তাদের বান্ধবী এবং কিছু শর্ত, পাল্টা শর্ত, যার পরিণতি ভয়ঙ্কর এক বিভীষিকায়। ‘স্ট্রেঞ্জার অন আ ট্রেন’-এর কথা বলছি। ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্ট্রেঞ্জার্সের ব্রুনো অ্যান্টনি চরিত্রটি চলচ্চিত্রের গুড বয়দের প্রিভিলেজে ঠিক প্রোটাগোনিস্টের তকমা না পেলেও সন্দেহাতীতভাবে একথা বলা যেতে পারে, ছবির প্রাণভোমরা, সিনস্টিলার সবই সেই ব্রুনো। এবং ব্রুনোর চরিত্রে মেসমেরাইজিং অভিনেতা রবার্ট ওয়াকার।
ছবির বাইরে রবার্ট ওয়াকার বলতে একাকীত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রেম এবং করুণ এক পরিণতিকে মনে করায়। ১৯৩৯ সালে অভিনেত্রী জেনিফার জোনসের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পরপর কিছু ঝকঝকে অভিনয়-জীবন পেরোলেও যা প্যারাডক্সের জন্ম দেয় ১৯৪৪ সালের ‘সিন্স ইউ ওয়েন্ট অ্যাওয়ে’ ছবিতে এসে। প্রযোজক ডেভিড সেলজনিয়াকের এই ছবিতে রবার্ট এবং জেনিফার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুই হতভাগ্য স্বামী স্ত্রীর চরিত্রে ছিলেন। ছবির সময়েই জেনিফারের সঙ্গে ডেভিড সেলজনিয়াকের রোম্যান্স ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। প্রোডাকশনের মাঝেই বিচ্ছেদ হয়ে রবার্ট-জেনিফারের। এই বিচ্ছেদ ওয়াকারকে জড়িয়ে থাকে কেরিয়ারের বাকি কয়েকটা বছর। টুকটাক বেশ কিছু চরিত্র পেলেও স্ট্রেঞ্জার্সে এসে শীর্ষে ওঠে তাঁর অভিনয় দক্ষতা। পাশাপাশি ক্যামেরার পেছনে বিচ্ছেদ-পরবর্তী একাকীত্ব এবং অবসাদের করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন রবার্ট। ভর্তি হন মেনিনজার ক্লিনিকে। ১৯৪৯ সালে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ক্লিনিক থেকে ফিরে এসে ডাক পান স্যার হিচককের কাছ থেকে। স্ট্রেঞ্জার্সের পাশাপাশি লিও ম্যাককারির ‘মাই সন জন’–এর টাইটেল রোল। আর এই পিকপয়েন্টেই আবার অবসাদ এবং অ্যালকোহলে ডুবে যেতে থাকেন রবার্ট। স্ট্রেঞ্জার্স মুক্তি পায় ১৯৫১-র ৩০ জুন। দুমাস পরেই সেই ১৮ আগস্ট। পরিচারিকা একদিন ঘরের ভেতর রবার্টকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখেন। কেমন একটা যেন করছেন মানুষটা। সাইক্রিয়াট্রিস্ট এসে অ্যামোবারবিটল দেন। সেডেটিভ। যদি ঘুম আসে। যদি একটু শান্ত হন রবার্ট। অবশ্য তখনই অনেকটাই অ্যালকোহলিক ছিলেন রবার্ট। সেডেটিভের সঙ্গে রিঅ্যাকশন। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের চেষ্টা করা হয় অনেক। রবার্টের ঘুম ভাঙেনি। স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেনের শেষ মৃত্যুদৃশ্য যেন বাস্তবের মাটিতে অভিনয় হল। স্ট্রেঞ্জার্সেই কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যাওয়া রবার্ট ওয়াকার ৩২ পেরোতে পারলেন না পুরোপুরি। শেষ ছবি ‘মাই সন জন’-এর মুক্তি দেখতে পেলেন না প্রোটাগোনিস্ট নিজেই। 
ছবির গল্প, বিশ্বাসঘাতকতা, ট্র্যাজিক পরিণতি - এসবেরই আরও এক দৃশ্য রচিত হয় ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফ্লোরিয়ান ডোনার্সমার্ক পরিচালিত বিদেশি ছবির বিভাগে শ্রেষ্ঠ হওয়া অস্কারপ্রাপ্ত জার্মান ছবি ‘দ্য লাইভস অফ আদার্স’-এর ক্ষেত্রেও, যার কেন্দ্রে অভিনেতা উলরিক মুহ। ছবির গল্প, অভিনেতার গল্প এক হয়ে যায়। ছবির অন্যতম এক কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন স্টাসি অধ্যুষিত পূর্ব জার্মানির এক নাট্যকার, যাকে তাঁর অজান্তেই নিজেরই বাড়িতে নজরদারিতে রাখে স্টাসি সরকার। অভিনেত্রী, প্রেমিকা স্বামীর বিদ্রোহ, লুকিয়ে রাখা টাইপরাইটারের খোঁজ পেয়ে গেলে সরকারি চাপে একটা সময়ে বলে দিতে বাধ্য হন। স্পয়লারটুকু না বলে পাশাপাশি আয়রনিটা বলে নেওয়া প্রয়োজন। ছবির এই কেন্দ্রীয় চরিত্রের উপর নজরদারি করা এক স্টাসি অধিকর্তার চরিত্রে থাকা অভিনেতা উলরিক মুহ-র নিজের জীবনেই ছবির গল্পের এক অদ্ভুত সমাপতন। চার বছর থিয়েটারের সহকর্মীদের এবং খোদ স্ত্রীয়ের কাছ থেকে সারভেইল্যান্সে থাকা উলরিক পরবর্তীকালে একটি ফাইল থেকে জানতে পারেন এই নির্মম সত্য। পরিণতিতে বিচ্ছেদ। ‘দ্য লাইভস অফ আদার্স’-এ উলরিকের অসম্ভব শক্তিশালী এবং মানবিক এক অভিনয়ের প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছিলেন, এমন এক প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছিল উলরিককে। প্রতিবারই তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল – ‘আই রিমেমবার্ড’। 
এবং শেষমেশ এই করুণতম সত্যের বাইরে অভিনেতা উলরিকের পরিণতি। দ্য লাইভস অফ আদার্স মুক্তি পায় ২৩ মার্চ, ২০০৬। ২০০৭-এ লস অ্যাঞ্জেলসের অস্কারপ্রাপ্তির সময়ে উলরিক পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং অবস্থা তখনই বেশ কিছুটা আশঙ্কাজনক ছিল। ২১ জুলাই ‘ডাই ওয়েল্ট’ পত্রিকায় নিজের ব্যাধি এবং অভিনয় জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে উলরিকের নিজের একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তার ঠিক পরের দিনই চলে যান মানুষটি। দ্য লাইভস অফ আদার্সের ক্যাপ্টেন গার্ড ওয়েইসলার অস্কার সিন্ডলারের মতোই কিংবদন্তি হয়ে থেকে যান বাকিটা সময়। কিন্তু চরিত্রের বাইরের মানুষটা? কতটুকু দেখে যেতে পারলেন সাফল্য? 
এই দুটি কিংবদন্তির বাইরে আরও একটি গল্প। এখানে কোনও লেজেন্ড নেই। লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র নেই। আছে বেকারত্ব, মনোটনি, শহুরে অসহায়তা, এবং করুণ এক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির রিপ্রেজেন্টেটিভ একটি ছেলে। তুরস্কের খ্যাতনামা পরিচালক নুরি সিলানের ছবির কথা বলছি। যার নেপথ্যে নুরির কাজিন এবং সহকর্মী তরুণ অভিনেতা মেহমেত এমিন টোপরাক। 
ফিল্মোগ্রাফি বলতে নুরির ছবি ‘স্মল টাউন’, ‘ক্লাউডস অফ মে’ এবং ‘ডিসট্যান্ট’। কেমন ছিল টোপরাকের চরিত্রগুলো? মফস্বল থেকে উঠে আসা একটা ছেলে যার চাকরি নেই, বলার মতো প্রেম নেই, একটি মেয়েকে হঠাৎ আকর্ষণীয় মনে হয়ে কথা বলতে গিয়ে অন্য এক স্টেবল চাকরির পুরুষের সঙ্গে তাকে দেখতে পেয়ে সরে আসা এক তরুণ। বড় কোনও পরিচালক তাকে ছবির কাজ দেবে বলে ব্যবহার করে শেষমেশ কথা রাখেননি। বাড়িতে অশান্তি, বন্ধু নেই। কাজ বলতে একা একা রেস্তোরায় ঘোরা আর সস্তার সিগারেট খাওয়া। আসলে তুরস্কের সামগ্রিক সামাজিক অবস্থা এবং তরুণ প্রজন্মের অবস্থানটা জোরালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে এই চরিত্রগুলো বেছে নিয়েছিলেন নুরি, যত্ন করে তুলে দিয়েছিলেন টোপরাককে। এবং টোপরাকের কাছে প্রাণ পেয়েছিল তারা। ২০০২ সালের ২০ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘ডিসট্যান্ট’। ছবিড় পারিশ্রমিকে একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি কিনেছিলেন টোপরাক। ২ ডিসেম্বর আঙ্কারা ফিল্ম ফেস্ট থেকে সেই গাড়ি ড্রাইভ করেই ফেরার রাতে চোখ ঘুম জড়িয়ে এসেছিল সদ্য-বিবাহিতা এই তরুণের। ফেটাল এক কার ক্র্যাশ। কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান টোপরাক। পস্থুমাস। উলরিকের মতো টোপরাকও কোথাও এসে মিলে যান। ‘ক্লাউডস অফ মে’ ছবিতে টোপরাকের চরিত্রটিকে কারখানার কাজ ছাড়িয়ে একটি চলচ্চিত্র শুটিং-এর জন্য কাজে লাগায় এক পরিচালক। পরে কথা রাখেননি। আর বড় কোনও কাজ, টাকা বা চাকরি দেননি। বাস্তব জীবনে সেরামিক ফ্যাক্টরিতে কাজ করা টোপরাক ‘ডিসট্যান্ট’ ছবিতে আগের দুবারের মতোই সাময়িক ছুটি নিয়ে জড়িয়ে পড়েন। কোথাও হয়তো অপরাধী হয়ে যান নুরি নিজেই। কাজে লাগিয়ে সেভাবে কিছুই কি দেওয়া হল না টোপরাককে? করুণ এক পরিণতি ছাড়া? 
সব মিলিয়েই সেলুলয়েড। ছবির মোহমুক্তির বাইরে সময় করে অভিনেতাদের নিজেদের গল্পগুলো ঝালিয়ে নিলে কোথাও না কোথাও বেরিয়ে আসে এইসব তারাখসা মুহূর্ত, যন্ত্রণা, অপরাধবোধের সমাপতন। সিনেমায় যেমন হয়, জীবনেও কখনও কোথাও তেমনই হয়ে যায় অগোচরে। ক্লাইম্যাক্সে বিষণ্ণতা, স্যাডনেস। ‘অ্যান্ড দ্য স্যাডনেস উইল লস্ট ফরেভার’।

More Articles