ভোজনরসিক বিবেকানন্দ, তাঁর কতটুকু তল পেয়েছে বাঙালি!

দৃশ্য একটা নয়। অনেকগুলো। বিশেষত রংবাহারি দৃশ্যদের মিছিল কখনও স্মৃতির রূপ নিয়ে আসে, কখনও জীবনের। সেই রং চুঁয়ে চুঁয়ে মাটিতে দাগ লাগে। কোথাও গৈরিক, কোথাও শ্যামল। অতি দীর্ঘ মহীরুহের গোড়ায় হাওয়ায় দোল খায় দু একটি ঘাস। অতি সাধারণ। ছায়ায় মানুষ জিরায়। ঘাসে মানুষ বসে। মহীরুহ ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও ঘাসের নরম স্পর্শ জীবনের দৌড়ে ক্লান্ত মানুষকে আশ্রয় দেয়। এরকমই শান্তি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটা মঠ। বেলা পড়ে আসে। গঙ্গার মৃদুমন্দ হাওয়া তাকে আরো স্নিগ্ধ করে, জুড়িয়ে আনে। মঠের প্রাঙ্গনে এসে বসেন এক সন্ন্যাসী। গায়ের রং ময়লা, আকার ঈষৎ স্থূল। দেখার মতো তাঁর চোখ দুটি। উজ্জ্বল ঠিক নয়। তখন উজ্জ্বলতা কমে এসেছে। সংকল্পের সবটুকু পেরিয়ে আসার তৃপ্তি সে চোখে। শরীর নিয়ে দীর্ঘদিন ভুগে চলার ক্লান্তিও খানিক উঁকি দিয়ে যায় যেন পলকে। এই সময়ে স্মৃতিরা বড় নিষ্ঠুর। কিন্তু সে নিষ্ঠুরতা তাঁর চোখের স্পর্শে মুহূর্তে আনন্দ হয়ে ওঠে। প্রাঙ্গনের একপাশে জ্বলে ওঠে উনুন। কড়া গরম হয়। তাতে তেল ঢালা হয়। যেন অবিকল সেইসব ছোটবেলার স্মৃতি। তাতে সন্ন্যাসী ফেটানো বেসন ছেড়ে আনন্দের ফুলুরি তোলেন। শুধু নিজের জন্য নয়। মঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেড়ায় তাঁর ফিরির হাঁক। সিমলাপাড়ার গলির ফুলুরিওয়ালা যেন স্মৃতি থেকে উঠে আসে অবিকল। ওম ঘনায়। চোখের যাবতীয় বিষন্নতা তখন ধুয়ে মুছে গেছে। শৈশবের বোল ধরেছে সে জরাজীর্ণ দেহে। দেহ আর কতটুকু? আত্মিক আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে মঠ জুড়ে। এইসব দৃশ্য রোজ আনাগোনা করে কোনও না কোনও বাঙালির অন্দরমহলে। তবে এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা এখন আর কেউ বেঁচে নেই। রয়ে গিয়েছে তাঁদের স্মৃতির বয়ান, আমাদের বইয়ের পাতায়, আমাদের যাপনের বাস্তবে। দৃশ্য। শুধু দৃশ্য। কখনও স্মৃতির থেকে জীবন হয়ে ওঠে।

সিমলাপাড়ার দত্তবাড়ির ছবি খানিক অন্যরকম। বিবেকানন্দের মামার বাড়ির লোকজন প্রবল বৈষ্ণব। শুধু নিরামিষ নয়, রোজ গোবর-তুলসী খাওয়ারও রেওয়াজ ছিল সেখানে। এই প্রভাব দত্তবাড়িতে অবশ্য ঢুকব ঢুকব করেও পালাতে পথ পায়নি বিশ্বনাথ দত্তের দাপটে। বিশ্বনাথ চিরকালই ভোজনরসিক। রাঁধতেও ভালোবাসতেন খুব। মাঝে মাঝেই বাড়িতে বাবুর্চি আনিয়ে মোগলাই সব খাবারদাবার তৈরি হত। খেতে বসে সেবার বালক নরেনের সঙ্গে দিদি স্বর্ণময়ীর সে কী ঝামেলা। তরকারি নাকি মাছের আঁশ হাতে ছোঁয়া হয়েছে। কিছুতেই খাবেন না নরেন। বিশ্বনাথ স্নান করছিলেন। ভাইবোনের তুমুল ঝগড়ায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে হাঁক ছাড়লেন সেখান থেকেই, “ওর চোদ্দপুরুষ গেঁড়িগুগলি খেয়ে এল, আর এখন ও সেজেছে ব্রহ্মদত্যি, মাছ খাবে না!” বাপের মন্ত্রে নরেনের দীক্ষা অনেক আগে। মেজভাই মহিম তখনও মাছ মাংস মুখে দেয় না। কিন্তু সেবার সপরিবার রায়পুর যাওয়ার পথে মহিমকে মাংস খাইয়েই ছাড়লেন নরেন। মহেন্দ্রনাথ পরে লিখছেন, “দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল– ‘খা। তারপর আর কি? বাঘ নতুন রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”

অল্প বয়স থেকেই বিবেকানন্দ শুধু খাদ্যপ্রেমী নন, সেই রস ছড়িয়ে দিতে তৎপর আশেপাশের মানুষের মধ্যেও। পুরনো ফ্রেঞ্চ রান্নার বই জোগাড় করে গড়ে তুলছেন ‘গ্রিডি ক্লাব’ সংগঠন। মহেন্দ্রনাথ কৌতুকে তার বাংলা তর্জমা করছেন–’পেটুক সঙ্ঘ’। সেখানে শুধু রান্না হত না, রান্না নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালাতেন নরেন। এই গবেষণা রয়ে গিয়েছে বিবেকানন্দের সমগ্র জীবন জুড়ে। নতুনকে জানার এই ইচ্ছায় ভর করে পুবপচ্ছিম একাকার করে ফেলেছেন তিনি রান্নার ক্ষেত্রটিতেও।

হাঁসের ডিম উত্তমরূপে ফেটিয়ে চালে মাখো মাখো করে মটর ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি করে ফেলেছেন এই বয়সেই। প্রথম দিকে কচুরি সিঙ্গাড়া অত্যন্ত ভালোবাসতেন বটে, তবে সে প্রেম তাঁর বেশিদিন টেকেনি। পরের দিকে বিবেকানন্দের লেখাতেই পাওয়া যায়, “ভাজা জিনিস গুলো আসলে বিষ। ময়রার দোকান যমের বাড়ি...খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও, সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।”

স্বামীজিকে ঠাকুর এক সময়ে সম্ভবত হুঁকোও খাইয়ে ছিলেন। উৎকৃষ্ট তামাকে আর লঙ্কায় স্বামীজির কখনও আপত্তি দেখা যায়নি। তাঁর বিচিত্র খাবার অভ্যেসের জন্য লোকে ঈর্ষা করত। একবার সেই রকম একজন ঠাকুরের কানে তুললেন, নরেন কিন্তু হোটেল টোটেলেও খায়। সে সময় হোটেলের খাবার প্রায় অচ্ছুত। রামকৃষ্ণ তেড়ে উঠলেন, “ওরে শালা তোর কি রে?......তুই শালা যদি হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি হোটেলে খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।” আরেকবার হোটেলে খেয়ে এসে নরেন ঠাকুরকে জানালেন, “আজ হোটেলে, সাধারণে যাকে অখাদ্য বলে, তাই খেয়ে এসেছি।” ঠাকুর বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলেন, “তোর তাতে দোষ লাগবে না।” সারদা মায়ের মুখেও নরেনের রান্নার খ্যাতি শোনা যায়। মায়ের স্নেহে, ঠাকুরের কৃপায় স্বামীজির খাবারের অভ্যেস আরও বিকশিত হয়েছে। বোঝাই যায় এতে রামকৃষ্ণের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও ছিল।

কোন জাতি কেমন খায়, কী তাদের আহারে রুচি–এ সমস্ত নিয়ে বিবেকানন্দ রীতিমতো গবেষণা করেছেন বলা চলে। ফরাসি, জার্মান, আমেরিকান, ইংরেজ–ধরে ধরে প্রত্যেকের দৈনিক খাদ্যরুচির বিবরণ দিয়েছেন স্বামীজি। নতুন নতুন এক্সপেরিমেণ্টেও বিবেকানন্দ সিদ্ধহস্ত। অবশ্য ফলাফল সবসময় যে খুব সুখদায়ক হত তা নয়। বিদেশে থাকতে তাঁর লঙ্কা খাওয়ার নেশায় বিদেশি ভক্তকুল প্রায়ই নাকের জলে চোখের জলে হত। আরেকবার লণ্ডনে হল এক এলাহি আয়োজন। ১৮৯৬ সালের ৩০শ মে। দেশ থেকে সারদানন্দ এসেছেন। সঙ্গে গুচ্ছের মশলা। স্বামীজির কী মনে হল জাফরান, জয়িত্রী, জায়ফল, ল্যাভেণ্ডার, কাবাবচিনি, দারচিনি, লবং, এলাচ, ক্রিম, লেবুর রস, পেঁয়াজ, কিসমিস, অ্যামণ্ড, লঙ্কা এবং চাল দিয়ে এক অভূতপূর্ব কারি রাঁধলেন। এবং তারপরেও রীতিমতো দুঃখ করছেন পরের দিন মেরির কাছে, অ্যাসাফিটিডা (হিং) পাওয়া গেল না। একটু মেশালে ভালো হত। আরেকবার খেজুরের রসে চাল ফুটিয়ে ভাত করেছিলেন। সে অবিশ্যি দেশে। বেশ খানিকটা পরে। এক ভক্ত রোজ সকালে এক কলসি টাটকা খেজুরের রস দিয়ে যেত। অতটা রস ফেলে দেবেন? তার থেকে একদিন করে ফেললেন ঐ খেজুরে-ভাত। সে এক্সপেরিমেণ্টের ফল মন্দ হয়নি বলেই মনে হয়।

বিদেশে আদর যত্ন পেয়েছিলেন প্রচুর। মাটন, কফি, টোস্ট, পোচ মায় ঝিনুকও। তবে এতকিছুর মধ্যেও দেশি খাবারের স্বাদ গ্রহণ ও সেই রসের প্রচার যে তাঁর অক্ষুণ্ণ তা বোঝা যায় চিঠিপত্রে।  ত্রিগুণাতীতানন্দকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জানাচ্ছেন, “মুগের ডাল তৈয়ার হয় নাই মানে কি? ভাজা মুগের ডাল পাঠাইতে আমি পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি। ছোলার ডাল ও কাঁচা মুগের ডাল পাঠাইতে বলি। ভাজা মুগ এতদূর আসিতে খারাপ ও বিস্বাদ হইয়া যায়, সিদ্ধ হয় না। যদি এবারও ভাজা মুগ হয়, টেমসের জলে যাইবে। ও তোমাদের পণ্ডশ্রম। আমার চিঠি না পড়িয়াই কাজ কেন কর? চিঠি হারাও বা কেন? যখন চিঠি লিখিবে, পূর্বের পত্র সম্মুখে রাখিয়া লিখিবে। তোমাদের একটু বিজনেস বুদ্ধি আবশ্যক।”

দেশ থেকে  আমতেল, আমসি, আমসত্ত্ব, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলাদি আসছে। এই পর্বে ভারতীয় মশলা বিদেশে রপ্তানি করা নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন। যেখানেই যেতেন নানারকম মশলাপাতি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সেই সব মশলা পিঁড়িতে বসে নিজে গুঁড়িয়ে নিতেন। তারপর চলত রান্না। একবার প্রচণ্ড অসুস্থ। পা ফুলে গিয়েছে। কবিরাজ নিদান দিলেন একুশটি দিন জল না খেয়ে থাকতে হবে। তরল বলতে মাঝেমধ্যে একটু আধটু দুধ চলতে পারে। তার ওপর রবিবারে আমিষ হয় না মঠে। এক ভক্ত সে সব না জেনেই একটি রুই মাছ নিয়ে হাজির। ঐ অবস্থায় কারো কোনও ওজর আপত্তি কানে না তুলে দুধ, দই, ভারমিসেলি ইত্যাদি দিয়ে চার পাঁচ ধরনের রান্না করে ফেললেন। নিজে খেলেন না এক ফোঁটাও। সবাইকে খাওয়ালেন। ভারমিসেলি কী লোকে জানতে চাওয়ায় রসিকতা করে বলেছিলেন, “ওগুলি বিলিতি কেঁচো। আমি লণ্ডন থেকে শুকিয়ে নিয়ে এসেছি।”

আরও পড়ুন-কল্পতরু রামকৃষ্ণের সামনে সেদিন কেঁদে ফেলেছিলেন গিরিশ

আম আর আঙুর খেতে পছন্দ করতেন খুব। এ নিয়েও নানা গল্প রয়েছে। একবার তো গিরিশ ঘোষের সঙ্গেই হয়ে গেল ফাটাফাটি। বলরামবাবুর উত্তরকলকাতার বাড়িতে সেবার পাশাপাশি পাত পড়েছে গিরিশ ঘোষ  আর নরেনের। ভাগ্যক্রমে গিরিশ একের পর এক মিষ্টি আমগুলো পাচ্ছেন, আর নরেনের পাতে সব টক। তাতে নরেন চটে গিয়ে বলেন, “শালা জিসি তোর পাতে যত মিষ্টি আম, আর আমার পাতে টক! নিশ্চয়ই তুই শালা বাড়ির ভিতর গিয়ে বন্দোবস্ত করে এসেছিস।” গিরিশ তখন বললেন, “আমরা গৃহী সংসারী, আমরাই মজা মারবো, তুই শালা সন্ন্যাসী-ফকির হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবি, তোদের কপালে তো শুটকো টোকোই জুটবে।” এই ধরনের রঙ্গ তামাশা দুজনে দেখা হলেই চলত। একবার বড় জাগুলিয়ায় বোনের বাড়ি থেকে কালো জাম এনে সেই রস বোতল বন্দি করলেন। দড়ি বাঁধা সেই বোতল রান্না ঘরের পাশে রোদ খেয়ে সাত-আটদিনের মাথায় দুম করে ফেটে গেল। রস তখন তেজি হয়েছে। বিবেকানন্দ এই হজমি সিরকা সবাইকে রোজ খেতে বললেন। নোয়াপাতি ডাবের মধ্যে বরফ এবং চিনি ঢেলে খেতেন রসিয়ে রসিয়ে। তবে ফল যতই পছন্দ হোক পেয়ারা ব্যাপারটা যারপরনাই অপছন্দের ছিল স্বামীজির।

লঙ্কা এবং ঝাল খাওয়া নিয়েও এমন নানা তথ্য পাওয়া যায়। একবার তো নেমেই পড়লেন লঙ্কা খাওয়ার প্রতিযোগিতায়। আরেকবার হৃষিকেশে সবে গুরুতর অসুখ থেকে উঠেছেন। একটু খিচুড়ি সেবার ইচ্ছে হয়েছে। ওই জঙ্গলে কোথায় চাল আর কোথায় ডাল। যা হোক, অনেক কষ্টে সব জোগাড় হল। প্রিয় গুরুভাই রাখাল খিচুড়ি রাঁধলে। কিন্তু স্বাদ মোটেও পোষাচ্ছে না স্বামীজির। ব্যাপারখানা কী? শেষে খিচুড়ি থেকে একখান সুতো বেরলো। এইবার স্বামীজির সন্দেহ হল। খিচুড়িতে সুতো কেন? সকলে রাখালকে দেখিয়ে বললে, রাখাল এক ডেলা মিছরি ফেলেছে যে। তখনকার দিনে মিছরিতে এক আধটা সুতো থাকত। ব্যস। আর যায় কোথা। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস! দুঃ শালা। খিচুড়িতে কখনও মিষ্টি দেয় রে? তোর একটা আক্কেল নেই!” স্বাদের ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন। আর হবেন নাই বা কেন। খেতে ভালোবাসতেন খুব। সেই মানুষটার জীবনের বেশিরভাগ কাটল অনাহারে, অর্ধাহারে, পথে পথে বেড়িয়ে। দিনের পর দিন এক কণা ভাত জোটেনি এমন দিনও গিয়েছে।

যাপনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবোধটা তাঁর কাছে  ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলতেন, যে কাজই হোক খুব মনোযোগের সঙ্গে করা চাই, রান্নাটাও যে ভালো করে করতে পারে না, সে সাধু হতে পারবে না কখনও, শুদ্ধ মনে না রাঁধলে খাদ্যদ্রব্য সাত্ত্বিক হয় না। সেই কারণেও স্বাদ নিয়ে খুঁতখুঁতানি তাঁর থাকা স্বভাবিক। সবথেকে পছন্দের খাবার ছিল শুক্তো-মোচার ডালনা আর ইলিশ-পুঁইশাক। পুঁইশাক খাওয়ানোয় গোয়ালন্দের পথে এক পুঁইবাগানের মালিককে দীক্ষা পর্যন্ত দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। আবার মা-দিদিমার হাতে শুক্তো-মোচার ডানলা খেয়ে বলে গিয়েছেন, “বাংলা দেশে এই দুটোর জন্যে আবার কিন্তু জন্ম নেওয়া যায়।” প্রবাসে থাকার কালে অত্যন্ত পছন্দ করতেন আইসক্রিম। প্রায়ই খেতেন, বলতেন দেবভোগ্য খাবার। কিন্তু শেষের দিকে সেটাও ছাড়তে হয় সুগারের কারণে। এইরকম নানা অতি সাধারণ স্বাদ ও গল্প মিলে মিশে এক রসিক খাদ্যপ্রেমী বিবেকনন্দকে আমরা পাচ্ছি, যিনি শুধু বেদান্ত নয়, তার সঙ্গে বিরিয়ানিরও প্রচার করেছেন পশ্চিমে জোর কদমে।

দৃশ্যের পরে দৃশ্য। কয়েকটা যোগচিহ্নমাত্র। সার দিয়ে স্মৃতিরা কোথাও জীবন হয়ে উঠছে, কোথাও জীবনেরা স্মৃতি। মহাজীবনের মহাসমুদ্রের কিছু ঢেউ তীরে ফিরে আসছে সাধারণের কাছে, সাধারণের নাগালে। শেষবেলার আহিরীটোলা ঘাট। গঙ্গার জল রক্তাক্ত। সেই অনাহারক্লিষ্ট অসম্মানে অবহেলায় জর্জরিত সন্ন্যাসী হাঁটছেন মৃদু গতি। এ সময় গঙ্গার বুক থেকে বাতাস ওঠে। হাওয়ায় মাথার চুল খানিক অবিন্যস্ত। চোখের নীচে অতল চিন্তাপ্রবাহ। সে বুকের উথাল-পাথাল ঘাটের লোকে কি টের পায় গো? সন্ন্যাসী মানুষ। সমস্ত সয়ে যান নীরবে। মঠের পরিবেশ খুব একটা ভালো না। যাকে তাকে বকে ফেলছেন সহজেই। ভারী মনের হাওয়া বুঝি বা গঙ্গায় খানিক শুদ্ধ হয়ে আসে। সত্যিই কি? গ্লানি কাটানো এতই কি সহজ? সমস্ত কিছুকে প্রশ্ন করার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারলেন না। আর বেশিদিন নয়। অথচ কত কিছু করা বাকি রয়ে গেল। ভারতের প্রতিটি অভুক্ত মুখে খাবার তুলে দেওয়া হল কই? বেদান্তের আগে খাবার প্রয়োজন। ভরপেট খাওয়া। ভাতের গন্ধে সেই সব দরিদ্রের খুশির কলরোল। এমন গঙ্গার মৃদু ঢেউয়ের মতোই আওয়াজ তোলে বুঝি তা। দেখা হল এক শিষ্যের সঙ্গে। সন্ন্যাসী বাঁহাতের শালপাতায় ভরা চানাচুর ভাজা এগিয়ে দিলেন। “চারটি চানাচুর ভাজা খা না? বেশ নুন ঝাল আছে।” রোজের মতো বিকেল পেরিয়ে আলো কমে আসছে। শিষ্যকে এই সামান্যতম প্রসাদটুকু দিয়ে, আরো চারটি দাঁতে কাটতে কাটতে সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে মঠের দিকে চলেছেন। সেই শিষ্য, আশেপাশের সেই গাছপালা, বিকেলে প্রমোদ ভ্রমণে আসা লোকজন, সেই হাওয়া, সেই গঙ্গা—কেউই জানল না আসন্ন রাত্রির কথা। আলো ক্রমে নিবে আসছে। এরপর নিবিড় আঁধার। মহাসমাধি। যদিও বিশ্বাসে জন্মান্তর আছে। দেহটুকুই সব নয়। তবু, বিচ্ছেদ তো বটেই। কেবলই স্মৃতি ও জীবনের লেনদেন, কেবলই জন্ম ও মৃত্যুর আনাগোনা। হয়তো এই স্রোতই পুনর্জন্ম। মহীরুহের ছায়ায় যতদূর নিবিড় ঘাস, ততদূর শান্তিমাখা মমত্বমাখা ধুলোর এ ছোঁয়াচটুকু মানুষের সঙ্গে রয়ে যাবে।

 

তথ্যঋণ-

“Swami Vivekananda Taught Us to Discard Religious and Caste Based Discrimination Dgtl - Anandabazar.” n.d. Accessed November 30, 2021. 

“এক নজরে দেখে নিন খাদ্য-রসিক স্বামী বিবেকানন্দের অজানা কথা - Bengali Oneindia.” n.d. Accessed November 30, 2021.

অচেনা অজানা বিবেকানন্দ—শংকর

More Articles