প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথায় সুর দিয়েছেন শচীন থেকে সুধীন, তবু অন্তরালেই গীতিকার

Premendra Mitra: ‘প্রতিশোধ’ (১৯৪১) সিনেমায় শচীন দেববর্মনের সুরে ‘‘জানি না কোথায় আছি— রাশিয়া কিংবা রাঁচি” (শিল্পী: রমলা দেবী) গানটি লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র

তেলেনাপোতা আবিষ্কারের যাত্রা কখন যে ঘনাদার হাত ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের গল্প বাঙালির বৈঠকখানাকে দখল করেছে তার হদিশ মেলে না। দেশভাগ, মন্বন্তরের ছবি এঁকেছেন তিনি তাঁর শব্দের জাদু কাঠি দিয়ে। জ্ঞান আর গুণের সংমিশ্রণ ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যজগতের অত্যন্ত পরিচিত মুখ ও খ্যাতনামা সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি ছিলেন কল্লোল যুগের প্রতিভূ। বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিপুল অবদান। কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, কল্পবিজ্ঞান, গোয়েন্দা কাহিনির রচয়িতা প্রেমেন্দ্র। অনেকেই জানেন না, বহু বিখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রের গীতিকারও ছিলেন তিনি। ঘনাদা ছাড়াও পরাশর বর্মা, মেজকর্তার মতো কিছু অবিস্মরণীয় চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। গত ৪ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ১১৮তম জন্মদিন। কিন্তু বাঙালি আজ কতটা মনে রেখেছে ঘনাদার স্রষ্টাকে? কেন অসামান্য সমস্ত গান লিখেও সঙ্গীত জগতে আড়ালেই রইলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র?

১৯০৪ সালে ৪ সেপ্টেম্বর বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরে তাঁর আদি নিবাস ছিল। যদিও তাঁরা ছিলেন কোন্নগরের সম্ভ্রান্ত মিত্র বংশ। তাঁর মা ছিলেন সুহাসিনী দেবী, বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু ছোটগল্প দিয়েই। মানুষের সম্পর্কের ভাঙাগড়া, মানবমনের জটিলতা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যথাবেদনার আঁতের কথা নতুন ভাবে ও ভঙ্গিতে অনন্য স্বকীয়তায় প্রকাশ করলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সাল ১৯২৩, কলকাতার গোবিন্দ লেনের একটি মেসে থাকতে শুরু করেন তিনি এবং প্রথম ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প ‘শুধু কেরানী’।

পরবর্তীতে ‘গোপনচারিণী’ গল্পটিও প্রকাশিত হয়। আর এই দুই গল্পই তাঁকে সাহিত্য প্রাঙ্গণে এক আলাদা জায়গা করে দিয়েছে। এরপর একে একে গল্পের পাশাপাশি কবিতা লিখতে শুরু করেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রথম জীবনে ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’ ছদ্মনামে লিখতেন। তারপর কল্লোল পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯২৬ সালে মুরলীধর বসুর অনুরোধে ‘কালিকলম’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন তিনি।

আরও পড়ুন-সিনেমার নিন্দে করে জুটেছে প্রযোজকের মারও, বাঙালি মনে রাখেনি মৃগাঙ্কশেখর রায়কে

তাঁর বিখ্যাত ছোট গল্পসংকলনগুলি হল- ‘বেনামী বন্দর’, ‘পুতুল ও প্রতিমা’, ‘পুন্নাম’, ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’। প্রেমেন্দ্র তাঁর প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্পের বই ‘পুতুল ও প্রতিমা’ উৎসর্গ করেন শিবরামকে। সেই প্রসঙ্গে শিবরাম লিখছেন, “অনেকদিন পরে ‘পুতুল ও প্রতিমা’র দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেট থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে...”। প্রেমেন্দ্র মিত্রই মনে হয় প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক যিনি নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান বা বিজ্ঞান-ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। ‘পিঁপড়ে পুরাণ’ তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞানকে ভিত্তি করে লেখা। ‘কুহকের দেশে’ গল্পে তাঁর কল্পবিজ্ঞান ও অ্যাডভেঞ্চার কাহিনির নায়ক ‘মামাবাবু’র আত্মপ্রকাশ। ১৯৪৮ সালে ‘ড্রাগনের নিঃশ্বাস’ প্রকাশিত হলে মামাবাবু পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘প্রথমা’। তারপর একে একে তিনি বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তবে আজও তাঁর ‘ফেরারি ফৌজ’, ও ‘সাগর থেকে ফেরা’ পাঠককে ছুঁয়ে যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো এত জ্ঞানী ও সৃজনশীল মানুষের কদর আজ কতটা রয়েছে সেই প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়ে যায় মনে। তবে তাঁর লেখা এই বর্তমান সমাজেও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। কবিতা, গল্পের পাশাপাশি লিখেছেন প্রেমেন্দ্র লিখেছেন বহু গান।

পরিচালক চারু রায়ের অনুরোধে তিনি প্রথম চিত্রনাট্য লিখলেন ‘গ্রহের ফের’ (১৯৩৭) ছবিতে। অতঃপর ফিল্ম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার ‘রিক্তা’ (১৯৩৯) ছবিতে পেলেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনার কাজ। এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধে গান লেখেন প্রেমেন্দ্র। এই সিনেমাতে তাঁর লেখা বিভিন্ন গান ভীষ্মদেবের চমকপ্রদ সুরে এবং অভিনেত্রী-গায়িকা রমলা দেবীর কণ্ঠে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয়। গানগুলি হল: ‘চাঁদ যদি নাহি উঠে’, ‘আরও একটু সরে বসতে পার’।

আরও পড়ুন- ফিতের ফাঁদে ‘বিকাশ’! উদ্বোধনের প্রতিযোগিতায় নাস্তানাবুদ সরকারের দেশ

এরপর ১৯৬০ পর্যন্ত সমসীমায় নানা ছবিতে গান লিখেছেন প্রেমেন্দ্র। তাঁর লেখা কয়েকটি অসামান্য গান: ‘প্রতিশোধ’ (১৯৪১) সিনেমায় শচীন দেববর্মনের সুরে ‘‘জানি না কোথায় আছি— রাশিয়া কিংবা রাঁচি” (শিল্পী: রমলা দেবী), ‘যোগাযোগ’-এ (১৯৪৩) কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘‘যদি ভাল না লাগে”, ‘‘হারা মরু নদী” (শিল্পী: কানন দেবী), ‘‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি” (শিল্পী: রবীন মজুমদার), ‘সাধারণ মেয়ে’ (১৯৪৮) সিনেমায় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘‘দাঁড়াও না দোস্ত” (শিল্পী: ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য), ‘হানাবাড়ি’ (১৯৫২) ছবিতে পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘‘হাওয়া নয় ও তো হাওয়া নয়”, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ (১৯৬০) সিনেমায় নচিকেতা ঘোষের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘‘এ শহরে সবই বিকায়” ও ‘‘শরীরখানা গড়ো” প্রভৃতি।

সম্ভবত তাঁর মাত্র তিনটি গানের সন্ধান এখনও অবধি পাওয়া যায়। জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর ১৯৬৪-তে লিখেছিলেন— ‘‘নেহরু অমর” ও ‘‘সেই দিশারী” যার সুরকার ছিলেন শিল্পী শ্যামল মিত্র। শ্যামল মিত্রই তাঁর লেখা একটা গান রেডিওর রম্যগীতিতে গেয়েছিলেন ‘‘চেয়েই বারেক দ্যাখো না”।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের অসাধারণ কিছু কবিতাও সুর পেয়ে গানে পরিণত হয়েছে। যেমন ‘সাগর থেকে ফেরা’, যেখানে শিল্পী ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সুর দিয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত, ‘আমি কবি যত কামারের’ ও ‘অগ্নি-আখরে আকাশে যাহারা’পবিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুরে গেয়েছেন শিল্পী সবিতাব্রত দত্ত। ‘আমায় যদি হঠাৎ কোনও ছলে’গেয়েছিলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে।

 

ঋণ ও তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।

বাংলা কবিতার কালান্তর, সরোজ বন্দ্যোপধ্যায়।

More Articles