সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন এই মুসলিম মহিলা! কেমন ছিলেন মুঘল যুগের প্রভাবশালী নারীরা?

গুলবদন বেগমের গল্প বলার শক্তিতে আকবর এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বাবা হুমায়ুনের জীবন ও শাসনকাল নিয়ে বই লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন গুলবদন বেগমকে।

ভারতীয় ইতিহাসে মুঘল ঘরানা বিভিন্ন কারণেই স্মরণীয়। আকবরের মতো প্রজাদরদি সম্রাট থেকে ঔরঙ্গজেবের গোঁড়ামি সবটাই মুঘল ইতিহাসের এক একটা অধ্যায়। কেবল সম্রাটই নন, মুঘল জমানায় পিছিয়ে ছিলেন না বেগমরাও। নিজেদের বুদ্ধি, শিক্ষায় তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন শাসনকার্য চালানোর নেপথ্য চালিকা শক্তি। এমনই কয়েকজন মুঘল সম্রাজ্ঞীকে ফিরে দেখা যাক।

দৌলত বেগম

সম্পর্কে প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের পিতামহী আইসান দৌলত বেগম ছিলেন চাগাতাই খানের পূর্বপুরুষ ইউনুস খানের প্রথম স্ত্রী। ১৪৯৪ সাল থেকে ১৫০৫ সালের মধ্যে দৌলত বেগম ছিলেন নাতির সাম্রাজ্য পরিচালনার মূল উপদেষ্টা। তাঁর সাহসী, আত্মনির্ভর ব্যক্তিত্ব বাবরের চরিত্র নির্মাণে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। দৌলত বেগম বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, একাধিকবার ধরাও পড়েছেন শত্রুর হাতে। কিন্তু তাঁর বিচক্ষণতা ও ক্ষিপ্রতা প্রত্যেকবারই তাঁকে শত্রুর হাত থেকে সযত্নে রক্ষা করেছে।

গুলবদন বেগম

প্রথম মুঘল সম্রাট বাবরের কন্যা ছিলেন গুলবদন বেগম। কিন্তু এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। বিভিন্ন কারণেই লেখাপড়া শেখা হয়ে ওঠেনি সম্রাট আকবরের। কিন্তু তাঁর জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। নিজে লিখতে পড়তে না পারলেও গুণীর সমাদর করতেন সম্রাট আকবর। পিসি গুলবদন বেগমের গল্প বলার ভঙ্গি ছিল আকবরের বিশেষ প্রিয়। গুলবদন বেগমের গল্প বলার শক্তিতে আকবর এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বাবা হুমায়ুনের জীবন ও শাসনকাল নিয়ে বই লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন গুলবদন বেগমকে। মুঘল আমলের ইতিহাস জানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল ‘হুমায়ুন নামা’ লিখেছিলেন গুলবদন বেগম।

আরও পড়ুন- সত্যিই রয়েছে রক্তচোষারা! গলায় কাস্তে বাঁধা মহিলা ‘ভ্যাম্পায়ারের’ কঙ্কাল ঘিরে ঘনাচ্ছে রহস্য

হামিদা বানু বেগম

মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের রানি হামিদা বানু বেগম ছিলেন একজন শিক্ষিত বুদ্ধিমতী মহিলা। সম্রাট আকবরের জমানায় তাঁকে মরিয়ম মাখানি এবং পদশাহ বেগম উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়। মেওয়ারের রামায়ণ লেখা হওয়ার বহু আগে ছেলে আকবরের উৎসাহে সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন হামিদা বানু। ফারসি ভাষায় মায়ের অনূদিত রামায়ণ বিভিন্ন দেশে বিলি বণ্টনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট আকবর। শুধু তাই নয়, পুত্র আকবর ও তাঁর ছেলে সেলিমের মধ্যেকার মনোমালিন্য মেটানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা নিয়েছিলেন হামিদা বানু।

মহাম আঙ্গা

মুঘল পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক না থাকলে ও নিজের পরিচালন শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার জোরে চিরকাল মুঘল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মহাম আঙ্গা। ঐতিহাসিকদের মতে, কিশোর আকবরের বেড়ে ওঠার পিছনে মহাম আঙ্গার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কিশোর আকবরের সঙ্গে তাঁর গুরু বৈরম খানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মহাম আঙ্গা। বৈয়ম খানের মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হন আঙ্গা। হয়ে ওঠেন মুঘল আমলের অন্যতম ক্ষমতাশালী নারী।

যোধা বাই

মরিয়ম উজ জামানি ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রিয়তম পত্নী। ইতিহাস তাঁকেই চেনে যোধা বাই নামে। রাজপুত কন্যা যোধা বাই মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এমন একজন হিন্দু নারী যিনি ৪৩ বছর ধরে একটানা মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন। আকবরের দরবারে ছিল তাঁর নিত্য যাতায়াত। শুধু যাতায়াতই নয়, আকবরের দরবারে যে কোনও কাজে নিজের মতামত দেওয়ার ও অংশগ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল যোধা বাইয়ের। এত বছর আগেও নিজের মনের জোর ও বুদ্ধিমত্তায় জনসমক্ষে ছিল তাঁর অবাধ যাওয়া আসা।

নূর জাহান

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের ২০ তম এবং প্রিয়তম স্ত্রী ছিলেন বেগম নূর জাহান। আফিম ও মাদকাসক্ত সম্রাট জাহাঙ্গিরের রাজকর্মে তেমন মনোযোগ ছিল না। স্বামীর উদাসীনতা দেখে রাজ দরবারের হাল ধরেছিলেন নূর জাহান। নূর জাহানের সুপারিশেই নূর জাহানের বাবা ও ভাই জাহাঙ্গিরের দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন। এই তিনজনই জাহাঙ্গিরের সাম্রাজ্যের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। স্ত্রীকে জাহাঙ্গির এতটাই ভরসা ও বিশ্বাস করতেন যে তাঁর আমলে সব থেকে বেশি ক্ষমতার অধিকার তিনি দিয়েছিলেন তাঁর আদরের পত্নী নূর জাহানকে।

মুমতাজ বেগম

পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য তাজমহলের সঙ্গে অক্ষয় হয়ে আছে মুমতাজ বেগমের নাম। ১৬২৮ সালে সিংহাসনে বসে মুমতাজকেই নিজের প্রিয়তম স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন সম্রাট শাহাজাহান। মুমতাজের অকাল মৃত্যুর আগের তিন বছর তিনিই সম্রাটের কাছ থেকে ‘হজরত’ সম্বোধন লাভ করেন। মুঘল সম্রাটদের প্রত্যেক স্ত্রীই নিয়মিত মাসিক ভাতা পেতেন। রাজকর্মের সমস্ত বিষয় নিয়েই বেগম মুমতাজের সঙ্গে আলোচনা করতেন শাহাজাহান। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে সম্রাটকে নিয়মিত পরামর্শ দিতেন মুমতাজ বেগম। তিনিই ছিলেন সম্রাটের মুখ্য পরামর্শদাতা।

আরও পড়ুন- ৫০০০ গাড়ি চুরি, খুন! তাক লাগাবে ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি চোরের জীবনযাপন

জাহানারা বেগম

মুঘল ইতিহাসে যে কয়েকজন মহিলার নাম অমর হয়ে আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সম্রাট শাজাহানের কন্যা জাহানারা বেগম। শাহজাহানের শেষ জীবনেও তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাহানারা বেগম। পিতার মৃত্যুর পর বোন জাহানারাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে রাজ দরবারে ফিরিয়ে এনেছিলেন পরবর্তী মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী ঔরঙ্গজেব বোনের বুদ্ধিমত্তা ও পারদর্শিতাকে কোনোদিনই অসম্মান করার সাহস দেখাননি। সম্রাট শাহাজাহানের শাসনকাল শেষে যে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন জাহানারা নিজগুণে তাই পুনরুদ্ধার করেছিলেন তিনি।

রোশনারা বেগম

মুঘল সম্রাট শাহাজাহান ও মুমতাজ বেগমের কন্যা ছিলেন রোশনারা বেগম। শাহাজাহানের পর তাঁর তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেবকে সিংহাসনে বসানোর ক্ষেত্রে রোশনারা বেগমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজীবন অবিবাহিত রোশনারা ছিলেন কবি। পিতার মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকেও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতেন এই স্বাধীনচেতা, বুদ্ধিমতী মহিলা।

More Articles