লুক্সেমবার্গ থেকে‌ প্যালেস্তাইনের গেরিলা || ছাঁচভাঙা মেয়েদের গল্প...

সালটা ১৯১৯, রোসা  নামে  এক সাতচল্লিশ বছর বয়সী মহিলার মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হল বার্লিনের ল্যান্ডওয়ের ক্যানালে। তার আগে অবশ্য বন্দুকের বাঁট দিয়ে মেরে তাঁর মাথাটা ঝাঁজরা করে দিয়েছিলেন জার্মানির ফ্রায়ারকপসরা। দক্ষিণপন্থী ফাসিস্ট’দের হাতে সেদিন শহিদ হয়েছিলেন রোসা। রোসা লুক্সেম্বুর্গ, ভ্লাদিমির লেনিনের সঙ্গে যিনি তর্কযুদ্ধে নামতে এক বিন্দুও দ্বিধা বোধ করতেন না। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। বামপন্থী’দের ঘরে ঘরে মার্ক্স, লেনিনের পাশে জায়গা করে নিয়েছে মাও সে তুং বা চে গেভারার ছবি। কিন্তু জার্মানির এই বীর শহীদকে অনেকেই মনে রাখেননি। ইতিহাসের পাতায় তিনি যেন এক বিস্মৃত অধ্যায়। ১৯৮৯ সালে জার্মানির কোলন শহরে থাকাকালীন কবীর সুমন তাঁকে নিয়ে গান লেখেন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও।’ রোসার এক বিখ্যাত উক্তিকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল এই গান। ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের দিন আমরা স্মরণ করব রোসা-র মতো এমন কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে, যাঁরা পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত স্টিরিওটাইপ ভাঙতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

প্রথমেই আসা করা যাক এলডা নেইস মসকেরা-র গল্পে। কলোম্বিয়া-র কুরুলাও নামক এক গ্রামে জন্ম হয়েছিল এলডা-র। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছিলেন তখন তাঁর বাবা লিওপোলডিনো মসকেরা তাঁকে পড়াশুনো ছাড়িয়ে দেন। লিওপোলডিনো-র সাফ বক্তব্য ছিল, ‘সেই তো বড় হয়ে গৃহবধূ হবে। তার জন্য এর চেয়ে বেশি পড়াশুনো না করলেও চলবে।’  ছোটবেলা থেকেই এলডা-র স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে নার্স হওয়ার। বাল্যকালে বিদ্যাচর্চা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে স্বপ্নে ইতি পড়ল। এবার তিনি স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টি-র সংস্পর্শে এলেন। সেখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু। এলডা-র যখন ষোল বছর বয়স, তখন তিনি ‘রেভলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অফ কলোম্বিয়া’-তে যোগ দেন। অচিরেই তাঁরা তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কে জানত, এককালে গ্রামের হাটে ভুট্টার রুটি বিক্রি করে বেড়ানো সেই মেয়ে কালে কালে হয়ে উঠবেন একজন দুর্ধর্ষ গেরিলা? এলডা থেকে তিনি ‘কারিনা’ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর দলের সকলে ওই নামেই  চিনতেন তাঁকে। কারিনা-র ত্রাস দিকে দিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে রাষ্ট্র বাধ্য হয়ে ঘোষণা করে, ‘যে এই মেয়েকে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে এক লক্ষ ডলার পরস্কার দেওয়া হবে।’ পরবর্তীকালে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে কারিনা বলেছিলেন যে তিনি মানুষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে যাননি। তাঁর গেরিলা হয়ে ওঠার কারণ ছিল একটাই। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রকে উচিত শিক্ষা দেওয়া।

শুধু বিদেশে নয়, খোদ ভারতবর্ষেও কারিনার মতো এমন অনেক মহিলা স্থানীয় মানুষজনের চোখে রবিন হুড হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে গোড়াতেই ফুলন দেবীর নাম করতে হয়। ফুলনের জন্ম হয়েছিল উত্তর ভারতের এক ছোট্ট গ্রামে। বাল্যকালেই বাবা মা তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। স্বামীর কাছে একাধিকবার ধর্ষিতা হওয়ার পর তিনি এক ডাকাত দলের সঙ্গে পালান। শুরু হয় নতুন জীবন। সে দলের এক সদস্যের নাম ছিল বিক্রম মল্লাহ। পরবর্তীকালে এই বিক্রমের সঙ্গেই তাঁর প্রেম হয়েছিল, কিন্তু বাঁধ সাধল জাতিভেদ প্রথা। বিক্রমের সঙ্গে ফুলনের জাতে মিলত না, আর সেই নিয়েই দলের ভেতর শুরু হল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। অবশেষে বিক্রম খুন হলেন, বিজয়ীরা ফুলন-কে ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখল। তারপর শুরু হল অত্যাচার। আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্রমের বিরোধী গোষ্ঠীর সদস্যরা ফুলন-কে পালা করে ধর্ষণ করেছিল। তারপর ফুলন সেখান থেকে কোনোরকমে পালান। ‘ডাকাত’ শব্দটা শুনলেই আমাদের কানে ভাসে রবি ঠাকুরের সেই লাইন, ‘হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকরা চুল।’ বস্তুত, পুরুষ ছাড়া ডাকাতের চিরাচরিত ইমেজকে আমরা কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু ফুলন দেবী যেন আবহমান কাল ধরে চলতে থাকা সেই প্রথার বিরুদ্ধে এক জলজ্যান্ত বিদ্রোহ। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি ডাকাতির পেশা ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু হাতে বন্দুক ধরে, গলায় গুলির মালা জড়িয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে যে আলোড়ন তিনি তুলেছিলেন, তা ভোলার মতো নয়।

ফুলন ছাড়াও ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছেন অজস্র মহিলা, যাঁরা লাল পতাকার চাঁদের কাস্তেতে শান দেওয়ার কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। সংবাদপত্রের পাতা ঘাঁটলে জানা যায় গাদচিরোলি-র কমরেড তারক্ক-র কথা। গাদচিরোলি-র প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে আশির দশকে গ্রামবাসীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার চালাতেন বন দপ্তরের বড়সাহেবরা। যে অরণ্যে আদিবাসীদের অগ্রাধিকার, সেখানকার সম্পদ ব্যবহার করতে গেলে  এ সমস্ত বন বিভাগের কর্মীদের বিপুল পরিমাণে ঘুষ দিতে হত। এ ছাড়াও আদিবাসী মহিলাদের উপর তাঁরা অকথ্য নির্যাতন চালাতেন। তারক্ক ছোট থেকে এমন নানান ঘটনা দেখতে দেখতে বড় হয়েছিলেন। কিন্তু একটা সময়ের পর তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন মাওবাদীদের দলে। ২০০৮-২০০৯ সাল নাগাদ রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘর্ষের একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সেই আশির দশকে  তাঁর বিপ্লবী জীবনের শুরুওয়াত। তারপর থেকে তিনি কোনোদিনই গরিব খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনও পথে যাওয়ার কথা ভাবেননি। এ ছাড়াও আছেন প্যালেস্তিনিয়ান মহিলা গেরিলারা, যাঁরা প্ল্যালেস্তাইনের মুক্তির দাবিতে নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই জারি রেখেছেন।

পৃথিবী জুড়ে  মহিলা যোদ্ধারা শুধুমাত্র যে রাষ্ট্রের বিরোধিতাই করে গেছেন এমনটা নয়। সমীক্ষা বলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে-র হয়ে লড়াই করেছিলেন প্রায় আট লক্ষ মহিলা যোদ্ধা। নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে সাহসের সঙ্গে তাঁরা অক্ষ-শক্তির  বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। অতএব দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মহিলারা যেমন বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছেন, তেমনই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে নিজেদের বিরত্ব প্রদর্শন করেছেন। মাও সে তুং বলেছিলেন, ‘নারীরা থাকবে জুড়ে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ।’ আজকের দিনে পৃথিবীর সকল দেশের অর্ধেক আকাশ জুড়ে থাকা সেই সংগ্রামী নারীদের কুর্নিশ। 

More Articles