দুঃখসাধনের নীলিমা, তাঁর চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া হলো না...

আবু সৈয়দ আইয়ুবের রোগশয্যা পাশে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে চলেছেন নীলিমা সেন, আমাদের বাচ্চুদি। পার্কসার্কাসের পাঁচ  নম্বর পার্ল রোডের কেবলমাত্র একটা ফ্ল্যাট নয়। গোটা বাড়িটাই যেন তাঁর গানের শান্ত সমাহিত অনন্তমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে । মনে হচ্ছে যেন জীবন-মৃত্যুর সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে, এই বুঝি আইয়ুবের পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসবেন নীলিমা সেনের আলিদা,  সৈয়দ মুজতবা  আলী।বাচ্চুদি গাইছেন, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনার গান ।গুরুদেবের   গানগুলি যেন সীমাকে অতিক্রম করে, এক অসীমের পানে মানুষের মনকে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে গেলে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই পূজা, প্রকৃতি পর্যায়ের গানগুলির আকর্ষণ সবথেকে বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁর  বাচ্চুর কাছে আইয়ুব অনুরোধ করেছেন;  রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনার গান গাইবার জন্য। নীলিমার কাছে আইয়ুবদার অনুরোধ যেন আদেশ। তাই একের পর এক নীলিমা গেয়ে চলেছেন; মম দুঃখের সাধন, দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল যে, দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে, তাল ছাড়া গাইলেন; বনে যদি ফুটলো কুসুম নেই কেন সেই পাখি নেই কেন। বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে, ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিমায় আইয়ুর শুনে চলেছেন।অপরের সাহায্য ছাড়া তখন তাঁর উঠে বসবার ক্ষমতাও নেই।

পাশে গৌরী আছেন। সব গানগুলো গাইবার পর আবারও তিনি অনুরোধ করলেন তাঁর বাচ্চুকে; মম দুঃখের সাধন , গাইবার জন্য আরো একবার ।এই একটি গান নীলিমা সেন সেদিন গিয়েছিলেন প্রায় আধ ঘন্টা সময় ধরে। আর গোটা সময়টা আবু সৈয়দ আইয়ুব দত্ত আর গৌরী আইয়ুব দত্ত যেন ধ্যান করে গেলেন এক কল্পলোকের রবীন্দ্রচেতনার দর্শন অনুসন্ধানে।

সেরার সেরা রবীন্দ্রদর্শনপ্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের তিনটি নামের একটি তালিকা করলে, যে মানুষটির উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী, সেই মানুষটি যেন রবীন্দ্রনাথকে আবারও নতুন করে উপলব্ধি করতে পারছেন নীলিমার গানের ভেতর দিয়ে ।এক অদ্ভুত শান্ত সমাহিত মুহূর্ত ।অত্যন্ত আটপৌরে সাজ-পোশাকের ,আটপৌরে যাপন চিত্রের এক অদ্ভুত ভঙ্গিমা নিয়ে গীতবিতানকে পাশে রেখেও, গীতবিতানের পাতায় একবারের জন্য চোখ নাম দিয়ে, একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন নীলিমা সেন ।

আরও পড়ুন-সুনীলকে সেদিন শামসুর রাহমান বলেছিলেন, কেউ কেউ কথা রাখে…

এই গোটা পরিবেশকে যদি স্বর্গীয় পরিবেশ বলা হয়, মনে হয় না খুব ভুল বলা হবে। আসলে গীতা ঘটক, বুলবুল বসু ,সংঘমিত্রা গুপ্ত -- এইসব মানুষ যাদের কথা অনুসন্ধানী শ্রোতা একটুআধটু জানেন, কিংবা কমলা বসুর মতো সুদক্ষ ট্রেনার, যাঁদের কথা কেবলমাত্র রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে চর্চা করেন ,এমন মানুষই জানেন, তাঁদের সেই বৃত্তের মধ্যেই সুচিত্রা- কণিকার হৃদয় নিংড়ানো প্রভার ভিতরে এক জ্বলজ্বলে ব্যক্তিত্ব ছিলেন নীলিমা সেন। সুচিত্রা- কণিকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাজেশ্বরী পর্ব তখন প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে শূন্য। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে গাইতে আসার সেই মনমুগ্ধকর স্মৃতি হৃদয়কে একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগানো আবেশে জাগিয়ে রেখেছেন সুচিত্রা মিত্র।

তেমনই সময় কিন্তু তথাকথিত লাইমলাইটে তীব্র আলোর ঝলকানি নিজের উপরে না ফেলেও, গানের ঝরনাতলায় বাঙালির হৃদয়কে মাতিয়ে তুলছেন নীলিমা। সেই  প্রজন্মের নামী, অনামী সমস্ত শিল্পীদেরই যে করিশ্মা ,তার পাশ দিয়ে কিন্তু একটিবারের জন্য তিনি হাঁটছেন না। না হেঁটেই কিন্তু তিনি মাতিয়ে দিচ্ছেন রসিক শ্রোতাদের। 'যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু এবার এ জীবনে' - সেই  নিবেদনের ভেতর দিয়ে  যেন শ্রোতাকে নিজের অজান্তেই বলিয়ে নিচ্ছেন,' হৃদয় বাসনা পূর্ণ হল'।

'তোমার আমার বিরহের অন্তরালে' সেতু বাঁধার এক সত্যিকারের কারিগর ছিলেন নীলিমা সেন ।তাই তাঁকে যখন দেখলাম বর্ধমানের বড়শুলের  কলানবগ্রামের ' শিক্ষা নিকেতনে' মহাত্মা  বিজয়কুমার ভট্টাচার্যের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে,'  আছো অন্তরে চিরদিন তবু কেন কাঁদি' , গাইতে তখন মনে হলো ; রাঢ় বাংলায় স্বাধীনতার কালে যিনি 'দুর্বাশা মুনি'  বলে স্বাধীনতার যোদ্ধাদের কাছে অভিনীত হয়েছিলেন, প্রমথনাথ বিশীর 'পনেরোই আগস্টে' র সেই নায়ক, ফটো ফ্রেমের  ভেতর দিয়েও যেন অশ্রু বিগলিত কন্ঠে তাঁর বাচ্চুর গলার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন ।

আসলে নীলিমা সেন রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন, না  রবীন্দ্রনাথের গান নীলিমা সেন কে দিয়ে নিজের সত্তার একটা সত্য  বিকাশ ঘটাতো-- তা  ঘিরে জোরদার তর্ক চলতে পারে ।পূর্বপল্লী 'সোনাঝুরি ' থেকে রবীন্দ্র সদন বা বিদেশের আঙিনা ,সব জায়গাতেই কিন্তু আত্মনিবেদনের এক অসামান্য মানদণ্ডের উপরে তিনি তাঁর কন্ঠ মাধুর্য ,আত্মনিবেদন কে মেলে ধরতে পেরেছিলেন ।সেই মেলে ধরবার ভেতরেই কিন্তু ছিল তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি।

প্রচারবিমুখ জীবনযাপনের আদর্শ প্রতিবিম্ব ছিলেন নীলিমা সেন। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ শিষ্যদের সাহচর্য পাওয়া মানুষদের ভেতরে আত্মপ্রচারকে ঘৃণা করার একটা ঈর্ষণীয় গুণ ছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য প্রজন্মের,'আমারে না যেন করি প্রচার আমার সকল কাজে' র মূর্ততা উপলব্ধি করা হয় তো আর সম্ভব পরিণয় নয়। তবু আজকের প্রজন্ম কিংবা ভাবীকালের জন্য বলতে হয় ,রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করার এক অসাধারণ আত্মসংযম যেন নীলিমা সেনকে, রবীন্দ্রমন্ত্র উচ্চারণের  অন্যতম সেরা পূজারী হিসেবে তুলে ধরার সাফল্যের টিআরপি ছিল।

সে যুগের শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকেরা সহজ সরল জীবনযাপন করবেন না, সেটাই সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়। তাই নীলিমা সেন কে যখন দেখতাম আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মা, মাসী, পিসিদের  মতোই তরকারি কাটতে কাটতে গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন, কিংবা কাপড় কাচতে কাচতেও  সেই গানের চর্চা থেমে নেই ,তখন মনে হতো ,গান যেন প্রাণ পেয়ে  উঠেছে  নীলিমা সেন নামক এক প্রাণ পাখির কাছে।

সেই অচিন পাখি একবার আমাকে একটা পোস্ট দিলেন, ঠিকানাটা লিখে ডাকে ফেলে দেওয়ার জন্য। যে মানুষটির উদ্দেশ্যে সেই পোস্টকার্ড টি লেখা, তাঁর ডাকের  ঠিকানা আমার ঠিকমত মুখস্থ ছিল না। দেবব্রত বিশ্বাস যে বাড়িতে থাকতেন ট্রাঙ্গুলার পার্কে, তার থেকে এগিয়ে গিয়ে, যতীন বাগচী অ্যাভিনিউয়ের পাশাপাশি একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি।

মার্কেজের কর্নেলকে লেখা চিঠির মতোই বাচ্চুদির চিঠির প্রাপক আমাকে যখন প্রথম একটি গান গাইতে বলেছিলেন, তখন তাঁরই গাওয়া একটি ব্রহ্মসংগীত শুনিয়েছিলাম ,' আহা কি করুণা তোমার, মা বলেছে জেনেছি তোমায়'  গাওয়াটা ভালো হয়েছিল বলে মনে করতে না পারলেও, এটা সাহস করে না বললেও এইটুকুনি তৃপ্তি পাই না যে, তিনি স্বয়ং তাঁর সেই বিখ্যাত ভঙ্গিমায়, ডান হাতে বেলো বাজিয়ে, বা হাতে রিড টিপে আমার গানের সঙ্গে হারমোনিয়াম মিলিয়েছিলেন। তারপর শিখিয়েছিলেন, 'জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান বাজে'। বাচ্চুদির চিঠি  হাতে নিয়ে যখন শান্তিনিকেতন থেকে ভাটপাড়া ফিরলাম ,তখনই রেডিওতে শুনছি, ট্রাংগুলার পার্ক এর সেই মানুষটি অচিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন।  বাচ্চুদির তাঁর অশোককে লেখা চিঠিটা আর অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের  ঠিকানায় ডাকবাক্সে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

বাচ্চুদি  কিডনির অসুখে আক্রান্ত হলেন। ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না।সেই  সময়ের রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিল, তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ডাক্তার অভিজিৎ তরফদারের  তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করানো হবে। সেই অসুস্থ অবস্থাতেও দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে তিনি গাইলেন ।কিডনি ঠিকমত কাজ করেনা  তখন ।ক্রমশ ফুলে যেতে শুরু করেছে  হাত, পা, মুখ।হাঁটলেই হাঁফ  লাগে। অথচ দূরদর্শনে গাওয়া সেই গানগুলো শুনলে একটিবারের জন্যেও তাঁর সেই কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারা যায় না কষ্টের লেশ।চির নতুন, চিরনবীন, চিরকালের নীলিমা সেন ভেসে ওঠেন। হয়তো ডাক্তার অভিজিৎ তরফদারের  তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার সুযোগ পেলে বাচুদি  হঠাৎ করে অকালে হারিয়ে যেতেন না।

রবীন্দ্রনাথের গান বহু মানুষ গাইছেন। আগামিদিনেও বহু মানুষ গাইবেন। সুচিত্রা, কণিকার সেই প্রখর দীপ্তির ভিতরেও গায়নভঙ্গি, কণ্ঠসম্পদ এবং আত্মনিবেদনের সক্রিয়তায় নীলিমা সেন  আমাদের সামনে রবীন্দ্রনাথের গান ঘিরে উপস্থাপিত করে গেছেন, বাংলা ও বাঙালি যত দিন টিকে থাকবে, ততদিন সমান প্রাসঙ্গিক আর জীবন্ত হয়ে টিকে থাকবে সেই গান এবং নীলিমা সেন।

More Articles