অন্নদাশংকরকে একটি নাটক লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ

আটের দশকের শেষ দিক। শান্তিনিকেতনে সেবার অনেকদিন পরে গিয়েছেন অন্নদাশঙ্কর। যথারীতি মধ্যাহ্ন ভোজন হয়েছে বোলপুরে নেমে কেনা পাউরুটি আর ' ইতি' র সামনে ঘোষদার দই সহযোগে। অন্নদাশঙ্কর - লীলা রায় শান্তিনিকেতনে গেলে, সেইদিন দুপুরে এটাই ছিল পেটেন্ট লাঞ্চ।শান্তিনীকেতন এক্সপ্রেস গত শতকের আটের দশকের গোড়ার দিকে চালু হওয়ার পর, মোটামুটি দুপুর দুপুর বোলপুরে পৌঁছনো যেতো।তার আগের কালের কথা অবশ্য আরও অনেক অন্য রকম।

সেবার বাড়ি পৌঁছে, খাওয়াদাওয়া সেরে, বিকেলে একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন অন্নদাশঙ্কর। পিয়ার্সন হাসপাতালের গা ঘেঁষে সেবাপল্লির রাস্তাটা যেখানে মিশেছে শান্তিনিকেতন রোডে, সেই পর্যন্ত পৌঁছেছেন অন্নদাশঙ্কর। সুবর্ণরেখার দিক থেকে একটা রিকসা আসছে। একজন বয়ষ্ক মানুষ আর একজন মৃথুলা বয়ষ্কা মহিলা রয়েছেন রিক্সায়। অন্নদাশঙ্করকে দেখেই তাঁরা রিক্সাটা থামালেন। ভদ্রলোক তড়াক করে নেমে পড়লেন। ভদ্রমহিলা একটু ধীরে নামলেন। দু'জনেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন অন্নদাশঙ্করকে।

কুশল বিনিময়ের পর অন্নদাশঙ্কর সেই প্রৌঢ়কে বললেন; '' বিলেত ফেরত' -এই থামলে চলবে না।স্বদেশে এসে কি হচ্ছে , না হচ্ছে - তা নিয়েও তো ছবি করতে হবে।' চিদুবাবু, চিদানন্দ দাশগুপ্ত সেই রাস্তাতেই বলতে শুরু করলেন তাঁর ' আমোদিনী' র ভাবনা। বললেন, টুকু( শর্মিলা রায় পোমো)-কে অতুলপ্রসাদ গাওয়ানোর ইচ্ছে আছে। অন্নদাশঙ্কর বললেন, "অনেকদিন ক্ষিতীশদার খবর পাই না। কালই যাব ওঁকে দেখতে। তোমার এই ছবির ও ক্যামেরাম্যান কি ধ্রুব? ধ্রুবজ্যোতির ক্যামেরার চোখটা দারুণ। ও তো কলেজ স্ট্রিটের কাছেই থাকে, না?''

''আপনার ' বিলেত ফেরত' এর ক্যামেরাম্যানের নামটাও মনে আছে?'' বিস্মিত চিদুবাবু।

তেমন আর একটা বিস্ময়মুগ্ধ অনুভূতি মনে পড়ে। আটের দশকের একদম শুরুর দিক।' ঘরে ফেরার ডাক' শুনেছেন বিশ্ব-নাগরিক অমিয় চক্রবর্তী। থিতু হয়েছেন শান্তিনিকেতনের ' রাস্কা'-তে। গুরুদেবের সাহিত্য সচিবের মুখোমুখি অন্নদাশঙ্কর। পাশের ঘরে গল্পে মজেছেন অমিয়পত্নী হৈমন্তী চক্রবর্তী আর অন্নদাশঙ্করের স্ত্রী লীলা। দু'টি নাম ই গুরুদেবের দেওয়া।

''প্রথম যেদিন শান্তিনিকেতনে এলাম, উঠেছিলাম,' পান্থনিবাস'-এ, এখন যেটা ,' সুবর্ণরেখা',''-বলে চলেছেন অন্নদাশঙ্কর।

''হ্যাঁ, সেখানেই আপনার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়'', প্রায় সত্তর বছর আগের স্মতির সাগরে ভাসলেন অমিয় চক্রবর্তী।বলে চলেছেন; ''আমি তখন সদ্য একটি দুর্গম গুহায় বেশ কয়েকদিন কাটিয়েছি।''

''সকালে উঠে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই অভিজ্ঞতা শুনছিলাম আমি'',  বললেন অন্নদাশঙ্কর।

''তারপর দুজনে প্রায় একই সঙ্গে গুরুদেবের কাছে গেলাম না?''- অমিয়ের কথা জবাবে অন্নদাশঙ্কর বললেন; ''ঠিক তাই। গুরুদেব তখন প্রাতঃভ্রমণ করছেন। আজকের পোস্ট আপিস যেখানটায়, ঠিক সেইখানে আপনি আর আমি গুরুদেবের সামনে হাজির হলাম।''

গুরুদেবের সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের শেষ দেখা কিন্তু ট্রেনে। জীবনের প্রায় শেষের দিকে পূর্ববঙ্গে তাঁর শেষ সফরে পতিসরে জমিদারির তদারকির নামে, যেন সেখানকার মানুষদের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আসছেন গুরুদেব। ট্রেনে বিশেষ সেলুনে গুরুদেবের একমাত্র সঙ্গী নওগাঁর মহকুমা হাকিম অন্নদাশঙ্কর। নানা কথার ভিতর দিয়ে উঠল নাটকের প্রসঙ্গ। অন্নদাশঙ্করকে একটা নাটক লিখতে বললেন গুরুদেব। মহাভারত ভিত্তিক প্লটও তিনি বলে দিলেন। বিষয়টি এইরকম; মহাভারতের যুদ্ধ শেষ।ব্যাধের বাণে প্রাণত্যাগ করেছেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর মহিষীদের অর্জুন স্বগৃহে ফিরিয়ে দেওয়া মনস্থ করলেন।কিন্তু দেখা গেল, অর্জুনের ব্যবস্থা করবার আগেই ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে চলে গিএছে। অর্থাৎ, কৃষ্ণ বলপূর্বক ওইসব নারীদের আটকে রেখেছিলেন। তাঁরা সুযোগ পেয়েই নিজের নিজের পছন্দের পুরুষের কাছে ফিরে গেছেন।

ছবিতে অন্নদাশংকর রায়, গৌতম রায়, শেখ রেহানা -বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা, টিউলিপ ও ববি (বঙ্গবন্ধুর নাতি নাতনি)।ছবিতে অন্নদাশংকর রায়, গৌতম রায়, শেখ রেহানা -বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা, টিউলিপ ও ববি (বঙ্গবন্ধুর নাতি নাতনি)।

এই বিষয়টি অবলম্বন করে অন্নদাশঙ্করকে নাটক লিখতে বললেন গুরুদেব। প্রস্তাব শুনে অন্নদাশঙ্কর গুরুদেবকে বললেন; "গুরুদেব, আপনি লিখছেন না কেন? উত্তরে গুরুদেব বলেছিলেন,"রাজনৈতিক হিন্দুদের আমি ভয় করি।"

অনেকেরই জানা নেই , লীলা রায়ের বাংলা শেখার ক্ষেত্রে অনেকখানি কৃতিত্ব ' হারামণি' মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিনের। এই সময়ে কুষ্টিয়াতে আসেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ ফোকলরিস্ট আর্নলড বাকে। অন্নদাশঙ্কর এবং মনসুরউদ্দিনের উদ্যোগে বহু সাধক বাউলের গান তিনি সংগ্রহ করেন, রেকর্ড করেন। বাংলার বাউলদের আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত করবার ক্ষেত্রে বাকের বিশেষ অবদান আছে। অন্নদাশঙ্করের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া বাকের এই সংগ্রহ সম্ভবপর হতো না।

নাটক নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। গুরুদেবের উপদেশ মতো নাটক। ঘটনাচক্রে অন্নদাশঙ্করের আর লেখা হয়নি। যদিও রাজনৈতিক হিন্দুদের আক্রমণ করে অন্নদাশঙ্করের লেখার কোনো বিরাম ছিল না। আর রাজনৈতিক হিন্দুরাও নব্বই ঊত্তীর্ণ অন্নদাশঙ্করকে হত্যার ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্যে। সেই সময়ের রাজ্য সরকারকে অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা বসাতে হয়েছিল।

নাটক ঘিরে অন্নদাশঙ্করের খুব বড় রকমের অবসেশান ছিল। প্রথম জীবনে তিনি ' আপদ বিদায়' বলে একটা নাটক লিখেছিলেন।ছাপতে দিলেন একটি পত্রিকায়।গোটা বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য, সেই পত্রিকা সম্পাদক লেখাটি সেই লেখাটা হারিয়ে ফেললেন। তখন তো লেখার কপি রাকার তেমন চল এবং প্রযুক্তিগত সুযোগ বিশেষ ছিল না। গুরুদেবের ক্ষেত্রটি ছিল ভিন্ন। তাঁর সচিব বা ঘনিষ্ঠেরা চিঠিপত্র ইত্যাদির কপি রাখতেন।সকলে তো তেমনটা করতেন না। বিষন্ন অন্নদাশঙ্করকে ' রবিরশ্মি' র লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পরামর্শ দিলেন টাইপে লিখতে। তাহলে কার্বন কপিটা সহজেই লেখকের কাছে থেকে যাবে। অন্নদাশঙ্কর চারুবাবুর পরামর্শে বাংলা টাইপ রাইটার কিনলেন। নিজে টাইপ শিখলেন।তারপর থেকে সব লেখাই টাইপে লিখতেন। দীর্ঘকাল ব্যবহারের ফলে সেই টাইপ রাইটারটা যখন একটু গোলমাল করতে থাকল, অন্নদাশঙ্কর তার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে যাবেন। নব্বই পার হয়ে গিয়েছে তখন তাঁর বয়স। তবু ঠিক করলেন , লেখার জন্যে ঢাকা থেকে একটা বাংলা টাইপ রাইটার কিনবেন।

যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। টাইপ রাইটার কেনার টাকা নিয়েই ঢাকার মাটিতে পা দিলেন। বাংলা টাইপ রাইটার কিনতে তাঁকে সব যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। ওই বয়সে নতুন টাইপ রাইটারে লেখা অভ্যাস করলেন অন্নদাশঙ্কর। অভ্যস্থ হয়ে উঠলেন। মাঝে মাঝে সেই টাইপ রাইটারে লিখেওছেন। যদিও এই সময়কালে তাঁর বেশির লেখাই অনুলেখকের সাহায্যে তৈরি করতে হতো। আর সেই কাজটা তাঁর সাহিত্য সচিবই করে দিতেন।

এই ধারাবাহিকের প্রথম কিস্তি পড়ুন-বাঁধভাঙা আবেগে গৌরীপ্রসন্নকে জড়িয়ে ধরলেন বঙ্গবন্ধু, অদেখা আলোয় বাঙালির চেনা নেতা

খুব ভোজনরসিক না হলেও মধ্য কলকাতার জিমি'স কিচেন তাঁর খুব প্রিয় ছিল। চৈনিক খাবারের রকমফেরের স্বাদ খুব একটা নিতেন না। পছন্দ করতেন রকমারি সুপ। আর তাঁর খুব প্রিয় ছিল স্টিম রাইসের সঙ্গে জিমিজের ফিস ম্যান্ডারিন। এজিসি বোস রোড আর শেক্সপিয়ার সরণীর সংযোগে,  জিমি'স কিচেনে' র হেঁশেলের খুপরি লাগোয়া,পশ্চিম দিকের একদম দেওয়াল ঘেঁষা টেবিলটা ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয়। খাওয়ার আগে একদম সাহেবি কেতায় নিজের হাতে চামচ,ফর্ক সাজাতেন। খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে সেই সঙ্কেত ওয়েটারদের দেওয়ার মতো করে খাবার খাওয়া শেষ করে প্লেটে স্পুন, নাইফ, ফর্ক সাজিয়ে রাখতেন। আনপড় সাহিত্য সচিবকে প্রথম দিন, নিজের হাতে , বলে বলে শিখিয়ে দিয়েছিলেন ' টেবিল ম্যানার'।

অন্নদাশঙ্করের খুব প্রিয় খাবার ছিল বেলের মোরব্বা। প্রণতি দে, কবি বিষ্ণু দের পত্নী, তিনি যখনই অন্নদাশঙ্করের কাছে আসতেন, নিজের হাতে বেলের মোরব্বা তৈরি করে আনতেন। তা ছাড়াও বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে গড়িয়াহাটের দিকে যেতে একটা ছোট্ট, চাকচিক্যহীন দোকানের বেলের মোরব্বা বড় প্রিয় ছিল অন্নদাশঙ্করের।

লীলা রায় বলতেন,"তোমার দাদু জীবনে একবার রান্না করবার চেষ্টা করেছিলেন। মোহন ভোগ। কেউ খেতে পারে নি!" তবে সাহেবি কেতায় অভ্যস্থ অন্নদাশঙ্করের অত্যন্ত প্রিয় প্রাতঃরাশ ছিল দুধ চিঁড়ে। সঙ্গে চিজ কিউব। একটু করে চিঁড়ে খাচ্ছেন আর বা হাত দিয়ে কুট করে চিজ কিউবে কামড় দিচ্ছেন- আর মাঝে মাঝে ছেলেমানুষের মতো হাসছেন। ব্রেকফার্স্টের টেবিলে এটা ছিল অন্নদাশঙ্করের খুব পরিচিত ছবি।

More Articles