ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনা কি নির্বিরোধী যন্ত্র বানানোর কল? প্রশ্ন করতেই হবে

'ভারতে তৈরি হবে একটা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, যাতে মধ্যে দিয়ে পড়ুয়ারা পাবে বিশ্বমানের শিক্ষা,' বাজেট পেশ করার সময় এমনটাই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তিনি এও বলেছেন যে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হবে ভারতবর্ষের পড়ুয়াদের দুয়ারে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া। ব্যবস্থা করা হবে 'ওয়ান ক্লাস-ওয়ান ভিউ চ্যানেলে' প্রকল্পের, যার দৌলতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা আঞ্চলিক ভাষায় চালিয়ে যেতে পারবে পড়াশুনো। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় থাকবে ২০০টিরও বেশি টিভি চ্যানেল। কোলাহল শেষের নিস্তব্ধতায় এবার আসা যাক কিছু প্রশ্নে। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের  এর ঘোষণার মধ্যে দিয়ে কি ভারত রাষ্ট্র শিক্ষাক্ষেত্রে এক পূর্ণ ডিজিটাইজেশন প্রকল্পের দামামা বাজিয়ে দিল? তাই যদি হয় তাহলে এর লাভের ক্ষীরটুকুর মূল ভাগীদার হবেন কারা?

গোড়াতেই জেনে নেওয়া যাক ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টা কী। অজয় কুমার গর্গ তাঁর 'Digital University, Next Generation Approach Towards Education' শীর্ষক মধ্যে দিয়ে দেখাচ্ছেন কী ভাবে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় আগামী প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠছে শিক্ষার এক অন্যতম স্তম্ভ। তাঁর মতে, আলাদা আলাদা কোর্সের সুবিধে পেতে পড়ুয়াদের ছুটতে হয় নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে করে টাকা পয়সাও খরচ হয় প্রচুর পরিমাণে। ফলত অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোকে বিপুল অনভিপ্রেত ব্যয়ের ধাক্কা সইতে হয়। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় হলে সবই আসবে এক ছাতার তলায়। পড়ুয়াকে আর ছুটতে হবে না এক দরজা থেকে আরেক দরজা। ঘরে বসে শুধু ল্যাপটপের বোতাম টিপে  সে এক জায়গায় পেয়ে যাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিষেবা। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সংজ্ঞাই দিচ্ছেন অজয়বাবু। কিন্তু তাঁর এই সংজ্ঞার সাপেক্ষে কিছু প্রশ্ন আসে। ভারতবর্ষের মতো একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশে ঠিক কতজন শিক্ষার্থী ঘরে বসে ল্যাপটপের মাধ্যমে পড়াশুনোর সুবিধে ভোগ করতে পারে? কোভিড পরবর্তী পরিস্থতিতে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই অনলাইন হয়ে গিয়েছে। সমীক্ষা বলছে তারপর থেকে স্কুলছুট হওয়া পড়ুয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক রকমভাবে। 

একটা ক্লাসঘর, ব্ল্যাকবোর্ড এবং সর্বোপরি স্যার, ম্যাডামদের সংস্পর্শ যে ছাত্র-ছাত্রীর বেড়ে ওঠায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার কথা নয়। কিন্তু এই ব্যবস্থাটার মূলে ঘআঘাত করেছে লকডাউন। ক্লাসঘর থেকে শিক্ষাব্যবস্থা উঠে এসেছে মোবাইল স্ক্রিনে। সুসজ্জিত স্টাডি টেবিলে বসে ক্লাস করার সৌভাগ্য আর কতজনেরই বা থাকে? অর্ধেক পড়ুয়ার বাড়িতে টাচ স্ক্রিন মোবাইল নেই, বা থাকলেও সাতজনের পরিবারে ফোন হয়ত একটাই। এখানেই সমস্যার শেষ নয়।বহু ক্ষেত্রেই এমন দেখা গেছে যে ফোন থাকলেও নেট থাকে না। ফলে দেখা গেল ধীরে ধীরে পড়াশুনোর তাগিদ গেল কমে।একদল পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে মন দিল ঘরের কাজে। কেউ কেউ আবার অন্ন সংস্থানের চিন্তায় বেরিয়ে পড়ল বাইরে। এমনও দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বাদে স্কুল খোলার পর পড়ুয়ার মনেই নেই যে সে কোন ক্লাসে পড়ত। মাথাচাড়া দিচ্ছে বাল্য বিবাহের সমস্যা। স্কুল আদৌ খুলবে কিনা জানা যাচ্ছে না। মেয়েকে আর পড়াশুনো করিয়ে কাজ নেই, এবার বিয়ে দিয়ে দাও। খবরের কাগজ খুললে আকছার চোখে পড়ে এমন ঘটনা। যে মেয়ের হয়ত স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মস্ত গবেষক হওয়ার, সে অচিরেই পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে এবার শ্বশুরবাড়ির হাঁড়ি ঠেলবে। এ অবস্থায় শিক্ষাকে ডিজিটাইজেশনের দিকে ঠেলে দেওয়া মানে তো একভাবে পুঁজির দাসানুদাস বানিয়ে ফেলা।

আরও পড়ুন-বাজেটে পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব?

একদল মানুষ হয়তো নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতার উর্দ্ধে গিয়ে অনলাইন ক্লাসের স্বার্থে ট্যাব বা টাচ স্ক্রিন ফোন কিনবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এতে আদতে লাভ হবে কাদের? অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এ সমস্ত মানুষদের নাকি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট প্রস্তুতকারী বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর?

ডিজিটাল বিভাজনের ফলে শিক্ষাব্যবস্থার যে এমন পরিণতি হবে সেটা আন্দাজ করেননি গৌতম সাঁতরা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিংয়ে লিফট অপারেটরের কাজ করেন তিনি। তাঁর ছেলের সামনে স্কুল টেস্ট, এদিকে হাত থেকে পড়ে গিয়ে টাচ স্ক্রিন ফোন গিয়েছে ভেঙে। অস্থায়ী কর্মী তিনি। ফোন সারাতে দোকানে যা দাম চাইছে তা এই মুহূর্তে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। কী হবে তাহলে? ছেলেটা কি পরীক্ষা দিতে পারবে না? শেষ অনেক কষ্টে ছেলের জন্য একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টাচ স্ক্রিন ফোন জোগাড় করলেন তিনি, তবে শান্তি। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বোধহয় গৌতমবাবুর মতো মানুষদের কোনও জায়গা নেই। কারণ তাঁদের তো ঠিক 'গো ডিজিটাল' স্লোগানের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। 

শুধুই স্টাডি মেটিরিয়াল পড়ে বিদ্যাচর্চা হয় না। তার জন্য লাগে ছাত্র শিক্ষকের পারস্পরিক মেলবন্ধন। পিরিয়ড শেষে শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে আলাদা ভাবে প্রশ্ন করে পড়ুয়া বুঝে নেওয়া যায় পাঠ্যের কঠিন অংশটা। বা ধরা যাক, কলেজ শেষে ক্যান্টিনে নিছক আড্ডা মারতে মারতে একদল ছেলেমেয়ে উনিশ শতকের বাংলার ঘটিনাক্রমগুলো একটু ঝালিয়ে নেবে। এ দৃশ্যের সঙ্গেই তো আমরা পরিচিত।  প্রশ্ন এবং কথোপকথনের মধ্যে দিয়েই  ক্লাসঘরের পাঠ্য পড়ুয়াদের মস্তিষ্কে জাল বিস্তার করে। আসলে, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়। পড়ুয়াদের কানে সে দেয় বিরোধিতার মন্ত্র। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তারা বুঝে ফেলে, কী ভাবে পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে পাঠ্যবস্তুকে আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করা যায়। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ প্রায় নেই বললে চলে। সেখানে হয়ত একদল ছেলেমেয়ের ভবিতব্য শুধু ফ্যালফ্যাল করে শিক্ষকের চ্যাট উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে থাকা। অধ্যাপক পড়িয়ে যাবেন এক তরফা, আর তারা শুধুঘরে বসে শুনবে। তাদের বন্ধুবান্ধব নেই, কোনও বিরোধাভাসের জায়গা নেই, নিকটাত্মীয় কেবল গুগল মিট।

ক্লাসে যখন শিক্ষক পড়ান, তখন তিনি ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে পড়ান, যার ফলে একটা প্রশ্নোত্তরের সম্পর্ক তৈরি হয়। ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা কোনোদিনই সম্ভব নয়। শিক্ষাক্ষেত্রের ডিজিটাইজেশন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এ কথাই বলছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। তিনি আরও বলছিলেন, 'ডিজিটালের ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে ইন্টারনেট সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া, যেটা ভারতবর্ষে এখনও হয়ে ওঠেনি। ফলত, ডিজিটালের দিকে যেতে হলে আমাদের উচিত ডিজিটাল ডিভাইডকে আগে ভাঙা, সেটা না হলে মুশকিল। দ্বিতীয়ত, এটা মাথায় রাখতে হবে যে আমরা একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। ফলত, বাড়িতে এক ছেলে এক মেয়ে থাকলে ছেলেটাকেই বাবা মা বেশি গুরুত্ব দেয়। অনলাইন এডুকেশনের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে।'

যদিও প্রযুক্তিকে পুরোপুরি অস্বীকার করার পক্ষপাতিও তিনি নন। তিনি মনে করেছেন, 'আমরা যেদিকে যাচ্ছি, প্রযুক্তির সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে দিয়ে না করলে কিছু সংখ্যক মানুষই তার সুযোগ সুবিধে পাবে।' সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করবে।  এই সমস্যার দিকেই বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপিকা অরুন্ধতী দাস। তিনি বলছেন, 'আমি যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি যে ডিজিটাল মাধ্যম করব, তখন নিশ্চই এটা ভেবেই নিচ্ছি যে সবাই সুবিধা পেতে পারবে। পেছনে যে লোকটা পড়ে রইল, সেও যাতে সমান সাহায্য পেতে পারে। আজকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাইজেশনের দিকে শিফট করা মানে কিন্তু পুরুলিয়ায় যে ছেলেটা পড়ে রইল তার দিকে একবারও ফিরে না দেখা।' 

আরও পড়ুন-ডিজিটাল মুদ্রা আর ক্রিপ্টোকারেন্সির ফারাক কোথায়, নতুন অর্থব্যবস্থা নিয়ে যে তথ্যগুলি জানতেই হবে

স্কুল কলেজে গিয়েই বহু ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর প্রাথমিক চেতনা জাগে। বিদ্যাচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় তারা। ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় সেই পরিবেশটা কেড়ে নেবে। এভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে তার ক্ষয় ক্ষতির সম্ভবনাগুলিকে বিশ্লেষণ করছেন সিধু কানু বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সম্রাট সেনগুপ্ত। তিনি মনে করেন, 'ডিজিটাল ডিভাইড এমনিতেই রয়েছে, তার উপর স্কুল কলেজের ফিজিক্যাল স্পেস না থাকলে প্রান্তিক অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হবে। স্কুল কলেজে গিয়েই অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়, বিশেষ করে যারা ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। এখানে পরিবেশের একটা ব্যাপার আছে, কারণ সকলের বাড়িতে সেই পরিবেশ থাকে না, যার মধ্যে নির্বিঘ্নে তারা অনলাইন ক্লাস করতে পারবে। ফলত, এই প্রকল্পে তাদের ক্ষতিই হবে।' ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা পড়ুয়াদের ঠিক কী দিয়ে উঠতে পেরেছে? বিশ্বদর্শন, নাকি মাসিক বা বার্ষিক কোনও প্যাকেজ? সম্রাটবাবু বলছেন, 'শিক্ষা আসলে একটা ওয়ার্ল্ডভিউ, আর ডিজিটাল ব্যবস্থা হচ্ছে একটা প্যাকেজ। আর এই ওয়ার্ল্ড ভিউটা ডিজিটাল ব্যবস্থা কোনোদিন দিতে পারবে না। বিশেষ করে যারা পিছিয়ে পড়া ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে তাদের।'

বছরের পর বছরে ধরে যে ব্যবস্থার সঙ্গে পড়ুয়ারা মানিয়ে নিয়েছে, তাকে ঠিক কোন প্যাকেজের আওতায় ফেলতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার? ঠিক যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই পড়ো। তার অতিরিক্ত পড়াশুনো কোরোনা। নব্যঘোষিত এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে এমন কোনও বার্তাই কি দিতে চাইছে সে? কিন্তু তাতে করে তো ভারতবর্ষের মেধাচর্চার কাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে গেল একগুচ্ছ অমীমাংসিত ধোঁয়াশা। তাদের সমাধান কী, বা সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা, তা আগামী দিনই বলবে।


তথ্যঋণ:
 A. Kumar Garg: Digital University, Next Generation Approach Towards Education

চিত্রঋণ: dw.com

More Articles