এশিয়ার একমাত্র গ্রিক কবরস্থান আছে কলকাতাতেই! অনাদরের ইতিহাস চোখে জল আনবে

ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ফুলবাগান স্টেশনের বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া মন্দিরের ধার ঘেঁষে লুকিয়ে আছে প্রাচীন কলকাতার এক ঐতিহ্য। কিন্তু এ সম্পর্কে যেমন জানেন না মহানগরীর বেশিরভাগ বাসিন্দা, স্থানীয় মানুষজনও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। দিনের পর দিন অনাদরে রয়ে গিয়েছে এই ঐতিহ্য।

ফুলবাগান মেট্রো স্টেশনের বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া  ২৬ কাঠা জমিজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই গ্রিক কবরস্থান। কলকাতা পুরসভা গ্রিকদের কবরস্থানকে গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করেছে। এরপরও বছরের পর বছর ঐতিহ্যমণ্ডিত এই কবরস্থান অবহেলা, অনাদরে পড়ে থেকেছে। যদিও ফুলবাগানের এই গ্রিক কবরস্থান শুধু ভারতে নয়, এশিয়াতেও গ্রিক সম্প্রদায়ের নিজস্ব একমাত্র কবরস্থান।

কলকাতা পুরসভার গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের তালিকাভুক্ত এই কবরস্থানের প্রবেশপথে লোহার বড় গেট। গেটের বাইরে থেকেও কবরস্থানটি দেখা যায়। অনবরত গাড়িঘোড়ার চলাচল, ব্যস্ত পথে মানুষের কোলাহল সত্ত্বেও গাছগাছালিতে ঢাকা কবরস্থানে প্রবেশ করলে নির্জনতার স্বাদ মিলবে।

কলকাতা শহরে ইউরোপ ও অন্য নানা দেশ থেকে বিদেশিরা এসে একসময়ে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেছিলেন। শুধু ব্রিটিশরাই নয়, চিন, ইহুদি, আয়ার্ল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, আর্মেনিয়ার মতো দূর দেশের বাসিন্দারা বাণিজ্যের তাগিদে এসে্ছেন কলকাতায়। এর পর বছরের পর বছর বসবাস করেছেন।

সেই সূত্রে কলকাতা সমৃদ্ধ হয়েছে ঐতিহাসিক নানা নিদর্শনে। ফুলবাগানের গ্রিক কবরস্থানও ঔপনিবেশিক আমলের কলকাতারও এক অমূল্য নিদর্শন।

গ্রিস থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কলকাতায় আসেন একদল মানুষ। এমনকী ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় পর্যন্ত কলকাতায় গ্রিকদের বসবাস ছিল। গ্রিকরা জামাকাপড়, নুন, পাটের ব্যবসা করতেন।

ভারত স্বাধীনতা হওয়ার পরে কলকাতায় গ্রিক সম্প্রদায়ের যে মানুষজন বসবাস করতেন তাঁরা গ্রিসে ফিরে যান। কলকাতা শহরে এখন একটিও গ্রিক পরিবার বসবাস করে না।

আরও পড়ুন-কলকাতার পেটের ভিতর ইহুদি কলকাতা, হেঁটে দেখা হলো না যে পথ

ইউরোপের নানা দেশ থেকে আসা মানুষজন কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেন অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকেই। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত ওঁরা অনেকেই কলকাতা মহানগরীর নাগরিক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার দুবছরের মাথায় ভারতও স্বাধীন হয়। এই সময়ের মধ্যেই ভিনদেশ আসা মানুষজন পূর্বপুরুষের স্মৃতির মায়ার ত্যাগ করে  কলকাতা থেকে স্বদেশে পাড়ি দিয়েছেন। 

গ্রিকরা যখন কলকাতায় এসেছিল ততদিনে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ভারতে ফুলেফঁপে উঠেছে। ব্যবসা করতে ভারতে নানা বিদেশি রাষ্ট্র থেকে বিদেশিরা কলকাতায় তখন আসছেন। গ্রিকরাও তেমন এই শহরে এসেছিল।

গ্রিস থেকে আগত মানুষের জাহাজ তৈরিতে পারদর্শিতা ভুবনখ্যাত। গ্রিস থেকে প্রথম যে দলটি কলকাতায় এসেছিল তাঁরা জাহাজ নির্মাতা ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।

তৎকালীন গ্রিসের ফিলিপপোউলিস শহর এবং আড্রিনোপোলিস শহর থেকে জাহাজ নির্মাণে কুশলী  একদল মানুষ কলকাতায় এসেছিলেন। বর্তমানে এই দুটি শহরই বুলগেরিয়ার অন্তর্গত।

ঠিক কী কারণে গ্রিকরা কলকাতায় এসেছিলেন তাও ইতিহাস ঘেঁটে জানা গিয়েছে। এর প্রধান কারণ হল ১৭৬৮ সাল থেকে ১৭৭৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়া এবং অটোমান সম্রাটের মধ্যে ব্যাপক যু্দ্ধবিগ্রহ চলেছে। সেই সময়ে তুরস্ক এবং গ্রিস থেকে কলকাতায় পাড়ি জমান ওই দুই দেশের বাসিন্দা বেশ কিছু মানুষ। সে হিসেবে বলা যেতে পারে, ভাগ্য ফেরাতে গ্রিকরা কলকাতায় উদ্বাস্তু হিসেবেই এসেছিল।

ক্যানিং স্ট্রিটের পর্তুগিজ চার্চে দুটি কবরের গায়ে ফলকে লেখা আছে কবরে শায়িত ওই দুই  গ্রিক ব্যক্তির নাম। একটি কবর ১৭১৩ সাল এবং আরেকটি কবর ১৭২৮ সালের।

এই সময়ে গ্রিকদের কলকাতায় উপস্থিতি থাকলেও নিজস্ব কোনও চার্চ ছিল না। পরে ১৭৫২ সালে একটি চার্চ তৈরি করা হয়। এরপর উত্তর কলকাতার ১৭৮১ সালে আরেকটি চার্চের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। সেইসময়ে ভারতে গভর্নর জেনারেল ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস।

নতুন চার্চ তৈরির সময়েই ফুলবাগানের এই কবরস্থানটি তৈরি হয়। সেই ১৭৭৭ সাল থেকে আজও এই গ্রিক কবরস্থান নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।

কবরস্থানের কেয়ারটেকার বসন্ত দাস। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। হাসিখুশি মানুষ। আদতে কটকের মানুষ বসন্ত জানালেন, বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই কবরস্থানের কেয়ারটেকার।

কবরস্থানে প্রবেশপথের লোহার গেট পেরোলেই একফালি কোয়ার্টার। সেখানে সপরিবারে বসবাস বসন্ত দাসের। কেয়ারটেকার হিসেবে গ্রিক চার্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাইনে বাবদ মাসিক পাঁচ হাজার টাকা পান বসন্ত দাস।

কবরস্থানে দুই শতাধিক কবর রয়েছে। সবচেয়ে পুরনো কবরও এখনও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কবরটি সেইসময়ের কলকাতার প্রখ্যাত ধনী গ্রিক ব্যবসায়ী আলেকজান্ডারের। ১৭৭৭ সালে ৫ মার্চ ঢাকাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এরপর ১৭৭৭ সালের ৭ অগাস্ট থেকে এই কবরস্থানে চিরবিশ্রামে আছেন আলেকজান্ডার।

আলেকজান্ডার নামে এই ব্যবসায়ী ছিলেন ব্রিটিশদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওয়ারেন হেস্টিংস আলেকজান্ডারকে কায়রোতে পাঠিয়েছিলেন সেখানে ব্রিটিশরা যাতে ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারে, এই ব্যাপারে সম্মতি আদায়ের জন্যে।

গ্রিকদের এই কবরস্থানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এপিটাফ গ্রিক ভাষায় লেখা। ইংরেজিতে লেখা ফলক স্বল্প সংখ্যক। বসন্ত দাস জানালেন, বাবা-ঠার্কুদার মুখে শুনেছি, কোনও কবরের গায়েই লেখা নেই কীভাবে সেই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

কেয়ারটেকার বসন্ত জানালেন, ১৯৯৮ সালে গ্রিসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফুলবাগানের এই কবরস্থানটি পরিদর্শন করে গিয়েছেন। মাঝেমাঝে কালীঘাটের অর্থোডক্স গ্রিক চার্চ থেকে লোকজন এসে এখন খোঁজখবর নিয়ে যায়।

কবরস্থান ঘুরে দেখা গেল শান্তিতে শায়িত ১৮০৮ সালের ১২ জুন মৃত ডাভিডিস নামে এক গ্রিক ব্যক্তি। ওঁর পাশেই ১৮৪২ সালের ৭ মে থেকে চিরবিশ্রামে শায়িতা রয়েছেন এলিজা জর্জিয়ানা নামে একদা কলকাতার বাসিন্দা গ্রিক মহিলা।

কবরস্থানের এককোণে ছোট একটি চ্যাপেল রয়েছে। সত্তর দশকে পাদ্রির মৃত্যুর পরে বহু বছর হয়ে গেল সেটি বন্ধ। বসন্ত জানালেন, চ্যাপেলে প্রার্থনার কাজ চালানোর জন্যে ছিলেন একজন পাদ্রি। ১৭৭৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে প্রার্থনার পাটও বন্ধ।

কবরস্থানে ছড়ানো কিছু ভাস্কর্য চোখে পড়ল। সেসবেরও যত্নআত্তি করার লোক নেই।

১৭৭৭ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত গ্রিক কবরখানায় মরদেহ কবরস্থ হয়েছে। ১৯৭৩ সালে কবরস্থ করা হয়েছে চ্যাপেলের পাদ্রীকে। এরপর ২০০৩ সালে এখানে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চে দীক্ষিত এক ব্যক্তিকে শেষ কবর দেওয়া হয়।

More Articles