'ইন্ডিয়ায় সহজে মাছ মেলে না', তাই ওপার থেকে এল হাঁড়িভর্তি সরষে-ইলিশ

Partition Stories: দুঃখমুহ্যমান এরা সবাই শুধু মাছের ঝুল খাচ্ছে না ভাত দিয়ে মেখে, একটু একটু করে মাছের সঙ্গে খাচ্ছে তীব্র শোক আর তীব্রতর ব্যথা, স্মৃতি।

বরিশালের মুলাদি মাউলতলার ভিটে ছাড়ার সময় বড় মাটির হাঁড়িতে ইলিশ মাছের ঝুল রান্না করে আনা হয়েছিল। সেই চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলা বাস্তুভিটের কথা মনে পড়ে খুব। দাদুরা শুনেছিল, ইন্ডিয়ায় এমন সহজে জল, এমন সহজে মাছ মেলে না, তাই এই ব্যবস্থা।

ভোররাত থাকতেই উঠে বারান্দায় লম্ফ জ্বালিয়ে রাখা।কাঁঠালকাঠের জিনিস, পাথরের থালা, পিতলের ঘট নিয়ে জলভরা চোখে নৌকায় ওঠা। গোয়ালের গোরুগুলির দড়ি ছেড়ে দেওয়া। আকাশ ফরসা হচ্ছে, কুপি জ্বলছেই, আশপাশের লোক ভাববে আলো আছে যখন বাড়িতে লোক আছে, বেলা বাড়লে বোঝা যাবে ব্যাপারখানা। শূন্য বাড়ি, ফাঁকা ঘরদোর, দড়িছেঁড়া গোরু দৌড়চ্ছে কলাবাগানের দিকে।

শেষবারের জন্য দিদিমা উঠোন লেপে গড় করছেন তুলসীতলা। বাড়ির পোষা বিড়াল কিছু বুঝতে পেরেছে।ও খালি ছোট থাবা নিয়ে পায়ের কাছে মিউমিউ করে ঘুরছে। ও টের পেয়ে গিয়েছে কিছু। ওর নাম ছিল- হরগৌরী।

আরও পড়ুন: মৃত ছেলের শোক নিয়েই বাটামাছের বিকিকিনি! গ্রামের হাটে-বাজারে নানা রঙের গল্প

কয়েকমাস আগেও বালিকা কাননবালা বাবা ধুলোর পিছন পিছন গরুছাগলের হাটের পাশে বসে থেকে বাঁশের জিনিস বিক্রি করেছে। দেখেছে, কীভাবে কঞ্চির কাবাড়ি ঝুড়ি হয়ে যায় হাতের পরিশ্রমে। পাটের দড়ি দিয়ে গড়া চটের বস্তায় সে পয়সা গুনে রেখেছে। আটার রুটি কিনে খেয়ে দু'হাতে চুমুক দিয়ে খেয়েছে নদীর জল। সুপারির ব্যাপারিদের মুখে শুনেছে- "বটগাছের হিকড়ের কাসে যে গুদামঘর দেহা যায় ওর নিচের পানি লাল হইয়া গেসিল মাইনষের রক্তে... রায়ট... "

ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রাতে উঠোনের ফুলফলবাগানের দিকে চাইলে ডর লাগে। পাঁচজন মেয়ে দুই ছেলে-বাবার কোল ঘেঁষে শুয়ে আছে। জোনাকি জ্বলছে। শিশুবালা বলে,

'আইছ্যা, ইন্ডিয়ায় নদী আসে?'

কোনও উত্তর নেই।

'বাবা, আমরা চইল্যা যামু?'

পিতা এবার ধীরে ধীরে বললেন একটি শব্দ, হ।

'আমাগো ঘুম আসতিসে না বাবা, আপনে একখানা পরানকথা কন... '

বাবার গলার স্বর এবারে হুঁকো টানার শব্দের মতো হয়ে আসে। ধীরে ধীরে সেকথা বলা শুরু করে। সে এই গল্প শুনেছিল তার বাবার কাছে। গল্পটি এইরকম,

পরাণ মণ্ডল নামে একজন চুনের বেসাতি করত ঘুরে ঘুরে। বহু নদীনালা জঙ্গলের দেশ পার হতো। বড় বড় চুলদাড়ি। সকাল-সন্ধে আকাশের দিকে চেয়ে থাকত।একদিন এক জঙ্গলে মোটা গাছের গুঁড়িতে সে বসেছে তামুক খাবে বলে। প্রাচীন গাছের গুঁড়ি শ্যাওলা জমে হলুদ। যেই না চকমকি ঠুকেছে, ওমনি গুঁড়ি নড়ে উঠেছে। গুঁড়ি আসলে ছিল বুড়ো ময়াল সাপ। এই ঘটনায় তার মন উদাস লাগে। সে নদী পার হতে গিয়ে খেয়া পায় না। তখন কাঁধের গামছা আড়াই হাত করে জলে বিছিয়ে তার ওপর বসে নদী পার হয়। সেই হাতে বোনা ঘামে ভেজা রংজ্বলা গামছা নদী পারাপার করে দিয়েছিল পরাণ মণ্ডলকে...

গল্পের ভিতর ঘুমিয়ে পড়ে পুত্রকন্যা। ভোরবেলা কিশোরী মাইয়াদের সুন্দর মুখে কালো কালি লেপে দেওয়া হয় লন্ঠন থেকে পাতায় কালি নিয়ে। যাতে কোনও রং না জেগে ওঠে, যাতে শয়তান হাত না বাড়ায় এই মাইয়্যাগো দিকে।

বড় বড় পাটগাছ। নদীর জলে ঢেউ। বড় লিচুগাছের তলায় থোপা থোপা অন্ধকার। ছাইগাদার পাশে মানঝোপ। ওখানে নদীর মাছ কোটা হতো। সব ছেড়ে চলে যাওয়া...

গোয়ালঘরে গরুদের সঙ্গে ঘুমিয়ে, খিদের পেটে মানুষের ভালবাসার দান ঘটিভরতি খেজুর রসে চুমুক দিয়ে পেট ভরানো। পথের লোকজন এরা সব। দিদিমা ময়নার গায়ে তুষের চাদর। সেটা ঘোমটার মতো মাথায় তুলে সে বলে, 'এই হগলডি মানুষ দয়াল পাঠাই দিসে আমাগো লইগ্যা...'

এরপর এক নাম না জানা গ্রামে আসতে গিয়ে জিনিসপত্রের অর্ধেক চুরি হয়ে গেল। হতভম্ব পরিবার বোবা হয়ে হাঁটছে। মাটির হাঁড়িটি পরিবারের একজনের মতো সঙ্গে রয়েছে।

অনেক কষ্টে এপারে এসে খিদের পেটে সস্তা ভাতের হোটলে সবাই বসেছে। চোখমুখে বদ হাওয়ার ঝাপটা লেগে লাল। সারা শরীর কেমন সুতোর মতো ঝুরঝুর! এরা সব সহ্য করেছে। অমঙ্গল পাখির ডানার ঝাপট।

হোটেলে খাবার দেওয়া হয়েছে, ভাত, ডাল,আলুভাজা, সজনে ডাঁটার তরকারি।

সজনে ডাঁটা দেখে অবাক হয়ে ভাবছে, 'এইডা আবার কীসের বেন্নুন!' না ছোঁওয়া ডাঁটা ডাঁই হয়ে থাকছে পাতে।

মাটির হাঁড়ি থেকে সরষেমেশানো তেলাকুচা পাতা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে রাঁধা ইলিশ বের করা হলো। আহ! কী তার বাস! ওপারের জলের আশ্চর্য মাছ এপারের ডাঙায় বসে খাওয়া হচ্ছে। সরষের ঝাঁঝে নাকি অন্য কারণে, এদের সকলের চোখে জল।

মাটির হাঁড়িটা খাওয়া শেষে ধুয়ে রাখবে। জাম্বুরা বাগানের ওধারে বসতি করা হরি পালের গড়া হাড়ি।আর কোনও দিন তার সঙ্গে দেখা হবে না।

দূর থেকে আমি দেখতে পাচ্ছি, দুঃখমুহ্যমান এরা সবাই শুধু মাছের ঝুল খাচ্ছে না ভাত দিয়ে মেখে, একটু একটু করে মাছের সঙ্গে খাচ্ছে তীব্র শোক আর তীব্রতর ব্যথা, স্মৃতি। না হলে এরা যে বাঁচতে পারবে না।

এই গল্প বহুবার শুনে শুনে আমি স্পষ্টত সবটা চলচ্চিত্রমালার মতো দেখতে পাই। সেই গল্প বলার লোকগুলি, দেশভাগের স্মৃতি বুকেপিঠে আঁকড়ে নিয়ে যারা বেরিয়েছিল, তারা ধীরে ধীরে টুপটাপ করে মুছে যাচ্ছে, গল্পগুলোর মতোই। একদিন সবটা ঢেকে যাবে কুয়াশায়।

More Articles