বিজেপিতে হার্দিক, গুজরাতের ভোটে কতটা লাভ হবে শাসক দলের?

সব জল্পনা সত্যি করে আগামী বৃহস্পতিবার বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন পতিদার আন্দোলনের প্রভাবশালী এই নেতা। জোরালো সূত্রে এই খবর জানা গেছে।

হার্দিক প্যাটেলকে দলে টানার প্রয়োজন ছিল বিজেপির, একথা বলাই বাহুল্য। সামনেই গুজরাত ভোট। এর চেয়ে ভালো সময় আর কী হতে পারে? জল্পনা ছিল, এবার তা রূপায়ণের পালা। হার্দিক প্যাটেল কয়েকদিন হলো কংগ্রেস ছেড়েছেন। এরপর তিনি কোন শিবিরে নাম লেখাবেন, তা নিয়ে জাতীয় রাজনীতি কম আলোড়িত হয়নি। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বিজেপির নাম নিয়ে। সেখানে তাঁর যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। এর যথেষ্ট কারণ আছে। সব জল্পনা সত্যি করে আগামী বৃহস্পতিবার বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন পতিদার আন্দোলনের প্রভাবশালী এই নেতা। জোরালো সূত্রে এই খবর জানা গেছে।

 

২৮ বছরের গুজরাতের পতিদার নেতা ২০১৯ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। পতিদার আন্দোলন থেকে তাঁর রাজনীতিতে আসা। ১৮ মে তিনি হাত ছাড়েন। সোনিয়া গান্ধীকে পদত্যাগপত্র পাঠান রাহুলকে একহাত নিয়ে। গুজরাতের কংগ্রেস নেতাদেরও তিনি ছেড়ে কথা বলেননি। এই অবস্থায় তিনি প্রকাশ্যে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেননি। তবে তাঁর মুখে বিজেপির যে প্রশংসা শোনা যায়, তা বুঝিয়ে দেয় যে, গল্পের ক্লাইম্যাক্স অন্যদিকে ঘুরবে। সেটাই এবার হতে চলেছে।

 

আম আদমি পার্টি তাঁর জন্য আগে আমন্ত্রণপত্র তৈরি রেখেছিল। তবে পতিদার নেতাকে বলতে শোনা যায়, তিনি এখনও ঠিক করেননি যে, কোন দলে যাবেন। তবে রাজনীতির কারবারিরা তাঁর কথার মধ্যে বিজেপি শিবিরে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছিলেন। তিনি কংগ্রেসকে তুলোধোনা করে বলেছিলেন, ৩ বছর সময় নষ্ট করেছেন।

 

আরও পড়ুন: বিজেপি বিরোধী রাজ্য মানেই সিবিআই-ইডি-র সাঁড়াশি চাপ! কলকাতা থেকে কাশ্মীর- গল্পটা একই

 

হাতের সঙ্গে এত দ্রুত তাঁর যে মধুচন্দ্রিমা পর্ব শেষ হল, সেটা কি নেহাতই দায়বদ্ধতা? বোধহয় নয়। কারণ সামনে গুজরাত ভোট। আর সেখানে বড় ফ্যাক্টর পতিদাররা। তাঁরা সবসময় মোদি রাজ্যে ভোটের অঙ্ক ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই হার্দিককে পাশে পাওয়ার দায় ছিল বিজেপির। এর জন্য কী চাল চাললেন মোদি-শাহরা? সেকথায় আসার আগে দেখে নেওয়া যাক, পতিদার গুজরাতে এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই কি হার্দিককে ধরে টানাটানি!

 

পতিদার আন্দোলন থেকে উঠে এসে কংগ্রেসে যোগ দিলেও হার্দিক প্যাটেল দল ছেড়েছেন। পতিদার আন্দোলনের মুখ হার্দিকের লড়াই ছিল কার্যত বিজেপির বিরুদ্ধে। তাই স্বাভাবিকভাবে তিনি কংগ্রেসের সমর্থন পান এবং পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। তবে হাতের সঙ্গে তাঁর মধুচন্দ্রিমার পিরিয়ড বেশিদিন স্থায়ী হল না। এই অবস্থায় পতিদাররা যদি পুরোপুরি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তাদের লড়াই যে বিশাল কঠিন হবে, তা বলাই বাহুল্য। তাই তারা চুপ করে বসে ছিল না।

 

কংগ্রেস নেতারা রাজকোটে পতিদার সমাজের নেতা নরেশ প্যাটেলের বাড়িতে যান। নরেশ প্যাটেল পতিদারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় লেউভা প্যাটেলদের সংস্থা, শ্রী খোদালধাম ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে নরেশের প্রভাবের জন্য বিজেপি, আম আদমি পার্টিও তাঁকে দলে টানতে চেয়েছে। এআইসিসি-তে গুজরাতের ভারপ্রাপ্ত নেতা রঘু শর্মা ও গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি জগদীশ ঠাকুর যখন রাজকোটে নরেশ প্যাটেলের সঙ্গে প্রাতঃরাশের টেবিলে বৈঠক করছেন, সেই একই সময়ে দিল্লি থেকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে কুণ্ডলধাম স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের যুব শিবিরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বক্তৃতা দিয়েছেন। পতিদারদের মধ্যেও স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের প্রভাব প্রবল। মোদিও অন্য পথে পতিদারদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন।

 

বাংলায় যেমন উত্তর ২৪ পরগণার কিছু অংশে মতুয়া ভোট নিয়ে হইচই হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, গুজরাতে তেমনই এই পতিদারদের ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরা ভোটের হাওয়া সম্পূর্ণ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারে। ঘটনা হলো, এই সম্প্রদায়টি গুজরাতকে অতীতে চার জন মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছে। বিজেপি ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর পতিদারদের মন জয় করার জন্য অনেক কাজ করেছে। যে উল্লেখযোগ্য অংশ হার্দিক প্যাটেলের প্রভাবে কংগ্রেসে আগে চলে গিয়েছিল, তাদের ভোট ফেরাতে সক্ষম হয় বিজেপি।

 

এর আগে দেখা যায়, বিরোধীদের ঘায়েল করতে সিবিআই ও ইডির জুজু কাজে লাগিয়েছে বিজেপি। 'ভোঁতা’ হলেও কাজে এসেছে এই অস্ত্র। উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীকে ইডি জুজু দেখানো হয়, পরিণামে সেই রাজ্যে দানা বাঁধে না বিরোধী ঐক্য। লাভের গুড় ঘরে তোলেন যোগী। ২০২৪-এর দিকে তাকিয়ে বিরোধীরা এককাট্টা হওয়ার চেষ্টা করছিল। সেই চেষ্টাতে জল ঢেলে দেয় বিজেপি। বিরোধীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে লড়াইয়ে নামার চেষ্টা করছিল। পিসিকে বিপাকে ফেলতে এবার ভাইপোর পেছনে সিবিআই ও ইডি জুজু। হার্দিকের ক্ষেত্রে এই অস্ত্র কাজ দেয়নি। তবে জেলে যাওয়ার ভয় নাকি তাঁকেও তাড়া করেছে।

 

হার্দিকের হাত ছাড়া নিয়ে অবিলম্বেই ময়নাতদন্ত শুরু হয়। কংগ্রেস নেতারা দাবি করেন, জেলে যাওয়ার ভয়েই পতিদার নেতা দল ছেড়েছেন। এই ভাবনা কতটা যুক্তিযুক্ত? কান পাতা যাক কংগ্রেসের অন্দরে।

 

পতিদার নেতার এই দলত্যাগের পর প্রত্যাশিতভাবে আক্রমণের পথে নামে গুজরাত কংগ্রেস। রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি জগদীশ ঠাকুর হার্দিকের দলত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মতে, হার্দিকের বিরুদ্ধে যে দেশদ্রোহিতার মামলা চলছে, তার জন্য তাঁকে জেলে যেতে হতে পারে। সেই কারণে দলত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই পতিদার নেতা। হার্দিক দলত্যাগের পর কী করবেন? এই নিয়েও জল্পনা ছিল তুঙ্গে। কানাঘুষো শোনা গিয়েছিল যে, তিনি জেলে যাওয়ার ভয়েই বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন। কারণ যাই হোক, মোদ্দা কথা হল হার্দিককে পাশে পেয়ে গুজরাত ভোটে নিজেদের কয়েক কদম এগিয়ে রাখলেন মোদি-শাহ-রা।

 

শতাব্দীপ্রাচীন দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা চরমে, তার ওপর ভাঙনের চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে দলের অন্দরে। রেমিডি হয়ত জানা নেই সোনিয়া গান্ধীরও। তিনি নিজে আসরে নেমেও হালে পানি পাচ্ছেন না।

 

কংগ্রেসকে চাঙ্গা করতে সোনিয়া গান্ধী যখন ফের সক্রিয়, ঠিক তখনই একের পর এক ধাক্কায় অস্বস্তিতে কংগ্রেস। রাজস্থানের উদয়পুরে তিনদিন ব্যাপী ‘নব সংকল্প চিন্তন শিবির’ চলাকালীনই দল ছাড়েন পাঞ্জাবের প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি সুনীল জাখর। একইভাবে এরপর ইস্তফা দেন গুজরাতের পতিদার আন্দোলনের নেতা হার্দিক প্যাটেলও। এরপর কি কেরলের নেতা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কেভি থমাস?

 

পাঁচ রাজ্যের ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে। এবার গুজরাত ভোট বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানেই হার্দিককে সঙ্গে নিয়ে ক্রিজে নামার জন্য গা ঘামাতে শুরু করল মোদি ব্রিগেড। কংগ্রেসের গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটবে না তো!

 

More Articles