পুরুষদের মধ্যে হু হু করে বাড়ছে প্রস্টেট ক্যানসার, কোন অভ্যাস ডেকে আনছে বিপদ?

হাড় বা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগে এর তেমন কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না। তবে ছোটখাটো লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষরা উপেক্ষা করে যান এবং মারাত্মক বিপদ ডেকে আনেন নিজের জন্য।

 

সারা বিশ্বে ফুসফুসের ক্যানসারের পর প্রস্টেট ক্যানসারেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পুরুষের মৃত্যু হয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করা গেলে অন্যান্য ক্যানসারের মতো প্রস্টেট ক্যানসার থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে পরিসংখ্যান বলছে, শুধুমাত্র ভারতেই প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত একজন পুরুষ সর্বোচ্চ ৫ বছর বছর বেঁচে থাকেন। চিন্তার বিষয় হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণগুলি চিনতে পারা যায় না। সমস্যা যখন মারাত্মক আকার নেয়, তখন আর কিছুই করার থাকে না। সাধারণত ষাটোর্ধ্ব পুরুষদের মধ্যে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে সাম্প্রতিক কালে অল্পবয়সিদের মধ্যেও প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে পুরুষদের সতর্ক করেছেন। চলুন প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণগুলি ভালোভাবে বুঝে নেওয়া যাক। একে অন্য রোগের সঙ্গে গুলিয়ে ভুল করবেন না একদম।

প্রস্টেট ক্যানসার কী?
আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, পুরুষদের প্রস্টেট গ্রন্থির কোশগুলি অনিয়ন্ত্রতভাবে বাড়তে শুরু করলে সেই অবস্থাকে প্রস্টেট ক্যানসার বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রস্টেট একটি ছোট আখরোটের আকারের গ্রন্থি, যা পুরুষদের পেলভিক অংশে মূত্রাশয়ের পাশে অবস্থিত। এটি সেমিনাল তরল উৎপন্ন করে, যা স্পার্মকে পুষ্টি জোগায় এবং পরিবহণে সাহায্য করে।

প্রাথমিক পর্যায়ে এই ক্যানসারকে চিহ্নিত করা যায় না কারণ হাড় বা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার আগে এর তেমন কোনও লক্ষণ চোখে পড়ে না। তবে ছোটখাটো লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষরা উপেক্ষা করে যান এবং মারাত্মক বিপদ ডেকে আনেন নিজের জন্য।

আরও পড়ুন: গোটা বিশ্বে হু হু করে বাড়ছে গরম, তবু এসি ছাড়া চলা সম্ভব?

লক্ষণ
যেহেতু প্রস্টেট গ্রন্থি পুরুষদের মূত্রাশয় ও মূত্রনালীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই প্রাথমিক পর্যায়ে মূত্রত্যাগের একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হন আক্রান্ত ব্যক্তি। তবে টিউমারের আকার ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে যে লক্ষণগুলি দেখা যায়,

১. মূত্রত্যাগে অসুবিধা বা ব্যথা অনুভব হতে পারে। কষ্টপূর্ণ বীর্যপাত ও মূত্রত্যাগ এই রোগের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

২. রাতে বার বার মূত্রত্যাগ করলেও সাবধান হোন। বয়সজনিত কারণ ছাড়াও ঘন ঘন মূত্রত্যাগ প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ। তাই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৩. মূত্রত্যাগ শুরু করতে বা থামাতে সমস্যা হতে পারে।

৪. মূত্র বা বীর্যের সঙ্গে রক্ত নিঃসৃত হওয়াও প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ।

৫. মূত্রত্যাগে অক্ষমতা, প্রস্রাব চেপে রাখতে না পারা এই ক্যানসারের লক্ষণ।

শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে গেছে কি না কীভাবে বুঝবেন?

প্রাথমিক লক্ষণগুলি অবহেলা করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্টেট গ্রন্থি থেকে ক্যানসার দেহের অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে হাড়, লিম্ফ নোডের মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। প্রস্টেট ক্যানসার মারাত্মক আকার ধারণ করলে যে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়, সেগুলি হলো,

১. পেলভিক অংশে বা কুঁচকির দিকে ফোলা ভাব

২. পা ও পায়ের পাতা অসাড় হয়ে যাওয়া

৩. দীর্ঘ সময়ের জন্য হাড়ে ব্যথা অনুভব হওয়া বা যে-কোনও কারণে সহজেই হাড় ভেঙে যাওয়া প্রস্টেট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।

৪. অন্ত্রের সমস্যা

৫. পিঠে বা কোমর-সংলগ্ন অংশে ব্যাথা

৬. নিশ্বাসের দুর্বলতা

৭. হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া

অল্পবয়সি পুরুষদের সতর্ক হওয়া উচিত
যদিও ষাট বছরের বেশি পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি, কিন্তু অল্পবয়সি পুরুষদেরও সাবধান হওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি পুরুষদের মধ্যে প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণেই নিয়মিত স্ক্রিনিং, রোগের উপসর্গগুলি ভালোভাবে লক্ষ রাখতে হবে। চিকিৎসকদের মতে, বয়স্ক পুরুষদের মতো কমবয়সিদের মধ্যে এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও তাঁদের বাঁচার সম্ভাবনা কম।

কাদের ঝুঁকি বেশি?
প্রস্টেট ক্যানসারের প্রকৃত কারণ না জানা গেলেও বেশ কিছু নির্দিষ্ট কারণে এই ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে বার্ধক্য, পারিবারিক ক্যানসারের ইতিহাস, স্থূলতা প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে একটি। পরিবারের কোনও পুরুষ সদস্য প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হলে পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে এই ক্যানসারের ঝুঁকি দশ গুণ বেড়ে যায়। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাও দায়ী এই রোগের জন্য।

পরীক্ষা
এই ক্যানসার নির্ধারণের একমাত্র হাতিয়ার হলো পিএসএ টেস্ট বা প্রস্টেট-স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট। রক্তে পিএস-এর মাত্রা সাধারণত ৪-এর মধ্যেই থাকে। কিন্তু পরীক্ষায় পিএস-এর মাত্রা চারের বেশি হওয়া মানেই ওই ব্যাক্তি প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত।

করণীয়
প্রস্টেট সুস্থ রাখতে এবং ক্যান্সার এড়াতে যে কাজগুলি করতে হবে,

১. খাদ্যতালিকায় কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ফল এবং শাকসবজি রাখুন। পরিবর্তে লাইকোপেনযুক্ত খাবার বেছে নিন। লাইকোপেন একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা লাল রঙের খাবারে পাওয়া যায়।

২. শরীর ফিট থাকলে প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পেতে পারে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে দৌড়োনো, জগিং, সাইক্লিং এবং সাঁতারের মতো শরীরচর্চা করতে পারেন।

৩. গবেষণায় দেখা গেছে যে, পুরুষদের বীর্যপাত বেশি হয় তাদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক কম। ২০-২৫ বছর বয়সি পুরুষদের জন্য মাসে ২১ বার বীর্যপাত প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। বীর্য জমা থাকলে তা প্রস্টেটের সাধারণ ফাংশনকে ব্যাহত করে এবং প্রস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. অ্যাভোক্যাডো, অলিভ অয়েল, আমন্ড, আখরোট সয়াবিন, মটর ডাল ও টোফুর মতো খাবার প্রস্টেট ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৫. ধূমপান ত্যাগ করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত এমন রোগী ধূমপান ত্যাগ করে ধূমপায়ী রোগীদের তুলনায় বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেন।

 

 

More Articles