ভয়ংকর তাপপ্রবাহ বাংলাজুড়ে, আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা, কীভাবে বাঁচবেন?

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রবল তাপপ্রবাহ চলবে অন্তত ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত, জানানো হল আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের তরফ থেকে। ২৫ ও ২৬ এপ্রিল, এই দুই দিনই দক্ষিণবঙ্গের রাজ্যগুলিতে তাপপ্রবাহ চলবে। তবে খানিক সুরাহা পাবে পূর্ব মেদিনীপুর ও দুই চব্বিশ পরগণা। ২৭ ও ২৮ এপ্রিল এই অবস্থা আরও শোচনীয় হবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম এবং বীরভূম-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। তবে ছাড় পাচ্ছে না উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিও। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, ২৫ থেকে ২৭ এপ্রিল মালদা ও দক্ষিণ দিনাজপুরে প্রবল হবে তাপপ্রবাহ।

আজ ২৬ এপ্রিল কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছবে। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ৩৪ শতাংশ।

কেন হচ্ছে তাপপ্রবাহ?

যখন কোনও অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি হয়, সেই অবস্থাকে তাপপ্রবাহ বলে। পাহাড়ি অঞ্চলের ক্ষেত্রে কিন্তু তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি হলে, সেই অবস্থাকে তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপপ্রবাহ প্রতি বছরই হয়, বিশেষ করে পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতো জেলাগুলিতে। কিন্তু এই বছর উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে দেখা দিচ্ছে তাপপ্রবাহ বা হিট ওয়েভ। অন্যান্য বছর সেগুলোর মেয়াদ এক থেকে দু'দিন থাকলেও, এই ক্ষেত্রে দুই দিনের বেশি দেখা দিচ্ছে তাপপ্রবাহ। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের সহ-অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এর অন্যতম কারণ কালবৈশাখী না হওয়া। তিনি জানাচ্ছেন, কলকাতা শহরে গত পঞ্চান্ন দিনে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। ফলে গরম বেড়েছে উত্তরোত্তর। তিনি আরও জানাচ্ছেন, এই সময়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর নিম্নচাপ তৈরি হয়, ফলে কিছু জলীয় বাষ্প পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। আর তার ফলে বৃষ্টিপাত হয়। এই বছর কিন্তু বঙ্গোপসাগরে যে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গের উপকূল থেকে অনেক দূরে। এবং সেই বাতাস স্থলপথ দিয়ে ঘুরে আসার সময় অধিকাংশ পরিমাণ জলীয় বাষ্প হারিয়ে ফেলে। ফলে যে বাতাস প্রবেশ করছে, তা আদতে জলীয় বাষ্প-হীন শুষ্ক বাতাস।

আরও পড়ুন: তাপমাত্রা ৪০ পার! তীব্র তাপপ্রবাহে সুস্থ থাকতে এই খাবারগুলি ভুলেও খাবেন না

তিনি আরও জানাচ্ছেন, দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস, এই সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে বৃষ্টিপাত ঘটায়। ফলে উত্তরবঙ্গেও বৃষ্টিপাত হয়। আর এই দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসের প্রভাবে, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার থেকে বয়ে আসা তাপপ্রবাহ, বেশি দূর এগোতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাপপ্রবাহের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দক্ষিণ-পূর্ব ভারত থেকে বয়ে আসা জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস। এই বছর কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব ভারত থেকে বাতাস বয়ে আসছে না। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত থেকে শুষ্ক এবং গরম বাতাস ক্রমাগত প্রবেশ করছে পশ্চিমবঙ্গে।

জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ কি আছে তাপপ্রবাহের নেপথ্যে?

সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, আন্দাজ করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে, যদিও তা গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ-সাপেক্ষ। কারণ একটি বছরে আবহাওয়ার খামখেয়ালি রূপ দেখে, সেই অঞ্চলের সামগ্রিক জলবায়ুর চরিত্র জানানো যায় না। তবে সঞ্জীববাবুর মতে, পরিবেশবিদরা যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা যে সত্যি হচ্ছে, তা হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। কী সেই আশঙ্কা? পরিবেশবিদরা আগেই জানিয়েছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা যত দিন যাবে, ততই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার মুখোমুখি হব। এই বছরের শুরুর দিকে ফিরে তাকালে দেখব, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। যা অস্বাভাবিক। মার্চ মাসে বঙ্গোপসাগরে দু'বার ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে, যা সাধারণত হয় না। এদিকে এপ্রিল মাসে কালবৈশাখী-বিহীন গ্রীষ্মকাল। আমরা কিন্তু এত চরম অবস্থা আগে দেখিনি। সঞ্জীববাবুর মতে, আগে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে সামগ্রিকভাবে দেখা যেত, এখন কিন্তু আঞ্চলিক স্তরেও এর প্রভাব দেখতে পাচ্ছি আমরা। যা সত্যি-ই ভয়ের।

কী করবেন তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে?

পশ্চিমবঙ্গ বিপর্যয় ব্যবস্থাপণ এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, জল তেষ্টা না পেলেও জল খান, সঙ্গে রাখুন জলের বোতল। বাইরে বেরোনোর সময় হালকা রঙের ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। চেষ্টা করুন, ছাতা বা টুপি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে। এই সময়ে যতটা সম্ভব হালকা খাবার খান, জলের পরিমাণ বেশি আছে, এমন ফল খান বেশি করে। দিনের বেলা ঘরের দরজা-জানলা যতটা সম্ভব বন্ধ রাখুন। ঘর ঠান্ডা রাখতে দরকা-জানালায় পরদা, খসখস, সানশেড ইত্যাদি ব্যবহার করুন। তবে রাতের বেলা জানলা-দরজা খোলা রাখতে ভুলবেন না। এতে ঘর ঠান্ডা হবে। এই সময় হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করলে, দেরি না করে স্থানীয় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

কোনও ব্যক্তি হিট স্ট্রোকে অসুস্থ হলে তাঁর প্রাথমিক যত্ন কীভাবে নেবেন?

পশ্চিমবঙ্গ বিপর্যয় ব্যবস্থাপণ এবং অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তরের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, হিট স্ট্রোকে কোনও ব্যক্তি আক্রান্ত হলে, তাঁকে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসুন। নিদেনপক্ষে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা বা ছায়াযুক্ত জায়গায় নিয়ে আসুন। ভিজে কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে সারা শরীর মুছিয়ে দিন যত দ্রুত সম্ভব। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরার পরে ওআরএস বা লেবু, নুন, চিনির সরবত পান করতে দিন, যাতে শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। অবস্থার উন্নতি না হলে, দেরি না করে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যক্তিকে নিয়ে যান।

তাপপ্রবাহ চলাকালীন কী কী করবেন না?

চেষ্টা করুন, প্রখর সূর্যালোককে যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে। পরিশ্রমসাধ্য কাজ রোদের মধ্যে না করাই ভালো। থামিয়ে রাখা গাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ অবস্থায়, তার ভেতর শিশু ও পোষ্যদের কোনওভাবেই রেখে যাবেন না। এই সময় বেশি প্রোটিন এবং তেল-মশলাযুক্ত খাবার না খাওয়াই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

More Articles