সমস্ত নীল চোখের মানুষের পূর্বপুরুষ কি একই?

একবার ভেবে দেখুন, পৃথিবীর কোন একজন প্রান্তে আপনার একজন আত্মীয় আছে, আপনি সেই ব্যাপারে নিশ্চিত, কিন্তু তার সাথে আপনার এখনো পরিচয়টাই হয়নি! খুবই অদ্ভুত ব্যাপার মনে হচ্ছে? অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছে না? তবে এমনটাই কিন্তু পৃথিবীর সকল নীল চোখের মানুষের সাথে সত্য। সমস্ত নীল চোখের ব্যক্তি যারা আছেন পৃথিবীতে, কিংবা ভবিষ্যতে যারা আসবেন, তারা সকলেই একটি সাধারণ কেন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত। তাদের দূরবর্তী যে কোন আত্মীয়কে তারা শুধুমাত্র চোখের রঙ দেখে চিনে ফেলতে পারবেন। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি গবেষণায় সম্প্রতি এরকমই একটি সাড়া ফেলে দেওয়া বিষয় উঠে এসেছে।

 

একটি গবেষক দল পৃথিবীর নীল চোখের মানুষদের ওপরে একটি গবেষণা চালিয়েছে সম্প্রতি, যাতে দেখা যাচ্ছে, ৬ থেকে ১০ হাজার বছর আগে এমন একটি জেনেটিক মিউটেশন ঘটেছিল, যার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল নীল চোখের ব্যক্তিরা একটি কেন্দ্রে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছেন। সেই দলের প্রধান অধ্যাপক হ্যান্স রুডলফ লিচোফ আইবার্গ বিষয়টিকে একটি অদ্ভুত রকমের জেনেটিক মিউটেশন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ৬০০০ থেকে ১০০০০ বছর আগে কোন একজন ব্যক্তি একটি অদ্ভুত রকমের জেনেটিক মিউটেশন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার দেহের ওই মিউটেশনের বিশেষত্ব ছিল, তার দেহে মেলানিনের পরিমাণ সীমাবদ্ধ।

 

সহজ কথায় ব্যাখ্যা করতে গেলে, মেলানিনের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে চোখ বাদামি কিংবা কালো না হয়ে অনেকটা নীলচে দেখায়। আর এই মিউটেশন একটি প্রজন্মে থেমে থাকেনি। ওই ব্যক্তির থেকে তার পরবর্তী প্রজন্ম, তার থেকে তার পরবর্তী প্রজন্ম হয়ে হয়ে মানবজাতিতে ছড়িয়ে গিয়েছে ওই মিউটেশন। এই মিউটেশনের ফলে আবির্ভাব ঘটেছে নীল চোখের এবং আজকে বিশ্বে যতজন নীল চোখের মানুষ রয়েছেন সবার চোখ নীল হওয়ার কারণ এই একটাই। সাধারণত যাদের কালো কিংবা বাদামী রঙের চোখ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে চোখের রঙ্গক নির্ধারণ করার জিন টির নাম হল OCA2। কিন্তু, দীর্ঘ কয়েক বছরের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, যাদের চোখের রং নীল, তাদের ক্ষেত্রে এই জিন থাকেই না। বদলে তাদের দেহে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি জিন দেখতে পাওয়া যায়, HERC2। গবেষকরা জানিয়েছেন, এই জিন পরিবর্তনের কারণেই মূলত চোখের রং পরিবর্তন হয়েছে এই নীল বর্ণের চোখের মানুষদের। আর এই জিনটি এসেছিল তাদের ৬০০০ থেকে ১০০০০ বছর আগের কোন পূর্বপুরুষের কাছ থেকে। প্রত্যেক নীল চোখের মানুষের দেহে এই মিউটেশন লক্ষ্য করা যাবে। নীল রঙের চোখ একটি একক জেনেটিক মিউটেশনের ফল। এই কারণেই, বলা চলে, পৃথিবীকে নীল চোখের প্রতিটি ব্যক্তির সাধারণ একজন পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে।

 

একটি জেনেটিক্স জার্নালে একটি বিশেষ রিপোর্ট প্রকাশিত করে লিখেছিলেন, জেনেটিক লিংকেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে নীল চোখের রং কে সুক্ষ্মভাবে ম্যাপ করেছিলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় এর এই গবেষক দল। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে, চীনের একটি শনাক্ত যোগ্য গোষ্ঠী একক পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই বিশেষ মিউটেশন লাভ করেছিল। একক পিতামাতার কাছ থেকে এই মিউটেশন পাওয়ার কারণে এই জিনের গোষ্ঠীকে বিজ্ঞানের ভাষায় হ্যাপ্লোটাইপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গবেষণার সময়, এই হ্যাপ্লোটাইপ ডেনমার্কের ১৫৫ জন, তুরস্কের ৫জন, এবং জর্ডনের ২জনের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়াও মাইটোকনড্রিয়ান ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে, শত শত হাজার বছর পূর্বে মাতৃ সম্পর্কীয় বংশের একটি মিউটেশনের ধরনও পাওয়া গিয়েছিল। প্রফেসর আইসবার্গ বলছেন, চোখের রঙে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যেমন - বাদামি, ধূসর, কালো, সবুজ সবকিছুই নির্ভর করে চোখের মনি অর্থাৎ আইরিসের মধ্যে থাকা মেলানিনের পরিমাণ এর উপরে। কিন্তু, তফাত আছে নীল চোখের ব্যক্তিদের মেলানিনের পরিমাণ এর ক্ষেত্রে। বাদামী চোখের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মেলানিন এর উপাদান নিয়ন্ত্রণকারী স্বতন্ত্র প্রকরণ পাওয়া যায়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, নীল চোখের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মেলানিনের পরিমাণ এর সামান্য রকম তফাৎ আছে।

 

পাশাপাশি প্রফেসর আইসবার্গ এবং তার দল মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষা করে জর্ডান, ডেনমার্ক এবং তুরস্কের মত বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশগুলোতেও নীল চোখের মানুষ দের ডিএনএ পরীক্ষা করেছেন এবং চোখের রং এর তুলনা করেছেন। তার এই গবেষণায় উঠে এসেছে, নীল চোখের মানুষদের ক্ষেত্রে চোখের রং নির্ধারণকারী এই রঙ্গক OCA2 না HERC2। এই সীমিত জেনেটিক প্রকরণ এর কারণেই নীল চোখের মানুষ জিনগত দিক থেকে সাধারণ চোখের মানুষের থেকে কিছুটা আলাদা। তবে, এর একটি প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে। সম্ভবত মানুষ যখন আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসতে শুরু করেন তখন থেকে শুরু হয় এই বিশেষ ধরনের জিনের ছড়িয়ে পড়া। প্রথমদিকে, শুধুমাত্র ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের ক্ষেত্রে এই নীল চোখ দেখা যেত। কিন্তু আস্তে আস্তে এখন সারা বিশ্বে এই নীল চোখের মানুষ ছড়িয়ে পড়েছেন। আর তার প্রত্যক্ষ কারণ হলো ইউরোপীয়দের উপনিবেশ সৃষ্টি এবং আফ্রিকা এবং অন্যান্য মহাদেশের মানুষের ইউরোপে বিচরণ। অর্থাৎ এটাও বলা চলে, সমস্যা নীল চোখের লোকেরা একক ইউরোপীয় পূর্বপুরুষের বংশধর। অর্থাৎ এখান থেকে উঠে আসে একটি অসাধারণ ফ্যামিলি ট্রি, যার হয়তো ৯৯% মানুষ একে অপরকে চেনেন না 

প্রফেসর আইসবার্গ আরো বলেন, "এটি কেবল দেখাচ্ছে যে প্রকৃতি ক্রমাগত মানুষের জিনোমকে বদলে চলেছে। মানুষের ক্রোমোজোমের জেনেটিক ককটেল তৈরি করে বৈশিষ্ট্যগতভাবে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে।" তবে চোখের রং কিন্তু একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। মিউটেশনের জন্য আরো বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হলো উচ্চ মেলানোমা ঝুঁকি ( এটি এক প্রকার ত্বকের ক্যান্সার), প্রতিযোগিতামূলক জায়গায় উচ্চ হওয়ার সম্ভাবনা এবং নিম্ন ভিটিলিগো ( ভিটিলিগো এক ধরনের চর্মরোগ)। প্রফেসর আইসবার্গের এই গবেষণা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, সমস্ত নীল চোখের ব্যক্তিরা একটি নির্দিষ্ট পূর্ব পুরুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাদের ডিএনএতে কোন না কোন একটা জায়গায় একটা মিল রয়েছে, যা তারা পেয়েছে উত্তরাধিকারসূত্রে। অর্থাৎ, পৃথিবীতে যত নীল চোখের মানুষ আছেন তারা পরস্পর একটা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ, যা তাদের নিজেদেরই অজানা।

 

More Articles