পায়ে চটিজুতো পরে প্রবেশ নিষেধ, জীবনে আর এশিয়াটিক সোসাইটি যাননি বিদ্যাসাগর

রেলি ব্রাদার্সের একখানি কাপড়কে দুভাগ করে একখণ্ড পরতেন আর একখণ্ড গায়ে দিতেন। পায়ে থাকত দেশি মুচির শুঁড়তোলা চটিজুতো। শুধু তাই নয়, তাঁর সামনের চুল অবাঙালিসুলভ ছাঁটা।  উনিশ শতকে তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছিল। শান্তিপুরের তাঁতিদের কাপড়ে উঠে এসেছে তাঁর নাম। একপলক দেখার জন্য উদ্গ্রীব জনতা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অথচ তাঁকে দেখে নিরাশ হয়েছে। দৃষ্টিনন্দনযোগ্য চেহারা যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছিল না।

চিঠির শিরোনামে লিখতেন ‘শ্রীদুর্গা শরণং’, ‘শ্রীশ্রীহরি সহায়’। এ সবের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পেত তাঁর তেজোদ্দীপ্ত স্বদেশিয়ানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত যে চটিজুতা ও মোটা ধুতিচাদর পরিয়া সর্বত্র সম্মান লাভ করেন, বিদ্যাসাগর রাজদ্বারেও তাহা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা বোধ করেন নাই। তাঁহার নিজের সমাজে যখন ইহাই ভদ্রবেশ, তখন তিনি অন্য সমাজে অন্য বেশ পরিয়া আপন সমাজের ও সেই সঙ্গে আপনার অবমাননা করিতে চাহেন নাই। সাদা ধুতি ও সাদা চাদরকে ঈশ্বরচন্দ্র যে গৌরব অর্পণ করিয়াছিলেন, আমাদের বর্তমান রাজাদের ছদ্মবেশ পরিয়া আমরা আপনাদিগকে সে গৌরব দিতে পারি না। বরঞ্চ এই কৃতকর্মের ‍উপর দ্বিগুণতর কৃষ্ণকলঙ্ক লেপন করি। আমাদের এই অবমানিত দেশে ঈশ্বরচন্দ্রের মতো এমন অখণ্ড পৌরুষের আদর্শ কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল, আমরা বলিতে পারি না।’ এই ধুতি-চাদরকে খাঁটি বাঙালিয়ানার নিদর্শন বলে মেনে নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। পিতৃদেব ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোশাক ছিল একই রকম। গ্রামে যে পোশাক ব্যবহার করেছেন শহরেও তাই। তাঁর ছেলের শহরে কলেজে পড়ার সময়ও ওই একই পোশাক।

হ্যালিডে সাহেব তখন বাংলার ছোটলাট। এ দেশের মেয়েরা যাতে লেখাপড়া শিখতে পারে, সে বিষয়ে তিনি ‍উদ্যোগী হলেন। শিক্ষার ‍উন্নয়ন নিয়ে আলোচনার জন্য মাঝে মাঝে হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে ডেকে পাঠাতেন। বিদ্যাসাগর যেতেন নিজস্ব পোশাকে— পরনে থানধুতি, গায়ে বিদ্যাসাগরী চাদর, পায়ে তালতলার চটি। হ্যালিডে সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর দুই-তিন বার পেন্টুলুন চোগা চাপকান পরেছিলেন কিন্তু সে সব পরে মনে বড়ই অস্বস্তি। সোজাসুজি ছোটলাটকে বলে বসলেন, এই ভাবে সঙ সেজে আসা সম্ভব নয়, তাই এটাই শেষ সা‌ক্ষাৎ। হ্যালিডে সাহেব তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, পণ্ডিত যে পোশাকে আসতে চান, সেই পোশাকে আসবেন। শেষজীবনে চিকিৎসকের কথায় মাঝে মাঝে ফ্ল্যানেলের জামা ও ‍উড়ানি ব্যবহার করতে হয়েছে। এমনও ঘটেছে বিদ্যাসাগরের অশৌচ, বাবা মারা গেছেন। বিশেষ প্রয়োজনে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন হ্যালিডে সাহেব, তিনি অশৌচের বেশেই গেছেন সাহেবের কাছে।

পোশাকের মতোই অবিচ্ছেদ্য তাঁর চটিজুতোও। কলকাতা শহরে ‍উনিশ শতকের মিশ্র সংস্কৃতিতে পোশাকআসাক, বর্ণময় ব্যক্তিদের ‍উপস্থিতি— এই সব কিছুর মধ্যে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজস্বতা এবং গ্রামীণ সত্তার নিখাদ ‍ঔজ্জ্বল্যটি বজায় রেখেছিলেন। বাদুড়বাগানের বাড়িতে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে যখন শ্রীরামকৃষ্ণের দেখা হল, তখন রামকৃষ্ণদেবের পরনে লংক্লথের জামা, লালপেড়ে ধুতি, বার্নিশ করা চটিজুতো। জামার বোতাম খোলা। এর জন্য দারুণ দুশ্চিন্তা। শ্রীম পরমহংসদেবকে বললেন, যাঁর কাছে যাচ্ছেন তাঁর এ সব বিষয়ে ভাবনা নেই। বিদ্যাসাগরের সে দিন পরনে থান ধুতি, হাতকাটা ফ্লানেলের জামা, গলায় পৈতে, মাথায় চার দিক কামানো, বাঁধানো দাঁত। বিদ্যাসাগর চটিজুতো বিলিতি বার্নিশের মতো করে বুরুশ করতেন। তামাক খেতেন। হুঁকো চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর হাতে ধরা থাকত। নস্যও নিতেন। মনের আনন্দে ভাব বিনিময় করলেন দুই মহাপুরুষ। যৌবনে সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে সেখানকার এক অংশে যখন তিনি থাকতেন, সেখানে কুস্তির জমি তৈরি ছিল। নিয়মিত কুস্তি করতেন। বীরসিংহ গ্রামে গেলে মালকোঁচা মেরে কবাডি খেলা তাঁর দৈনন্দিন কর্মের মধ্যে পড়ত।

এই চটিজুতো পরা নিয়েও নানা বিপত্তি। ১৮৭৪ সাল। জাদুঘর ও এশিয়াটিক সোসাইটি, পার্ক স্ট্রিটে একই বাড়িতে ছিল। সুরেন বাঁড়ুজ্জেকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দি ভাষার কবি হরিশ্চন্দ্রকে জাদুঘর দেখাতে গেছেন তিনি। বিদ্যাসাগরের সেই আদি ও অকৃত্রিম পোশাক। দ্বাররক্ষী নির্দেশ দিল, বাড়ির বাইরে তাঁকে চটিজুতো খুলে রেখে ঢুকতে হবে। অথচ সাহেবি পোশাক পরলে সাত খুন মাপ! সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে এলেন বিদ্যাসাগর। চিঠি লিখে প্রতিবাদ করলেন। এ নিয়ে চিঠি চালাচালিও চলল। কিন্তু তিনি আর কখনও এশিয়াটিক সোসাইটি বা জাদুঘরে যাননি। এ বিষয়ে ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা লিখেছিল— ‘বিদ্যাসাগরের মতন একজন পণ্ডিতের প্রতি যখন এইরূপ ব্যবহার, তখন এশিয়াটিক সোসাইটিতে আর কোন পণ্ডিত যাইতে চাহিবেন না।’ ‘সাধারণী’ পত্রিকায় এই ঘটনা লেখা হয় ‘জুতা বিভ্রাট’ নামে (১৮৭৪ সালের ১০ জুলাই)।

বহুবিবাহ বিরোধী আবেদনপত্রে স্বা‌ক্ষর করানোর জন্য বর্ধমান রাজবাড়িতে গেলে সেই একই অভিজ্ঞতা। চটিজুতো বাইরে রেখে ভিতরে যাওয়া। অবশ্য এ রকম নির্দেশ দেওয়ায় সেখানকার দারোয়ানের চাকরি যায়। বিদ্যাসাগর এক দিন শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলেছিলেন, “দেখ; ভারতবর্ষের এমন কোন লোক নেই যার নাকে এই চটিজুতা পায়ে লাথি না মারতে পারি।” সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস, নিজের কাজের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা এবং সংশয়হীন বিবেকের অধিকারী না হলে এমন কথা বলা যায় না। প্রয়োজনে পায়ের চটি হাতে নিয়ে গুন্ডা প্রহার করার কথাও ভেবেছেন অকুতোভয় বিদ্যাসাগর। তাঁর মেট্রোপলিটান কলেজে দু’দল ছাত্রের মধ্যে মারামারিতে তিনি চটি হাতে মারকুটে ছাত্রদের তাড়া করায় মস্তান নেতা দলবল নিয়ে কেটে পড়েছিল।

বিদ্যাসাগর পোশাকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্ব বাঙালির হৃদয়ে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে যে, নাটক বা ফিল্মেও এই পোশাক ছাড়া বিদ্যাসাগর চরিত্র ভাবা অসম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র তেজস্বী পুরুষ। বাঙালির আইকন। স্বদেশি ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য তিনি ইংরেজদের সঙ্গে বার বার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নানা কাজ আদায় করেছেন। ধুতি-চাদর কিংবা চটি তো ‍উপল‌ক্ষ, এ সব কিছুর অন্তরালে ছিল দেশ ও জাতি সম্পর্কে তীব্র গর্ববোধ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতে

‘চটিজুতার প্রতি তাহার (বিদ্যাসাগরের) একটা আত্যন্তিক আসক্তি ছিল বলিয়াই তিনি যে চটিজুতা ভিন্ন অন্য জুতা পায়ে দিতেন না, এমন নহে। আমরা যে স্বদেশের প্রাচীন চটি ত্যাগ করিয়া বুট ধরিয়াছি, ঠিক তাহা দেখিয়াই যেন বিদ্যাসাগরের চটির প্রতি অনুরাগ বাড়িয়া গিয়াছিল। বাস্তবিকই এই চটি জুতাকে ‍উপল‌ক্ষ মাত্র করিয়া একটা অভিমান, একটা দর্প তাঁহার অভ্যন্তর হইতে প্রকাশ পাইত।’

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায়, গদ্যে যে অটুট বাঙালিয়ানার সন্ধান দিয়েছিলেন তা বজায় ছিল ঈশ্বরচন্দ্র শর্মার জীবনেও। তাঁর লক্ষ্যেই ছিল দেশের মানুষের সার্বিক প্রগতি। স্বেচ্ছায় পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমশ আত্মীয়পরিজনহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যেও আজীবন জনবিচ্ছিন্ন হননি। মানসিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিক্ততাবোধে তাঁর জীবনের সেরা কাজ বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য অবিচল থেকেছেন নিজের লক্ষ্যে।

তথ্যসূত্র - করুণাসাগর বিদ্যাসাগর - ইন্দ্র মিত্র   
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - বিহারীলাল সরকার

More Articles