মায়া সভ্যতার মানুষও চকোলেট খেত! কেমন স্বাদ ছিল? কতটা বদলেছে কয়েক হাজার বছরে?

Chocolate : ভালোবাসায়, বিপ্লবে, রেশনে অথবা মুদ্রায় বিবর্তিত হয়েছে চকোলেটের ইতিহাস

চৌকো অথবা গোল, দুধ সাদা অথবা ‘ডার্ক’ বাদামি চকোলেট বলতেই উঁকি দেয় মুঠো ভর্তি শৈশব। তারপর কখন যেন ভেঙে যায় বয়সের সীমা। আট থেকে আশি সকলেরই সাধ হয় চেখে দেখার। দাঁতের পোকাগুলো তখন আর ভয় দেখায় না। স্বর্গীয় স্বাদে মন জুড়ায়। বাহারি রকমফের এখন চকোলেটের। তার আবার নানান কোম্পানি। সংস্থাভেদে আলাদা আলাদা স্বাদও হয় তার। ক্যান্ডি এবং লজেন্সের সেই যাত্রাই আজ ডার্ক অথবা হোয়াইট চকোলেটের দুনিয়া ছুঁয়েছে অবলীলায়।

অ্যাজটেক শব্দ Xocoatl থেকে এসেছে চকোলেট শব্দটি। যার আক্ষরিক অর্থ তিক্ত জল। যদিও ঔপনিবেশিক আমলের কোনও গ্রন্থে এই শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় না, তাই ধরে করে নেওয়া হয়, এর অস্তিত্ব ভাষাবিদদের একটি অনুমান মাত্র। আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে বাজার চলতি ট্রেন্ডি চকোলেট দেখে হয়তো অনেকেই আঁচ করতে পারেন না যে, চকোলেটের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মোটামুটিভাবে মায়ান সভ্যতাকেই এর উৎপত্তির সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। যদিও কোনও কোনও গবেষক চকোলেটের ইতিহাস নিয়ে আরও পুরনো গল্প বলে থাকেন। এমনকী এর অস্তিত্ব দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন ওলমেকস সভ্যতার সময় থেকেও পাওয়া যায় বলে মনে করে কেউ কেউ। সাধারণভাবে অ্যাজটক থেকে গত চকোলেট শব্দটির অর্থ মিষ্টি বা মিছরি বার। তবে হাল আমলের পরিচিত চকলেটের সঙ্গে একেবারেই মেলে না সেকালের এই বার-এর সংজ্ঞা। কিন্তু নামের জোরে জনপ্রিয়তা এখনও রয়ে গিয়েছে একইরকম। সেই মায়ানদের সময় থেকে বর্তমান সময় কদর কমেনি একরত্তিও।

শুরুতে অবশ্য তেঁতো পানীয় হিসেবেই প্রচলিত ছিল চকোলেট। তারপর থেকে প্রায় চার হাজার বছরের বিবর্তনে এসেছে আজকের আধুনিক চকোলেট। কিন্তু এই হাজার হাজার বছরের যাত্রাপথের সবটুকুই সুগম ছিল না। এই ইতিহাসে লেগে আছে ক্রীতদাসদের হাড় ভাঙা পরিশ্রম থেকে শুরু করে আমেরিকান বিপ্লবের দাগও। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাস ফিরে দেখতে হলে প্রয়োজন আস্ত একটা টাইম মেশিন। এই প্রতিবেদনেই শুরু করা যাক টাইম ট্রাভেল।

আরও পড়ুন - গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ

মেক্সিকোতে আজ থেকে চার হাজার বছর আগেই প্রথম কোকো গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অ্যাজটেকরা প্রথম চকোলেটকে পানীয় হিসেবে খেতে শুরু করেন ২৫০০ বছর আগে। তাই বিশেষজ্ঞরা চকলেট আবিষ্কার প্রসঙ্গে আড়াই হাজার বছর আগের কথাই বলে থাকেন। মায়া সভ্যতার ইতিহাসে চকোলেটকে সম্মান জনক পানীয় হিসেবে গণ্য করা হতো। চকোলেট নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও ওলমেকরাই যে কোকো’কে সেন্ট্রাল আমেরিকার মায়া সভ্যতায় ছড়িয়ে দিয়েছিল তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে। সেই সময় চকোলেট পানীয়কে এতটাই সমীহ করা হতো যে কোনও বিশেষ লেনদেন চূড়ান্ত করার অনুষ্ঠানেও আয়োজন করা হতো চকলেটের। এর উল্লেখ রয়েছে খোদ মায়া সভ্যতার ইতিহাসেই। সে সময় যে কোনও বিষয়ে চকোলেটকে শুভ বলে মানা হতো। এর থেকে সহজেই আঁচ করা যায় সে সময় নিছক স্বাদের ক্ষেত্রে নয়, পাশাপাশি অর্থনৈতিক মানচিত্রেও জায়গা করে নেয় কোকো অথবা চকোলেট। সেই সময় চকোলেট বলতে ছিল ঘন আর ফেনাময় এক পানীয়। শুধু তাই নয়, চকোলেটের সঙ্গে লাল লঙ্কা, মধু এবং জল মিশিয়েও পান করতেন সেখানকার মানুষ। এমনকী অনেক পরিবারে প্রতিবেলার আহারেও বরাদ্দ ছিল চকোলেটের পানীয়। যদিও কোন অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হতেন না চকোলেট পানীয় থেকে কিন্তু বাজারে দাম ছিল উচ্চ, তাই কেনার সামর্থ্য হত না অনেকেরই।

পরবর্তী সময়ে অ্যাজটক সভ্যতার হাত ধরে ১৪২৮ সালে চকোলেট উন্নীত হয় স্বয়ং ঈশ্বরের উপহার হিসেবে। এই সভ্যতায় কোকো ফলকে ঈশ্বরের দান হিসেবে মনে করত মানুষ। সেখানেও বিভিন্ন মসলা সহযোগে বিলাসবহুল অনুষ্ঠানে পান করা হতো গরম অথবা ঠান্ডা চকোলেট পানীয়। তবে মায়া সভ্যতার মতো এই পানীয় কোনওদিনই সমাজের ক্ষমতাশালীদের কুক্ষিগত ছিল না। দামও ছিল কম। তাই বিত্তশালী, ক্ষমতাধরদের পাশাপাশি সাধারণ প্রজাদের জন্যেও বিশেষ অনুষ্ঠানে সহজলভ্য ছিল চকোলেট। কোকো ফল অথবা চকলেট খেলে দৈহিক ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়, তাই সে সময় সামরিক বাহিনীর যোদ্ধাদের আরও বেশী শক্তিশালী করে তোলার জন্যেও প্রচলিত ছিল চকোলেট। শুধু তাই নয় এই সভ্যতায় মানুষ খাদ্যপণ্য বা অন্য কোনও সামগ্রী কেনাবেচা করতে মূদ্রা হিসেবেও ব্যাবহার করতেন কোকো বিন অথবা চকোলেটকে। সে সময় কোকো বিনকে সোনার সঙ্গে তুলনা করা হতো।

স্পানিশ হট চকলেট কথা আজকের বাজারে খুবই প্রচলিত। তবে স্পেনে চকলেট কীভাবে এলো তা নিয়ে রয়েছে অনেক তর্ক-বিতর্ক। যদিও ১৫০০-এর দশকের শেষভাগের মধ্যেই স্প্যানিশ দরবারে চকলেট বেশ সমাদৃত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে স্পেন চকলেট আমদানি শুরু করে ১৫৮৫ সালে। ইতালি এবং ফ্রান্সের মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সেন্ট্রাল আমেরিকায় যারা আসতেন তারাও এই সময় খোঁজ করতেন চকোলেটের। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা ইউরোপের ছড়িয়ে পড়ে এর চাহিদা। এমনকী চাহিদা এতটাই বাড়তে থাকে যে, প্রয়োজন হয় বাড়তি যোগানের। সেইমতো কোকোর চাষ বাড়ানোর হাজার হাজার ক্রীতদাস কে নিয়োগ করে মালিকপক্ষ। শোনা যায় এই সময় রীতিমত চাপ দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হতো ক্রীতদাসদের। তবে মায়া অথবা অ্যাজটক সভ্যতার তেতো চকলেটের স্বাদ মন ভোলাতে পারেনি ইউরোপিয়ানদের। তাই স্বাদ বদলের চেষ্টা চালাতে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। চকলেটের সঙ্গে আখের রস, দারুচিনি, জল এবং অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নিজেদের পছন্দমতো হট চকলেট বানাতে শুরু করেন ইউরোপিয়ানরা। তেঁতোর বদলে মিষ্টি স্বাদের চকোলেট পছন্দ হয়ে যায় তাদের। ক্রমেই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে লন্ডন, আমস্টারডম সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় শহরে।

আমেরিকান উপনিবেশে অবশ্য চকলেট আসে আরও কিছুটা পরে। ১৬৪১ সালে একটি স্প্যানিশ জাহাজে করে প্রথম ফ্লোরিডায় পা রাখে মিষ্টি স্বাদের চকোলেট। তারপর প্রায় ৪১ বছর লেগে যায় আমেরিকায় নিজস্ব চকোলেট উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হতে। ১৬৮২ সালে বোস্টনে প্রথম ‘আমেরিকান চকোলেট হাউস’ চালু হয়। যদিও সাধারণ মানুষের মধ্যে বহুল চকোলেটের চাহিদা তৈরি হয়। শুধু তাই নয় আমেরিকান বিপ্লবেও চকোলেটের গুরুত্ব অপরিসীম। আগেই বলা হয়েছে, চকোলেট খাওয়ায় দৈহিক শক্তি এবং এনার্জি বাড়ে তাই ১৭৭৫ সাল থেকে ১৭৮৩ সালে বিপ্লবের দিনগুলিতে সামরিক বাহিনীর রেশন তালিকায় যুক্ত করা হয় চকলেটকে। এমনকী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও আমেরিকান সৈনিকদের রেশন হিসেবে চকোলেট দেওয়া হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের সময় ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায় চকোলেটের।

আরও পড়ুন - নাম শুনলেই জিভে জল, কোথা থেকে এল বাঙালির প্রিয় ফুচকা

উনবিংশ শতকের বেশির ভাগ সময় পর্যন্ত চকোলেট বলতে সকলে বুঝত পানীয়। আজ আমরা যে চকোলেট বার খাই তার শুরুটা হয় ব্রিটিশ চকোলেট কোম্পানি জে. এস. ফ্রাই অ্যান্ড সনস-এর হাত ধরে। ১৮৪৭ সালে তারাই প্রথম চিনি, তরল চকলেট ও কোকো বাটার মিশিয়ে চকলেট বার উৎপাদন করে।আগে অবশ্য পানীয় চকোলেটের সঙ্গে জলের বদলে দুধ মেশানো হতো কিন্তু চকোলেট বারে দুধের প্রচলন হয় সুইস চকলেট ব্যবসায়ী ড্যানিয়েল পিটারের হাত ধরে, ১৮৭৬ সালে। চকলেটের সঙ্গে দুধের গুড়ো মিশিয়ে মিল্ক চকলেট উৎপাদন করেন তিনি। তার কয়েক বছরের মধ্যে সেই নতুন চকোলেট এর ধারণায় তিনি পাশে পান বন্ধু হেনরি নেসলেকে। নেসলের উদ্যোগেই বড় পরিসরে বাজারে ছড়িয়ে নতুন মিল্ক চকোলেট। সেই থেকে আজও নেসলে কোম্পানি রমরমিয়ে ব্যবসা করছে।

বাজারে চকলেটের দাপট থাকলেও তখন তা ছিল শক্ত বার। যা কামড়ে খাওয়া যেত না। হল আমলের অপেক্ষাকৃত নরম চকোলেটের ধারণা নিয়ে আসেন আরেক সুইস চকলেট ব্যবসায়ী রুডলফ লিন্ড এমন। ১৮৭৯ সালে তিনি একটি মেশিন তৈরি করেন, যাতে মিশ্রণ কোমল হয়।

একে সুস্বাদু তায় আবার মসৃণ পাচ্য। সহজেই মন কেড়ে নেয় চকোলেট। ক্যাডব্যারি, মার্স, নেসলে ও হার্সলের মতো কোম্পানিগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বাজারে। দেদার মন মাতায় চকোলেট। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডায়েট ঠিক রাখতে বাজারে আসে ডার্ক চকোলেট। পানীয় হিসেবে অবশ্য এখনও মেলে চকোলেটের বিভিন্ন ধরন তবে বার চকোলেটের চাহিদার সঙ্গে তার তুলনা চলে না। চকলেটের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার কারণে বেশ কিছু দেশে চকলেট জাদুঘর গড়ে উঠেছে। আবার ৭ই জুলাই বিশ্বব্যাপী চকলেট দিবস পালন করা হয়, কলকাতা শহর এবং শহরতলিতেও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেমের সপ্তাহে একটা দিন রয়েছে চকোলেটের দখলে। জন্মদিন অথবা শুভ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে হালকা খিদে কিংবা প্রেমের উপপাদ্য মিলিয়ে দিতেও চকোলেটের জুড়ি মেলা ভার। তাই আলাদা করে ‘চকোলেট ডে’ পালন এখন যে দস্তুর তা বলাই বাহুল্য!

More Articles