হাত পাতলেই মেলে ‘চাউমিন’ প্রসাদ, যেভাবে কলকাতার কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন চিনারা

Kolkata chinese kali temple : ট্যাংরার চিনাপট্টির মোড়ে একচিলতে কালীমন্দির

আজব শহর কলকাতা। আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস। এখানে পা দিলেই শুরু হয় টাইম ট্রাভেল। আর অতীতের ছাই ঘাঁটতে ঘাঁটতেই মেলে অমূল্য রতন। এখনও এ শহর নিয়ত প্রাচীনত্বের গল্প বোনে। সেইসব গল্পের পাতা পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ ঘণ্টার শব্দে নজর ফেরে। খোদ চিনা পট্টিতে মন্দিরের শব্দ? শুনে খানিকটা ধাঁধা লাগলেও এটাই সত্যি। ‘ট্যাংরা’ নামটা বাঙালির আহারের সঙ্গে মিলে গেলেও কলকাতার ট্যাংরা মানেই আস্ত একটা চিনা ঠেক। আর সেখানেই রয়েছে কালী মন্দির। ধর্মের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। নাম চিনা কালী মন্দির।

চিনের সঙ্গে কলকাতার যোগ অবশ্য আজকের নয়। সেই ১৭৭৮ সাল থেকে এ শহরে চীনাদের আনাগোনা। চা, মোমো, চাউমিন থেকে শুরু করে পোশাক আশাকেও আজকাল চিনা ছোঁয়া। কোন এক মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রয়েছে সবকিছুই। তাই বাঙালির খাদ্য তালিকায় চাউমিন বেশ জাঁকিয়ে বসে। তাই বলে, দেবীর ভোগও কিনা হবে সেই চাউমিন? হ্যাঁ চীনা পট্টিতে থাকতে থাকতে দেবীরও এমনটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই খিচুড়ি, সবজি, পায়েস, ফল, মিষ্টির সঙ্গে একটু চাউমিন না দিলে মুখে রোচে না মা কালীর।

আরও পড়ুন - কেন কালীপুজোর দিন হয় অলক্ষ্মী বিদায়

এ শহরে প্রথম পা রেখেছিলেন টোনি আচিউ। তাঁর পথ অনুসরণ করেই দলে দলে চীনা সম্প্রদায়ের ব্যাস শুরু হয় খাস কলকাতায়। টেরিটি বাজার ও ট্যাংরায় অঞ্চলে পে রাখলে আজও চোখের সামনে অতীতের ছবিটা স্পষ্ট ধরা পড়ে। এদের অনেকের জন্ম এদেশেই। ভুলে গিয়েছেন নিজেদের ভাষা। মিলবে, মিলিবের জাদুতে মিলেমিশে গিয়েছ ধর্ম ও বর্ণ, জাতপাত। তাই শুধু বাঙালিই যে চিনা খাবারের স্বাদ নেবেন তা তো হয় না। দেবতাই বা বাদ যাবেন কেন! সত্তর বছর ধরে এই কালী মন্দিরে ভোগ হিসেবে তাই উৎসর্গ করা হয় খাঁটি চিনা খাবার, চাউমিন।

ইতিহাস অবশ্য একটা অন্য গল্প বলে। কথিত আছে, আগে এই মন্দিরের জায়গায় আগে ছিল সামান্য একটি কালো পাথর। ভক্তরা তাকেই সিঁদুর মাখিয়ে পুজো করতেন। তবে বিশ্বাসে কি না মেলায়! হলও তাই। এই অঞ্চলের এক চিনা শিশুর একবার ধুম জ্বর। ডাক্তার বদ্যি করেও সারছে না। অবশেষে ভিন্ন ধর্মের পায়েই মাথা কুটলেন বাবা মা। ফলও মিলল হাতেনাতে। ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠল ছেলেটি। আর এতেই ভাগ্য ফিরে গেল ওই কালো পাথরটির। ওই পরিবারের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা হল চিনা কালীবাড়ি। বর্তমানে যে কালীমন্দিরটি তৈরি রয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ গ্রানাইট পাথরের।

আরও পড়ুন - পুরুষকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটা! নবদ্বীপে যেভাবে তৈরি হয়েছিল প্রথম কালীমূর্তি

আজকের প্রজন্মের কাছে এই গল্প ভিত্তিহীন মনে হলেও এই অঞ্চলে কান পাতলে এখনও এমনই গুঞ্জন। গত ষোলো বছর ধরে মন্দিরের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন জন চেং। জন বাবুর বেড়ে ওঠা এই ট্যাংরা অঞ্চলেই। তাঁর আত্মীয়রা আগে দেখাশোনা করতেন মন্দিরের। পাকাপাকিভাবে নিউইয়র্কে চলে গিয়ে আবার দেশে ফেরেন ১৯৯৭ সাল নাগাদ। এখন তিনি নিজেই আগলে রেখেছেন এই মন্দির। এই পথে একে যেন গায়ে কাঁটা দেয়। এই যে চারিদিকে এত ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ,সব যেন ধুলিস্মাৎ হয়ে যায় নিমেষে। আর জন চেং বাবু এক মনে গাঁথতে থাকেন দেবীর জবার মালা। সাজিয়ে রাখেন কোশাকুশি। আর নিজের প্রিয় খাবার চাউমিন সাজিয়ে পরিবেশন করেন স্বয়ং কালীকেও।

এমনিতে চীনারা বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। কলকাতার চীনা নাগরিকরাও তাই। যিনি মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন তিনিও ছিলেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু ওই বিশ্বাসের জোরেই যেন মিলে মিশে গেল দুই ধর্ম। আর সেই থেকেই এক টুকরো ইতিহাস বুনে রেখেছে এই মন্দির। শক্তির দেবীর প্রতি টান থেকেই ধর্মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে চিনা বৌদ্ধরা জ্বালেন মোমবাতি। মাথা ঠেকান দেবী কালীর চরণে। বিপদ দূর করতে হিন্দু-চিনা একসঙ্গে মা কালীর সামনে পুজোয় বসেন। সব ধর্ম মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় মন্দিরে। আর সব থেকে মজার বিষয় হল ওই প্রসাদের বিষয়টিই। খিচুড়ি, সবজির সঙ্গে সঙ্গত করছে চাউমিন চপসি। কে বলে দেবী কেবল বাঙালির?

More Articles