তারুণ্যে হার মানবে নামজাদা রেস্তোরাঁ, কলকাতার এই পাইস হোটেল ১০৭ বছরের বিস্ময়
Pice Hotel : কালীঘাট মন্দির থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে শতাব্দী প্রাচীন পাইস হোটেল তরুণ নিকেতন
রাসবিহারী মোড় থেকে যে রাস্তাটা গড়িয়াহাটের দিকে চলে যাচ্ছে সেই পথে দু চার মিনিট হাঁটলেই পড়বে লেক মার্কেট। ব্যস্ত পথের ধারে এখানে উপচে পড়েছে ফুলের পসরা। ঠিক তার ধার ঘেঁষেই আদ্যিকালের এক বদ্যি বুড়ো। অথচ নামখানা শুনলে মনে হবে বয়স আটকে সেই যৌবনেই। ১০৭ বছরের এক প্রতিষ্ঠানের নাম কিনা ‘তরুণ’ নিকেতন।বয়স বাড়লেও পাক ধরেনি তার আভিজাত্যে। হাল আমলের ক্যাফে রেস্তোরাঁর সঙ্গে আজও বিনা যুদ্ধে এক সুচাগ্র মেদিনী দিতেও নারাজ সে।
উনিশ শতকের প্রথম থেকেই কলকাতার মানচিত্রে একটা বদল আসতে শুরু করে। যদিও ইংরেজ শাসকরা তখনও রীতিমত জাঁকিয়ে শাসন করছে দেশ। কিন্তু ভারতবাসীর মধ্যেও ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে স্বাধীনতা। লড়াইয়ের বীজ মন্ত্রে শান দিচ্ছেন অনেকেই। ঠিক এরকম সময়, একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রায়। পেটের তাগিদে গ্রাম ও শহরতলি থেকে মানুষ ভিড় করতে থাকে কলকাতার অলিগলিতে। এক চিলতে ঘর, সেখানেই কোনও মতে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই মিললেই রক্ষে। বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় থেকে অফিসে কাজ নিয়েছেন অনেকেই। ঠিক এই সময়েই কলকাতার মানচিত্রে আরও একটি পট পরিবর্তন হয়। দিকে দিকে গজিয়ে উঠতে থাকে ভাতের হোটেল। বাড়ির খাবারের সস্তার বিকল্প আর কি!
কলকাতার মধ্যে যে আরও একটা কলকাতা লুকিয়ে রয়েছে এ কথা অবশ্য সকলেই জানে। আর সেই কলকাতার আনাচে কানাচে রয়েছে ঐতিহ্যের গন্ধ। কখনও তাতে মিশেছে বাহারি আতর অথবা ফুলের সুবাস কখনও আবার সুস্বাদু রান্নার ঘ্রাণ। বাঙালির অবশ্য খাবার নিয়ে এমনিতেই যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। তাই এখনও বাংলায় ওই একটা ব্যবসাতেই ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব বেশ কম। আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ক্যাফে, হোটেল, রেস্তোঁরা, অথচ খোঁজ নিয়ে দেখুন কেউই বিশেষ মাছি তাড়াচ্ছেন না খাদ্য দেবতার সহায়তায়।
আরও পড়ুন - জলের দরে ‘পেটচুক্তি’ খাওয়া, কলকাতার এই পাইস হোটেলগুলিতে জেগে স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প
যাই হোক, ফিরে আসা যাক রাসবিহারী মোড়ের সেই সেকেলে ভাতের হোটেল। কম পয়সায় পেটচুক্তি খাবারের বন্দোবস্ত, পাইস হোটেল বলতে আমরা এটুকুই বুঝি। শুধু সেকালে নয়, একালেও পাইস হোটেলের এই ধারণায় কোনও বদল আসেনি। তরুণ নিকেতনও তাদেরই একজন। ১৯১৫ সালে পরাধীন ভারতে পথচলা শুরু করেছিল তরুণ নিকেতন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত রোজ দুবেলা উনুনে আঁচ পড়েছে। ধোঁয়া ওঠা ভাতের গন্ধে মম করেছে চত্বর। স্বদেশী আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ থেকে করে হাল আমলের করোনা মহামারী সবই প্রত্যক্ষ করেছে বৃদ্ধ ‘তরুণ’।
কালীঘাট মন্দির থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে এই পাইস হোটেল। প্রকৃতই ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা জগৎচন্দ্র দেব। তাই ভালো করে ভেবেই এই চত্বরে দোকান খুলেছিলেন। একদিকে ধর্মের টান, অন্যদিকে জমজমাট বাজার, অফিস-কাছারি, তাই খদ্দেরের টান পড়েনি কোনও দিনই। ব্যবসার হাল এখন তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। জগৎচন্দ্র দেবের পৌত্র অরুণ দেব এখন সামলাচ্ছেন দায়িত্ব। কিন্তু মালিকানা বদল হলেও আভিজাত্যের বদল হয়নি একরত্তিও। এখনও সেই সাবেকি স্বাদ, সেকেলে ঘরানা। কলাপাতায় ভাত পরিবেশন করা হয় আজও। আর তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা মাটির ভাঁড়ে জল।
মাছে ভাতে বাঙালির রসায়ন ভালোই বোঝেন দোকানের মালিক। তাই আধুনিক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে যতোই মেনুতে চাইনিজ অথবা মোগলাই খাবার যোগ করো হোক না কেন, আসল ব্যবসার চাবিকাঠি ওই ভাত মাছেই। রোজ অন্তত ১০ থেকে ১২ রকমের মাছ রাঁধা হয় এখানে। রুই, কাতলা, ভেটকি, পাবদা, তেলাপিয়া, বাটা, শোল, বোয়াল এসব তো রয়েছেই তার সঙ্গে মরশুমের স্পেশাল ইলিশ অথবা চিংড়িও পাওয়া যায় তরুণ নিকেতনের হেঁশেলে। মা ঠাকুমার হাতের বাহারি পদেরও সন্ধান রয়েছে। যেমন মোচার ঘণ্ট, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক, পুঁটি মাছের টক অথবা ভেটকি পাতুরি। আহা সবই যেন অমৃত। এছাড়াও নিরামিষ তরিতরকারি, ডাল, ভাজা, শাক, হাঁসের ডিম, চিকেন, মাটন সবই মেলে এখানে। পকেট এবং ইচ্ছে এই দুইয়ের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে অর্ডার দিলেই নিশ্চিন্ত।
আরও পড়ুন - নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়াতেন নেতাজিকে, স্বাধীনতার ঐতিহ্য বহাল শতাব্দী প্রাচীন হোটেলে
দোকানে প্রবেশ করেই প্রথমে চোখে পড়বে একটা বড় হলঘর। মাঝখান থেকে পার্টিশান করা, দুপাশে কাঠের চেয়ার আর মার্বেল টপের টেবিল পাতা। ডানদিকে ছোট কাঠের ক্যাশ কাউন্টার। আর হলঘরের পিছনের দিকে সেই কাঙ্ক্ষিত হেঁশেল। যেখান থেকে ভেসে আসছে সুস্বাদু সব গন্ধ। হলঘরের সামনেই রয়েছে বড়সর একটা ব্ল্যাক বোর্ড, আর তাতেই চক দিয়ে লেখা মেনু। রোজ যেহেতু এক মেনু হয় না তাই এই ব্যবস্থা। তবে আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে অন্য জায়গায়। মেনু তালিকার ওপরে রয়েছে একটি বার্তা। তাতে বড় বড় করে লাল কালিতে লেখা, “পেঁয়াজ নাই”। ব্যতিক্রম খাবারগুলোর কথাও উল্লেখ করা আছে সেখানে। যথা, মাছ, মাংস এবং ডিমের কালিয়া। মূলত কালীঘাটে পুজো দিতে আসা অনেক তীর্থযাত্রীরাi পিঁয়াজ রসুন খেতেন না, তাই সেই থেকেই এখানে পিঁয়াজ রসুন ছাড়া খাবার রাঁধার চল। আগে মাংসও রাঁধা হতো সেভাবেই। তবে এখন মাংসে পিঁয়াজ, রসুন ব্যবহার করা হয়।
এ হোটেলের আসল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে ঘরোয়া স্বাদে। তাই কোনও খাবারেই তেল, ঝাল, মশলার আধিক্য নেই। রোজদিন খেলেও হজমের ওষুধের প্রয়োজন হবে না। বেলা ১২ টা থেকেই মেলে ভাত মাছ। রাতে অবশ্য এসব ঝক্কি রাখেন না কেউই। তখন সেখানে খানিকটা আধুনিক মেজাজের জায়গা। চাউমিন, মোগলাই, রুটি, তর্কা এসবেই রাতের মেনু সারেন। বছরে কেবল একটা দিন বন্ধ থাকে দোকান, সেটাই হল দোল। এছাড়া ৩৬৪ দিনই খোলা দোকানের দরজা।
ঐতিহ্য যেন আজও কড়া নাড়ে এ দোকানের দেয়ালে, করিকাঠে। খেটে খাওয়া দিন মজুর থেকে বড়ো বড়ো সাহিত্যিক অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনও বিপ্লবী মুখ, পেটের তবে কখনও না কখনও এসেছেন তরুণ নিকেতনে। কলাপাতায় ভাত মেখে খেয়েছেন। আর সেই সব ইতিহাসকে লালন করেছে দেব পরিবার। টাইম ট্রাভেল করে ধরে রেখেছে সবেকিয়ানাকে। ভাতের গন্ধে এখনও সেই সেকেলে স্বাদ। আর তাতে একটু মাছের ঝোল পড়লেই, আহা! অমৃত!