বউবাজার থেকে বালিগঞ্জ, কলকাতার এইসব অঞ্চলের নামের পিছনে লুকিয়ে আজব কিসসা

কলকাতার রাস্তার নাম নিয়ে ছোট্ট এক ইতিহাস তৈরি হয়ে যায়। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক কলকাতার কিছু বিখ‍্যাত রাস্তা এবং জনপদের নামকরণের পিছনের ইতিহাস।  

কলকাতা, মায়াজড়ানো এক পরিপাটি শহর। তাই তো তিলোত্তমার বুকে যারা একবার স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন তারা আর এই শহরের মায়া কাটিয়ে অন‍্য কোথাও যেতে পারে না। তবে আজকের এই মহানগরী এই কিছুদিন আগেও ছিল নিতান্ত এক অস্বাস্থ‍্যকর, বসবাস অযোগ‍্য এক জায়গা। সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা তিনটি গ্ৰাম নিয়ে গড়ে ওঠা আজকের মেট্রোপলিটনের একদিকে ছিল নদী, তিনদিকে জলা আর বনভূমি। টুকরো টুকরো জায়গায় উঁচু জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো কিছু বসতি। শেয়ালদা তখন নিতান্ত এক লবণ হ্রদের পাশে গজিয়ে ওঠা উঁচু দ্বীপ। সে দ্বীপে নাকি রাজ করতো শেয়ালেরা। রাস্তাঘাট ছিল গ্ৰামের মতোই আঁকাবাঁকা। পলাশির যুদ্ধের পর মূলত কলকাতার পথঘাট উন্নতির কথা ভাবা হয় । সেইসময় কলকাতার রাস্তা সংস্করণের দায়িত্ব এসে পরে লটারি কমিটির  হাতে, উদ‍্যোগটি ছিল বেসরকারি। এরপর ১৮০৯ সালে লর্ড ওয়েলেসলির সময় সেই লটারি কমিটির সরকারি খাতায় নাম ওঠে।

এই কমিটি নগর উন্নয়নের জন‍্য  অনেক কাজ করলেও  ১৮৬৭ সালে এসেও কলকাতার পাকা রাস্তার সংখ‍্যা ছিল মোটে দুটো। শহরে তখন‌ও পুরসভা গড়ে ওঠেনি। উনিশ শতকের সাতের দশকের পর এই রাস্তা নির্মাণ কাজ এগোতে থাকে দ্রুতগতিতে। কলকাতা ক্রমে পরিণত হয় ‘মাকড়সা শহর’ বা ‘স্পাইডার সিটি’তে। সেইসময় থেকেই ব‍্যক্তির নামে রাস্তার নাম হ‌ওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় আর সেখান থেকেই কলকাতার রাস্তার নাম নিয়ে ছোট্ট এক ইতিহাস তৈরি হয়ে যায় । চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক কলকাতার কিছু বিখ‍্যাত রাস্তা এবং জনপদের নামকরণের পিছনের ইতিহাস।  

ফ‍্যান্সি লেন: ডালহৌসির ফ‍্যান্সি লেন আসলে কোন ফ‍্যান্সি ইতিহাসের বাহক নয়। ‘ফাঁসি’ থেকে এসেছে এই ফ‍্যান্সি শব্দটি। ভারতে তখন ইংরেজ আমল। ১৮০০ সাল নাগাদ গোটা শহর কাঁপছে ইংরেজদের দাপটে। সেই সময় খুব সামান‍্য কারণে কিংবা প্রায় বিনা অপরাধেই বিচারের নামে নির্বিচারে ফাঁসি দেওয়া হতো দেশবাসীকে। কারও অপরাধ সামান‍্য ঘড়ি চুরি কিংবা কারও দোষ রাহাজানি। ব‍্যাস, বিচারে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। ডালহৌসির এই অঞ্চলে আগে বড়ো বড়ো গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো সারি বেঁধে। সেই গাছগুলি থেকেই দেওয়া হতো ফাঁসি। লোকে ভিড় করে আসতো এই ফাঁসি দেখতে। শোনা যায়, নন্দকুমার নামে এক ব্রাহ্মণের ফাঁসি দেখার পর নাকি দর্শকরা সবাই গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরে ছিল।

ব‌উবাজার: ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এই রাস্তাটি প্রসারিত ছিল । পরে এই রাস্তাটির নাম হয় ব‌উবাজার রোড। এর নামকরণের কাহিনিতে আবার দুটি বিষয় উঠে আসে। প্রথমত, বিশ্বনাথ মতিলাল নামে একজন মাড়োয়ারি বাঙালি পুত্রবধূর নামে নাকি এক গোটা বাজার লিখে দিয়েছিলেন। হিন্দি শব্দ ‘বহু’ শব্দের অর্থ ব‌উ, এই ঘটনা থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় বহুবাজার। পরে বাঙালিরা তাদের মতো করে বলতে শুরু করে ব‌উবাজার। দ্বিতীয়ত, অনেক বাজার বা বহু বাজার-এর সমারোহ থেকে অঞ্চলটির নাম হয়ে থাকতে পারে বহুবাজার এবং পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে ‘ব‌উবাজার’। পরে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির নাম অনুসারে রাস্তাটির নাম রাখা হয় বিপিনবিহারী স্ট্রিট। তবে ব‌উবাজার কথাটিই এখন‌ও বেশি প্রচলিত।

হাড় কাটা গলি: ব‌উবাজারের সোনার দোকানে জড়োয়ার গয়না বানানোর জন‍্য এই অঞ্চলে হিরে কাটার কাজ করা হতো। প্রথমে নাকি এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘হীরা কাটা গলি’। কিন্তু পরবর্তী সময়ে লোকের মুখে মুখে ক্রমে তা হাড় কাটা গলিতে পরিণত হয়। স্বামী বিবেকানন্দের ভাই তাঁর ‘কলিকাতার কথা ও কাহিনী’ ব‌ইতে লিখে গিয়েছেন, একদল কারিগর নাকি এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাণীর হাড় দিয়ে রকমারি জিনিস বানাতেন। সেইখান থেকেই এই নামের আগমন।

চৌরঙ্গী: সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় এই স্থানে তিনটে ছোট ছোট গ্ৰাম ছিল– চৌরঙ্গী, বিরজি এবং কোলিম্বা। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ নামক এক সন্ন‍্যাসীর বসবাস ছিল এই অঞ্চলে। সেখান থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় চৌরঙ্গী।

টালিগঞ্জ: টালিগঞ্জ নাম শুনলেই এক ঝাঁক তারকার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তবে, এই অঞ্চলের নামকরণের সঙ্গে কিন্তু সিনেমার দূরদূরান্ত অবধি কোনও যোগাযোগ নেই। মেজর উইলিয়াম টলি সাহেব ১৭৭৫-৭৬ সালে কলকাতার সঙ্গে অসম এবং পূর্ববঙ্গের যোগাযোগ সহজ করার জন‍্যে একটি নালা খনন করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই নালায় যাতায়াতকারী নৌকাগুলি দেকে কর আদায়ের অনুমতি দেন এবং তার সঙ্গেই অনুমতি দেন একটি গঞ্জ বা বাজার স্থাপনের। টলি সাহেবের নাম অনুসারে এই নালাটির নাম হয় টালির নালা। প্রতিষ্ঠিত বাজারটি পরিচিতি পায় টালিগঞ্জ হিসাবে। নালার পূর্ব দিকে অবস্থিত টালিগঞ্জ রোডের কাছেই কোন এক স্থানে বাজারটির অবস্থান ছিল।

বালিগঞ্জ: ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা মিরজাফরের কাছ থেকে ডিহি পঞ্চান্ন গ্ৰাম কিনে নিয়েছিলেন। বালিগঞ্জ সেই গ্ৰামের অন্তর্গত ছিল। এই স্থানে বালির এক বিশাল বাজার ছিল। আনুমানিক ১৮০০ সাল থেকে এই জায়গার নাম হয় বালিগঞ্জ এবং এই পঞ্চান্ন গ্ৰামের একাংশ এখন‌ও বিদ‍্যমান।

বরাহনগর বা বরানগর: এই অঞ্চলের নামকরণ নিয়ে নানান মত প্রচলিত রয়েছে । অনেকে মনে করেন, এখানে বরাহমিহিরের মন্দির ছিল, তার থেকে বরানগর নামটি এসেছে। আবার অনেকে বলেছেন এই অঞ্চলে নাকি শুয়োরের খুব উৎপাত ছিল এক সময়ে। সেখান থেকে নামটির আগমন। আবার শ্রীচৈতন‍্য মহাপ্রভু পুরী যাওয়ার পথে এই অঞ্চলে আসেন, যার বর্তমান নাম পীঠবাড়ি আশ্রম। সেইসময় থেকেই বরানগর নামটি পাওয়া গিয়েছে, বলেন অনেকে। আবার নগরের বাইরে অবস্থানের কারণে বেরনগর থেকে বরানগর কথাটির আগমনের সম্ভাবনা আছে বলেও অনেকে মনে করেন।

দমদম: দমদম নিয়ে যে মতটি প্রচলিত আছে , তাতে দেখা যায় এই জায়গার পুরোনো নাম ছির ‘দমদমা’ যার অর্থ উঁচু ঢিবি। এবং এই নামের প্রমাণ পাওয়া যায় O'Malley -এর Gazetteer ব‌ইতে।

ঠনঠনিয়া: কথিত আছে , এই অঞ্চলে কয়েকটা বাড়িতে লোহার কাজেরও রেওয়াজ ছিল। লোহা পিটানোর ঠনঠন শব্দ থেকেই নাকি এই অঞ্চলের নাম হয় ঠনঠনিয়া। আবার অনেকে বলেন, এই অঞ্চল বাড়বাড়ন্ত ছিল ডাকাতদের। ডাকাত পড়ার সম্ভবনা দেখা দিলে অঞ্চলের লোকেরা অন‍্যকে সজাগ করার জন‍্য এবং নিজের সাহায‍্যের জন‍্য ঠনঠন করে ঘণ্টা পেটাতো। আবার সুকুমার সেন তাঁর ব‌ইতে লিখেছেন, এই অঞ্চলের জমি ছিল এতোই অনুর্বর যে, কোদাল চালাতে গেলে ঠনঠন করে আ‌ওয়াজ হতো। এরমধ‍্যে কোনওটাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

শ‍্যামবাজার: এই অঞ্চলে বসবাসকারীরা মূলত ছিলেন শেঠ এবং বসাক পরিবার। হল‌ওয়েলের কথায়, বাজারটির আদি নাম হিসাবে পাওয়া যায় ‘চার্লস বাজার’। শোভারাম বসাকের গৃহদেবতা শ‍্যাম রায়ের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম হয় শ‍্যামবাজার ।

তথ্য সূত্র:

১। শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’

 

More Articles