ভারতের পরাধীনতার শুরু গোলমরিচ থেকে! স্বাদে-গুণে ভরপুর এই মশলার ইতিহাস অবিশ্বাস্য

খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি গোলমরিচের গুণাগুণের কারণেই এর বিপুল চাহিদা পৃথিবীজুড়ে।

সকালের ব্রেকফাস্টে গোলমরিচ ছড়ানো মাখন টোস্ট বা অমলেটের স্বাদ নেওয়ার সময় আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, এই গোলমরিচের জন্মস্থান ভারত। এমনকী, ভারতে ইংরেজ শাসনের প্রথম একশো বছর যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের দেশে রাজত্ব করেছিল, সেই কোম্পানির পত্তনের নেপথ্যেও রয়েছে এই গোলমরিচ। কাকতলীয় হলেও সত্যি।

তবে ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা গেছে ১২১৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত মিশরের সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিসের মমিতেও পাওয়া গেছে গোলমরিচ। যার অর্থ, সেই জমানাতেও অস্তিত্ব ছিল গোলমরিচের। দক্ষিণ ভারতের মালাবারে জন্ম নেওয়া গোলমরিচ পাড়িও জমিয়েছিল মিশরে। কিন্তু সে-যুগে গোলমরিচের ব্যবহার ছিল একেবারে ভিন্ন। মূলত ওষুধ তৈরি করতেই ব্যবহার করা হতো গোলমরিচ, যার ফলে এর দামও ছিল আকাশছোঁয়া। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা যে-সমস্ত জিনিস পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আমদানি করত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল গোলমরিচ। ষষ্ঠ শতাব্দীতে গথরা রোম আক্রমণ করলে শান্তিচুক্তির দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল তিন হাজার পাউন্ড গোলমরিচ। চিনেও পাওয়া যেত ভারতীয় এই মরিচ। এবার গোলমরিচের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম নেওয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক।

ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালে ইংরেজদের প্রধান খাদ্যবস্তু ছিল বহুদিন আগে থেকে নুন মাখিয়ে রাখা মাংস আর শুঁটকি মাছ। মশলা দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য হওয়ায় দুর্গন্ধযুক্ত মাছ-মাংস কোনও মশলা ছাড়াই খেতে হতো সাহেবদের। বিকল্প কোনও উপায় না থাকায় সেই খাবারই খেতেন ইংরেজরা। বিশ্রী গন্ধযুক্ত খাবারে খানিক স্বাদ যোগ করতে এবং আরও বেশিদিন ধরে খাবারকে সংরক্ষণ করার তাগিদেই কিছুদিন পর থেকে পর্তুগিজদের থেকে মশলা কিনতে শুরু করল ইংল্যান্ড। সুযোগ বুঝে তারাও দাম বাড়িয়ে দিল মশলার। ট্যাঁকের কড়ি বাঁচাতে ওলন্দাজদের থেকে মশলা কিনতে গিয়েও একই বিপদ। ঝোপ বুঝে ইংরেজদের ওপরে কোপ বসাল তারা। কয়েকমাসের মধ্যেই মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল অবস্থা সাহেবদের। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতেই বৈঠক করলেন আশি জন সাহেব। আর এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনেই জন্ম নিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

আরও পড়ুন: মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাতদের পানীয় থেকে কিভাবে সাধারণ ভারতীয়র এনার্জি ড্রিংক কিভাবে হয়ে উঠলো কফি, জানেন?

১৬০১ সালে ইংল্যান্ডের জাহাজ এসে দাঁড়াল ভারতের উপকূলে। পরের আড়াই বছরে দশ লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ সংগ্রহ করে ফেরত গেল সেই জাহাজ।১৬২০ সালে আড়াই লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ কিনেছিলেন পাউন্ড প্রতি আড়াই পেনি দরে। আর বিক্রি করেছিলেন প্রায় আটগুণ বেশি দামে। ইংরেজদের পিছু ধরে পর্তুগিজ, ওলন্দাজরা গোলমরিচের খোঁজে ঢুঁ মারেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দ্বীপে। পরবর্তীকালে তাঁরা ইউরোপে গোলমরিচ বেচে অর্থ উপার্জন করলেও অনেক আগেই সেদেশে পৌঁছে গিয়েছিল ভারতীয় মরিচ।

গোলমরিচের উপাদান
খাবারের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি গোলমরিচের গুণাগুণের কারণেই এর বিপুল চাহিদা পৃথিবীজুড়ে। নানা পুষ্টি উপাদান রয়েছে গোলমরিচে। কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, প্রোটিনসমৃদ্ধ গোলমরিচে ভিটামিন বি-২, বি-৬, সি, কে রয়েছে। আয়রন, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ক্রোমিয়ামের মতো মিনারেলও রয়েছে। পিপারিন নামক এক রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণেই স্বাদে ঝাল হয় গোলমরিচ।

গোলমরিচের উপকারিতা
১. হজমের সহায়ক
গোলমরিচে থাকা পিপারিন অন্ত্রে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার দ্রুত হজম হয়ে যায়। তাই প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে গোলমরিচ খেলেই গ্যাস-অম্বলের সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব।

২. ক্যানসার প্রতিরোধক
পিপারিন বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম এবং ওষুধ তৈরি করতেও কাজে লাগে। গোলমরিচের মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার কোশের বৃদ্ধি রোধ করে।

৩. অ্যান্টিবায়োটিক
গোলমরিচ প্রাকৃতিক উপায়ে ব্যাকটেরিয়ারোধী হওয়ার পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবেও কাজ করে। এর মধ্যে থাকা ভিটামিন সি সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা কমিয়ে দেয়। কখনও ঠান্ডা লাগলে মধুর সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে খেয়ে দেখবেন দারুণ কাজ হয়।

৪. টক্সিন দূর করে
টক্সিন আমাদের শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। গোলমরিচ শরীর থেকে ঘামের মাধ্যম টক্সিন বের করে দেয়। তাছাড়া ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যা থাকলেও গোলমরিচ খেলে উপকার পাবেন।

৫. সংরক্ষণকারী
গোলমরিচ খাবারের পচন রোধ করে ফলে খাদ্যদ্রব্য অনেকদিন পর্যন্ত ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায় বাড়িতে।

৬. মেদ ঝরায়
গোটা গোলমরিচের খোসা অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। তাই যাঁরা রোগা হতে চান, গোলমরিচ দিয়ে খাবার বানিয়ে খাওয়া শুরু করুন আজই।

তবে গর্ভাবস্থায় বা সদ্য মা হয়েছেন এমন মহিলাদের অতিরিক্ত গোলমরিচ না খাওয়াই ভালো। কোলেস্টরল ব্যতীত প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান গোলমরিচে থাকায় নিশ্চিন্তে খাবারে ব্যবহার করুন ভারতীয় মরিচ।

More Articles