শিশুদের বড় বিপদের সংকেত দিচ্ছে মাঙ্কিপক্স, আবার নতুন ভাইরাস-আতঙ্ক ভারতে?

ইতিমধ্যেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিশুদের ওপর মাঙ্কিপকের প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা।

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতেই (কেরল) প্রথম ধরা পড়েছিল মাঙ্কিপক্স। ফের কেরলেই ১৮ জুলাই মাঙ্কিপক্সের দ্বিতীয় ঘটনা নজরে আসে। একত্রিশ বছর বয়সি সেই আক্রান্ত ব্যক্তি দুবাই থেকে গত ১৩ জুলাই কেরলে এসে পৌঁছেছিলেন। ইতিমধ্যেই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিশুদের ওপর মাঙ্কিপকের প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা।

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক‍্যাল সায়েন্স বা এমস-এর ডিপার্টমেন্ট অফ মেডিসিনের অধ্যাপক প্রফেসর পীযূষ রঞ্জন এএনআই-কে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, "শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুতর প্রভাব দেখা যাতে পারে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে।"

মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস সাধারণত ছড়াতে পারে ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, কাঠবেড়ালি, বাঁদর, এমনকী, মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কুকুরের থেকেও। হু-এর বক্তব্য অনুযায়ী, মাঙ্কিপক্স যৌন সংসর্গ, বিশেষ করে সমকামী পুরুষদের মধ্যে যৌন সংসর্গের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বকে দেখা যাওয়া ফুসকুড়ি, তার ত্বকের চামড়া, বা দেহরস থেকে ছড়াতে পারে মাঙ্কিপক্স।

আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্স আতঙ্কের আঁচ ভারতেও, যৌন সম্পর্ক থেকেই সংক্রমণ? চিন্তায় চিকিৎসকরা

কোভিডের ক্ষেত্রে যেমন অনেক সময়েই রোগের লক্ষণ দেখা যায় না, মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে একটি সুরাহা হলো মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে দেহে তার স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠে। সেক্ষেত্রে শিশুরা, এমনকী, বড়রাও যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে না পারে, সেই দিকে খেয়াল রাখা উচিত। এছাড়া উচিত ইঁদুর, কাঠবেড়ালি, বা বাঁদরের থেকে দূরে থাকা।

"তবে শিশুদের ক্ষেত্রে রোগের ভয়াবহতা বেশি হলেও, তাদের মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তাই চিন্তার বিশেষ কারণ নেই।" পাশাপাশি এমনটাও জানিয়েছেন ড. পীযূষ রঞ্জন।

এএনআই সূত্রেই জানা যাচ্ছে, পীযূষ রঞ্জন জানিয়েছেন, মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ চিকেন পক্স বা স্মল পক্সের মতোই। "রোগের শুরুতে রোগীর জ্বর দেখা যাবে, পাশাপাশি শরীরের লিম্ফ নোডগুলিও ফুলে স্থূল হয়ে উঠবে। এক থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই মুখ, হাতের পাতা ও পায়ের চেটোতে স্মল পক্স বা চিকেন পক্সে দেখা যাওয়া ঢুলি বা ফুসকুড়ির মতো দেখা যেতে পারে। তবে চোখের কর্নিয়াতে যদি ফুসকুড়ি দেখা যায়, সেক্ষেত্রে কিন্তু অন্ধত্বের দিকে এগোতে পারে শিশু", এএনআই-কে জানিয়েছেন পীযূষ রঞ্জন।

কিন্তু হাত ও পা ছাড়াও, যৌনাঙ্গ এবং পায়ুতেও ফুসকুড়ির মতো দেখা দিচ্ছে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, যৌনাঙ্গ এবং পায়ুতেও ফুসকুড়ি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে রোগী হারপিস বা সিফিলিসে আক্রান্ত।

আইসিএমআর-ন্যাশালান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির (পুনে) বিজ্ঞানী ড. প্রজ্ঞা যাদব 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-কে একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, "মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা রয়েছে শিশু, গর্ভবতী মহিলা, ডায়বেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের।"

'প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া' বা পিটিআই সূত্রে জানা যাচ্ছে, হু-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব-এশিয়া সতর্ক হয়ে গেছে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ রুখতে। তার জন্য দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং যথাযথ পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে, জানিয়েছেন তিনি। ১২ জুলাই আরব থেকে আসা এক উড়ানে এক মাঙ্কিপক্স-আক্রান্ত পঁয়ত্রিশ বছর-বয়সি পুরুষ কেরলে পৌঁছন, ১৪ জুলাই নিশ্চিত করা হয়, সেই ব্যক্তি মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত। ততদিন পর্যন্ত কিন্তু মাঙ্কিপক্সের ঘটনা অন্তত ভারতে দেখা যায়নি। আর সেই ঘটনার পরে কেরল-সহ পাঁচটি রাজ্যে সতর্কতা জারি হয়।

ইতিমধ্যেই সমগ্র বিশ্বে মোট ৬০০০ জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন তিনজন। ২০২২ সালের শুরু থেকে এ-পর্যন্ত মোট ষাটটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মাঙ্কিপক্স। মাঙ্কিপক্সের বেশিরভাগ ঘটনাই দেখা গিয়েছে ইউরোপের দেশগুলিতে, আর তার পরেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেখতে গেলে, ছিয়াশি শতাংশ ঘটনাই দেখা গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১১ শতাংশ ঘটনা দেখা গিয়েছে। তবে কেবল ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইতিমধ্যেই মাঙ্কিপক্স ইংল্যান্ড এবং আফ্রিকার একাধিক দেশে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকা তো বটেই রোগ ছড়িয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীর দেশগুলিতেও।

রয়টার্স সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইউরোপীয় কমিশন অতিরিক্ত চুয়ান্ন হাজার মাঙ্কিপক্সের ভ্যাকসিন ডোজে়র ব্যবস্থা করেছে। এবং তার আগে প্রাথমিকভাবে এক লক্ষ দশ হাজার ভ্যাকসিন ডোজে়র ব্যবস্থা হয়েছিল। মাঙ্কিপক্সের এই ভ্যাকসিনগুলোর নির্মাতা বেভেরিয়ান নর্ডিক নামের এক বায়োটেক সংস্থা, যাদের মূল অফিস ডেনমার্কে।

তাহলে কোভিডের মতোই মাঙ্কিপক্সেরও কি বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে? আশার বিষয় হলো, কোভিডের মতো করে সহজে ছড়াতে পারে না মাঙ্কিপক্স। এই রোগে আক্রান্ত হলে কোনও দীর্ঘকালীন শারীরিক প্রভাবও থাকে না রোগীর শরীরে। সাধারণত কিছু দিনের মধ্যেই সেরে যায়। সাবধানতা অবলম্বন করলেই এর সংক্রমণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

ড: পুনম ক্ষেত্রপাল সিং আরও জানাচ্ছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে সমস্ত দেশে ইতিমধ্যেই মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা নজরে এসেছে, সেই দেশগুলিতে মাঙ্কিপক্স-জনিত যে আশঙ্কাগুলি দেখা যেতে পারে, তার জন্য ইতিমধ্যেই কড়া পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে হু। মাঙ্কিপক্স আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা হবে, হু তার জন্যও প্রস্তুত।

তবে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ শরীরে দেখতে পেলেই, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। আর যাই হোক, কোভিডের মতো এই রোগ কথা বলার সময়, বা হাঁচি-কাশির সময় বের হওয়া ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়াতে পারে না।

 

 

More Articles