ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের নাম কেন 'অশনি'? নামের মধ্যেই কি লুকিয়ে বিপদের পূর্বাভাস?

এবার মার্চে ঘূর্ণিঝড় অশনি ধেয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তবে মার্চ মাসের চেয়ে এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এক লহমায় বদলে গেল বাংলার আবহাওয়া। সোমবার সকালে ঝলমলে রোদের দেখা মিললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ ভার হয়ে এল আকাশের। আলিপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে খবর, শক্তি বাড়িয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে 'অশনি'। হাওয়া অফিসের সকাল ১০টার বুলেটিন বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড় বিশাখাপত্তনম অর্থাৎ অন্ধ্র উপকূল থেকে এখনও ৫৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। পুরীর উপকূল থেকে অশনির দূরত্ব ৬৮০ কিলোমিটার। শেষ চার-পাঁচ ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটার শক্তি বাড়িয়ে এই মুহূর্তে ২৫ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় অশনি। মঙ্গলবার সকাল থেকে উড়িষ্যা উপকূলের দিকে বাঁক নেবে এই ঘূর্ণিঝড়। সোমবার সকালে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। তবে এদিন দুপুর বারোটার পর থেকেই কেন্দ্রের গতিবেগ হ্রাস পেয়ে হবে ঘণ্টায় ৯৫ -১১৫ কিলোমিটার।

তবে মৌসম ভবন বলছে, সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত বজায় থাকবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রবল শক্তি। মঙ্গলবার সারাদিন সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেবে অশনি। বুধবার গভীর নিম্নচাপের রূপ নেবে এটি। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, জাওয়াদের মতোই সমুদ্রেই শক্তি হারাতে পারে অশনি। অশনির জেরে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। বৃষ্টি ছাড়া বাংলায় অশনির প্রভাব পড়বে কতখানি, তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানায়নি মৌসম ভবন।

আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন, গ্রীষ্মের শুরুতেই আছড়ে পড়তে পারে অশনি। ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বাংলা বা উড়িষ্যার উপকূলে আছড়ে পড়বে এই ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু এমনটা হয়নি। তবে তারা নিশ্চিত ছিলেন এ-বছরের প্রথম ঘূর্ণিঝড় হতে চলেছে 'অশনি'। কীভাবে?

 

আরও পড়ুন:আর দার্জিলিং-গ্যাংটক নয়, গরমের ছুটি কাটান কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এই গ্রামে

'অশনি'-র নামকরণ


ভারতীয় মেটরিওলজি বিভাগের পোস্ট করা তালিকা থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় অশনির নাম দিয়েছে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। সিংহলি ভাষায় 'অশনি' শব্দের অর্থ- ক্রোধ।

এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালে আটলান্টিক অঞ্চলে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই ঝড়ের নামকরণ করা শুরু হয়। ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে যে এলাকাগুলোতে, সেখানকার মানুষদের সতর্কবার্তা দিতেই এই নামকরণ পদ্ধতি শুরু করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে যে মহাসাগরের ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, তার অববাহিকার দেশগুলো সেই ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে । একবিংশ শতাব্দীর গোড়াতে শুরু হওয়া এই পদ্ধতি অনুসারে আজ বিশ্বের ১১টি প্রতিষ্ঠান ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে। সেই মতো এবারের পালা পড়েছিল শ্রীলঙ্কার ওপর।

২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উত্তর ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ দিয়ে শুরু। সেই সময় আটটি দেশ নামের পরামর্শ দিত। পরবর্তী সময়ে সেই সংগঠনে আরও পাঁচটি দেশ যোগ দেয়। আপাতত ওই সংগঠনের দেশগুলো হল: বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেন।

পূর্ব-নির্ধারিত পথেই ঠিক ছিল, ২০২২-এ যে ঝড় প্রথম ধেয়ে আসবে, তার নাম হবে অশনি। ২০২০ সালে যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, তার প্রথম সারির ১০ নম্বর নাম অশনি। এই প্রথম সারির আগের ৯টি নাম ব্যবহার হয়ে গিয়েছে ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আমফান ছিল ২০০৮ সালে তৈরি তালিকার শেষ ঝড়। তারপর ২০২০ সালে প্রকাশিত ১৩টি নামের তালিকা থেকে ব্যবহার করে হচ্ছে এর নাম। এই তালিকায় বাকি তিনটি নাম সিতরং, ম্যানডৌস ও মোচা। নামগুলি দিয়েছে যথাক্রমে থাইল্যান্ড, আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেন। এরপর থেকে শুরু হবে, দ্বিতীয় সারির তালিকাতে থাকা নামের ব্যবহার। এই তালিকার মোট ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়েছে।

ভারতের দেওয়া যে নামগুলো পূর্বে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো হল গতি, মেঘ এবং আকাশ। অগ্নি, হেলেন এবং ফণী ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের দেওয়া যে নামগুলো এখনও পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো হল লায়লা, নার্গিস এবং বুলবুল। গত বছরের শেষে জাওয়াদ নামক যে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল, তার নামকরণ করেছিল সৌদি আরব। ইয়াসের নাম দেয় ওমান।

২০১৯ সালে ভারতের সমুদ্রে মোট ৯টি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছে উপকূল এলাকাতে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে এটাই সর্বাধিক সংখ্যক ঘূর্ণিঝড়। ২০১৯-এ যে ৯টি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল, তার নাম ছিল পাবুক, ফণী, বায়ু, হিক্কা, কায়ার, মহা, বুলবুল, পবন এবং জেটিডব্লিউসি। গত বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে প্রাক-বর্ষা মরশুমেই দু'টি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে, যা আমফান এবং নিসর্গ নামে পরিচিত। বর্ষা-পরবর্তী সময়ে আরও তিনটি ঘূর্ণিঝড় হয়। মোট পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় দেখা গিয়েছিল গত মরশুমে। গত বছরের প্রথম ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আছড়ে পড়েছিল তাউটে বা তাউকটে। সেই পথ ধরেই ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, ঘূর্ণিঝড় গুলাব, ঘূর্ণিঝড় শাহিন আর সবশেষে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ আছড়ে পড়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলের উপকূলে।

এবার মার্চে ঘূর্ণিঝড় অশনি ধেয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তবে মার্চ মাসের চেয়ে এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নিরক্ষীয় ভারত মহাসাগরের ওপর গত ১০০ বছরে মাত্র তিনটি ঘূর্ণিঝড় ঝড় তৈরি হয়েছে মার্চে। এই ঝড়গুলোর গঠন মাসের শেষের দিকে হয়। তবে সেই আশঙ্কা শেষমেশ বাস্তব রূপ নিল মে মাসে। এই অবস্থায় নবান্নের তরফে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে উপকূলের অঞ্চলগুলোতে।

More Articles