ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কাজ করবে তো বাজারের পুরনো ভ্যাকসিনগুলি?

কিছুটা কমলেও এখনও সারা বিশ্বে করোনা ভাইরাসের কিছুটা হলেও প্রভাব রয়েছেই। ২০১৯ সালে চিনের উহান প্রদেশ থেকে আবিষ্কৃত এই ছোট্ট আরএনএ ভাইরাসটি সারা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছিল খুব কম সময়ের মধ্যেই। প্রায় দেড় বছর ধরে মানুষকে ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি করে রেখেছিল এই আনুবীক্ষণিক ভাইরাস। ক্রমাগত নিজের পরিবর্তন ঘটিয়ে (জিন মিউটেশন) নতুন করে বিপদ বাড়িয়েছে বারবার। সে বিটা স্ট্রেন হোক কিংবা ভারতে ত্রাস ছড়ানো ডেল্টা, ভারত তথা সারা বিশ্বের কাছে দীর্ঘ দুই বছর ধরে ত্রাস হয়ে থেকেছে করোনাভাইরাস।

গোটা ২০২১-সালে জুড়েই দাপট দেখিয়েছে করোনা। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে বিশ্বের মেডিকেল সিস্টেম। ঘন্টার পর ঘন্টা পিপিই কিট পরে মানুষের সেবায় রত ছিলেন সমস্ত ডাক্তাররা। করোনার সঙ্গে সঙ্গে লড়াইয়ে তারাও প্রাণ হারিয়েছেন। করোনা যোদ্ধাদের তালিকায় ডাক্তার থেকে শুরু করে পুলিশকর্মী সকলেই রয়েছেন,  সবার আড়ালে থেকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা। এদেশের ভারত বায়োটেক কিংবা সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে বিদেশের ফাইজার এবং জনসন অ্যান্ড জনসন- বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত করোনা ভাইরাসের প্রত্যেকটি ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে লড়াই করার বিশল্যকরণীর খোঁজে নিরত এখনও।  

কোভিডের  দ্বিতীয় ঢেউয়ের বাড়বাড়ন্ত তখন। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মাত্র ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যেই তৈরি করা হলো ভ্যাকসিন। যখন কোনও মানুষের দেহে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস প্রবেশ করে, তখন আমাদের দেহের শ্বেত রক্তকণিকা অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমেও সেই ভাইরাসটিকে কিংবা ব্যাকটেরিয়াটিকে শরীরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ইমিউনিটি, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় অনাক্রম্যতা। কিন্তু কিছু কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া এমন থাকে যা শরীরের শ্বেত রক্তকণিকার কাছে অত্যন্ত অচেনা। তাই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা শরীরের পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ হয় না। ঠিক সেরকমই একটি ভাইরাস হলো করোনা।

আরও পড়ুন-শেষ হচ্ছে কোভিডবর্ষ, বাজিগর এই পাঁচটি ট্রেন, অসময়েও লক্ষ্মীলাভ…

যদি সহজ ভাবে বোঝা যায়, তাহলে আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডি হল আদতে অনেকটা বিএসএফ জওয়ানদের মত। যখন ভারতে জঙ্গি গোষ্ঠীর আক্রমণ হয় তখন সবার আগে তাদের মোকাবিলা করে বিএসএফ। কিছুটা সেরকম ভাবেই আমাদের শরীরকে বাইরে থেকে আগত ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে রক্ষা করে এই অ্যান্টিবডি। তবে শরীরের শ্বেত রক্তকণিকার দ্বারা তৈরি করা অ্যান্টিবডি সাধাণনত খুব শক্তিশালী ঘাতক কোনও ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া থেকে আমাদের দেহকে সুরক্ষিত রাখতে পারে না। আর যে ভাইরাসকে কোনও দিন পৃথিবী দেখেইনি তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো আর মুখের কথা নয়। 

​​​​​​ওমিক্রন আলাদা কেনো?

এ রকমই শরীরের শ্বেত রক্তকণিকার কাছে অচেনা একটি রোগ হিসেবে ধরা দিয়েছিল কোভিড-১৯। আর এই রোগের প্রধান ভাইরাস ছিল সার্স-কোভ-২। এই সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির প্রায় ২০০ এর থেকেও বেশি ভ্যারিয়েন্ট ইতিমধ্যেই ঘোরাফেরা করছে পৃথিবীতে। তার মধ্যেই একটি ছোট্ট ভ্যারিয়েন্ট বর্তমানে মানুষের সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ছোট্ট ভেরিয়েন্টটির নাম ওমিক্রন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ এর সবথেকে বেশি ক্ষতিকারক ভেরিয়েন্টগুলির মধ্যে আলফা, বিটা, ডেল্টা, গামা এবং ওমিক্রণ। আর এই নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আগের সবকটি প্রজাতির থেকেও কয়েকগুণ বেশি সংক্রমিত হতে পারে। অতএব বুঝতেই পারছেন, এই নতুন ভেরিয়েন্ট মানব শরীরের জন্য ঠিক কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।

অ্যান্টিবডি ও টি-সেল

আমাদের দেহের শ্বেত রক্তকণিকার দ্বারা তৈরি অ্যান্টিবডি প্রতিনিয়ত ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। কিন্তু, সবকিছুর মতই আমাদের শরীরের অ্যান্টিবডিও একটা সময় পরে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়তে শুরু করে, এবং তখনই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মানব দেহকোষে প্রবেশ করে করোনা ভাইরাসের মত ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া। কিন্তু, কোনও ভাইরাস নিজে নিজে বাঁচতে পারে না, তার কোন না কোন একটা কোষ প্রয়োজন হয়। যদি কোনও ভাইরাস কোষের ভিতরে প্রবেশ করে যায়, তখন আর অ্যান্টিবডি আর কাজ করতে পারে না। 

যদি সাধারণ অ্যান্টিবডি ওই ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে না পারে, তখন কাজ শুরু হয় অনাক্রম্যতার দ্বিতীয় ধাপের যেখানে কাজ করে শরীরের প্রত্যেকটি কোষের টি - সেল। যে কোন ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এদের কাজ করার পদ্ধতি একেবারে আলাদা। এই সমস্ত টি-সেল ভাইরাসের প্রোটিন স্পাইকগুলিকে শনাক্ত করে ভাইরাসগুলিকে চিনে নেয়। তার সাথেই এই সমস্ত টি সেল পুরো ভাইরাসের সম্পূর্ণ দেহগঠন শনাক্ত করে নির্দিষ্ট কোষের ভিতরেই ভাইরাসটিকে মেরে ফেলে। এই সমস্ত টি-সেল আমাদের শরীরে একটি বিশেষ ধরনের মেমোরি তৈরি করে যাকে ইমিউনিটি মেমোরি বলা হয়। এই ধরনের ইমিউনিটি মেমোরি দীর্ঘদিন আমাদের দেহে কার্যকরী থাকে। এই মেমোরির মাধ্যমে শরীরের টি-সেল মনে রাখতে পারে ভাইরাসের চরিত্র এবং পরবর্তীতে যখনই ভাইরাস আবারো মানব দেহকে আক্রমণ করে তখন টি-সেল নিজের কাজ সঠিক ভাবে করতে পারে। এই কারণেই প্রতিদিন কোটি কোটি ভাইরাস আমাদের দেহে আক্রমণ করলেও খুব কম সময়ই আমরা অসুস্থ হই।

ভ্যাকসিন কী ভাবে কাজ করে?

এই টি-সেল দুইভাবে আমাদের দেহকে সাহায্য করে থাকে। প্রথমত হলো, বাইরে থেকে প্রবেশকারী কোনও ভাইরাসকে দমন করা এবং দ্বিতীয়ত হলো অ্যান্টিবডি এবং অন্যান্য টি-সেল তৈরিতে সাহায্য করা। এছাড়াও বি - সেল, যারা অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে ঘাতক টি - সেল। এছাড়াও সাহায্যকারী টি - সেল তৈরি করতেও অংশগ্রহণ করে এই ঘাতক টি-সেল। কিন্তু যখন সমস্ত টি - সেল এবং অ্যান্টিবডি ব্যর্থ হয়ে যায়, সেই সময় বাইরে থেকে অনাক্রম্যতা শরীরে প্রবেশ করানোর প্রয়োজন পড়ে এবং সেখানেই কাজ করে ভ্যাকসিন। 

তবে ভ্যাকসিন প্রথম প্রথম শরীরে প্রবেশ করলেও তার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে শরীর ভ্যাকসিনের অঙ্গাণুগুলিকেও ক্ষতিকারক বলেই মনে করে, তাই তার বিরুদ্ধেও তৈরি করে অনাক্রম্যতন্ত্র। তারপর ধীরে ধীরে মানব শরীর এই ভ্যাকসিন এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়। ভ্যাকসিন সাধারণত কাজ করে কোনও অচেনা ভাইরাসের প্রতিলিপির মত। সবাই যেমন সাইকেল চালানো শিখে তারপর বাইক অথবা স্কুটির মত দু চাকার যানবাহন চালাতে পারে, ঠিক তেমনভাবেই কাজ করে ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন শরীরে প্রবেশ করে শরীরের মধ্যে থাকা অ্যান্টিবডি এবং টি-সেলগুলিকে জাগিয়ে তোলে এবং নিজে ওই ভাইরাসের প্রতিলিপি হয়ে কাজ করে শরীরকে শেখায় কী ভাবে করোনাভাইরাস এর মত কোনও ক্ষতিকারক ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।

যখন আমাদের মানব শরীরের অনাক্রম্যতা তন্ত্র ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শিখে যায় তখন ভ্যাক্সিনের কাজ শেষ। টি-সেল সেই সময় ইমিউনিটি মেমোরি তৈরি করে ফেলে। এরপর ভবিষ্যতে যখন কোন আসল ভাইরাস শরীরে আক্রমণ করে, তখন টি-সেল ওই মেমরি কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই সেই ভাইরাসকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। 

​​​​​​ওমিক্রন বনাম পুরোনো করোনা ভ্যাকসিন 

ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, ওমিক্রন একটু ভিন্নতর করোনাভাইরাস। ওমিক্রন যদি আপনার দেহে আক্রমন করে তাহলে কিন্তু আপনার অনাক্রম্যতাতন্ত্রকে খুব সহজেই বাইপাস করতে পারে। তবে হ্যাঁ, যদি ভ্যাকসিন গ্রহণ করা থাকে তাহলে আপনার দেহের টি-সেল ইমিউনিটি মেমোরি ব্যবহার করে ওমিক্রনকে বাধা দেবে। ওমিক্রন যতই অন্য ধরনের করোনা ভাইরাস হোক না কেন, প্রোটিন স্পাইক প্রত্যেকটি করোনা ভাইরাসের প্রায় একই রকম হয়। তাই, আপনি সঠিকভাবে দুটি ভ্যাকসিন ডোজ গ্রহণ করলে আপনার দেহ ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করতে পারবে। যাদের এর আগেও করোনা হয়েছে এবং যারা দুটি ডোজের ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন তাদের ক্ষেত্রে ওমিক্রন খুব একটা বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না। 

কিন্তু যদি আপনার ভ্যাকসিন নেওয়া না হয়ে থাকে তাহলে ওমিক্রন আপনার দেহকে টার্গেট করতে পারবে খুব সহজে। বর্তমানে যে সমস্ত ভ্যাকসিন ভারতে উপলব্ধ তাদের মধ্যে কোভ্যাকসিন, কোভিশিল্ড, এবং স্পুটনিক - ভি ওমিক্রণ এর বিরুদ্ধে ভালো ফলাফল দেখিয়েছে। তবে আপনাদের জানিয়ে রাখি, ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন মানেই যে করোনাভাইরাস আপনাকে আর আক্রমণ করতে পারবে না সেরকম নয়। বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, সার্স-কোভ-২ এর একাধিক ভেরিয়েন্ট ভবিষ্যতেও তৈরি হতে পারে। তাই করোনা ভাইরাস বিধি পালন করুন, ভ্যাক্সিনেশন করিয়ে রাখুন, তাতে আপনি করোনা ভাইরাসের সমস্ত ভেরিয়েন্ট এর সঙ্গে মোকাবিলা অন্তত করতে পারবেন।

More Articles