নেতাজির অন্তর্ধান রহস্যের আড়ালের দেশদ্রোহীরা!

নেতাজির কথা মনে আসে তখনই মনে পরে কীভাবে এক বাঙালির প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। মনে পরে কীভাবে এক বাঙালির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। মনে পরে কীভাবে এক দক্ষ বাঙালি ভারতমাতাকে পরাধীনতার থেকে মুক্ত করার জন্য বলিদান দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে অনেক ধোঁয়াশা আছে যার কারণে আমার মতো বহু ভারতবাসীর পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় যে,  নেতাজির এই বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল। 

আসুন দেখেনি ঠিক কী কী ঘটেছিল ওই বিমান দুর্ঘটনার আগে। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জাপান থেকে ভারতের উদ্দেশে অগ্রসর হন। নদী-পর্বত পেরিয়ে ১৬০০০ পুরুষ এবং ১০০ মহিলার সৈন্য নিয়ে বর্মায় পৌঁছে যান। মে মাসে ব্যাঙ্কক পৌঁছানোর আগে থেকে কিছু সৈন্য তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছেড়ে চলে যায়। ২০০০ সালের দিকে বামপন্থীরা যে লক্ষ্মী সায়গলকে রাষ্ট্রপতি করতে চাইছিলেন তিনিও এই সময় আজাদ হিন্দ ফৌজ ত্যাগ করেন। কিন্তু পরে তাঁকে রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতা দখল করার জন্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বলে। যাঁরা নেতাজিকে ছাড়তে পারেননি দেশকে ভালবাসেন বলে, তাঁদের মধ্যে অনেকে ইম্ফল এবং কোহিমার যুদ্ধে সম্মানের মৃত্যু বরণ করেন। যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অনাহারে অপুষ্টিতে দেশের জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। অনেক সৈনিক ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়েন কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কোনও খোঁজ মেলেনি। ৮ মে ১৯৪৫, জার্মানি বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলে নেতাজি ব্যাঙ্কক থেকে নিজের সৈন্যর জন্য অর্থ জোগাড় করার  উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই অর্থ নেতাজি সৈন্যদের সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে আনবার কাজে ব্যাবহার করতে চাইছিলেন। এই সময় দেখা গিয়েছিল যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের কয়েকজন অফিসার নেতাজির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছেন। অগস্ট ১৯৪৫-এ নেতাজি বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাঁর জীবন বিপন্ন এবং জাপানের তাঁর থাকাটা নিরাপদ নয়। কারণ ব্রিটিশ এবং আমেরিকা মালয় দখল করার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন আক্রমণ শুরু করেছিল এবং রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া দখল করেছিল ১০ জুন। এরপর আমেরিকা হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পর পর দুটি পরমাণু বোমা ফেলে জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল ১৬ অগস্ট।

এই ১৬ থেকে ১৮ অগস্ট ১৯৪৫, আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, জাপান আত্মসমর্পণ করার পর পরই নেতাজি সিঙ্গাপুর থেকে সাইগনের উদ্দেশে পাড়ি দেন ১৬ তারিখ। সাইগনে গিয়ে নেতাজি দক্ষিণ-পূর্ব জাপানি সৈন্যর প্রধানের সঙ্গে দেখা করে রাশিয়ায় উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন যাতে সেখান থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু সেনা প্রধান তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেও করতে পারেননি, কারণ জাপানের ইম্পেরিয়াল জেনারেল হেডকুয়াটার সে অনুমতি দেয়নি। তা সত্ত্বেও, সেনা প্রধান টেরাউচি নিজের উদ্যোগে একটি যুদ্ধবিমান নেতাজির জন্য দিয়েছিলেন। এখানেই নানা লোকের নানা কথা আমাদের সামনে আসছে। অনেকে বলছেন যে এই বিমান ১৬ই আগস্ট ১৯৪৫, জাপান-আইএনএ-র যৌথ শাখা হিকারি কিরানের প্রধান সাবুরো ইসোডা নেতাজীর জন্য নিয়ে এসেছিলেন ব্যাংককে কারণ টেরাউচি সেখানে ছিলেনই না। ১৭ই আগস্ট নেতাজী সিংগাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি সভা করেন এবং আপাতত তা বরখাস্ত করার কথা ঘোষণা করেন। তবে তাঁর স্বাধীনতার লড়াই যে চলবে সেটাও তিনি জানিয়ে দেন। সেদিন দুপুররে তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে জাপান অধিকৃত ম্যানচুরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য বিমানে ওঠেন। ওখান থেকে রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলে রাশিয়া অধিকৃত মাঞ্চুরিয়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। ১৭ অগস্ট দুপুরে বিমান উড়ে যায় এবং ১৮ অগস্ট দুপুরে তাইহোকু বিমানবন্দরে তা অবতরণ করে। বলা হচ্ছে যে, তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে বিমানটি উড়ে যাওয়ার সময় বিমানে বিস্ফোরণ ঘটে এবং নেতাজির মৃত্যু হয় সেখানেই। এই বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির যে দেহ অবশেষ পাওয়া গেছে তা দেখে বোঝা যায়নি যে তা ওঁর। এই দেহ অবশেষ এখনও জাপানে সংরক্ষণ করে রাখা আছে কিন্তু তার কোনও ডিএনএ পরীক্ষা হয়নি, যার থেকে আমরা বলতে পারব যে সেই অবশেষ নেতাজিরই। কিন্তু বলা হয়েছিল যে, নেতাজি বিমান দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালেও বেঁচে ছিলেন। নেতাজি হাসপাতালে জীবিত থাকলে এই অবশেষ কী করে পাওয়া গেল তা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। নেতাজি অসীম সাহস এবং বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন তাই চারিদিকে শত্রু জেনেও তিনি কোনও পরিকল্পনা ছাড়া কোনও কাজ করবেন বলে অনেকেই মনে করেন না। অনেকে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, নাকি তাঁকে রাশিয়া খুন করেছিল তার উপর সন্দেহ প্রকাশ করেন। আবার অনেকেই মনে করেন,  যে নেতাজি ওই বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। 

নেতাজি যে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। কথিত আছে, নেতাজি রাশিয়া হয়ে ভারতে ফিরে এসে সন্ন্যাসীর বেশে আত্মগোপন করেছিলেন। গান্ধী এবং নেহেরুর মৃত্যুর পর তাঁদের মরদেহে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। নেহেরুর মৃতদেহের সামনে তাঁর নাকি একটি ছবিও আছে। 

এমন একটি অভিযোগও শোনা গিয়েছিল যে, ১৯৪৫-এর ডিসেম্বর মাসে নেহেরু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে নেতাজির রাশিয়াতে আত্মগোপন করার খবর দেন এবং তাতে নেতাজিকে 'War Criminal' বলে উল্লেখ করেন। তবে, তার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কংগ্রেসের নেতা হয়েও কংগ্রেসিদের থেকেই চরম আঘাত পেয়েছিলেন নেতাজি। আজ অনেকে বলছেন এই খবর নাকি মিথ্যা। যখন নেতাজি প্রসঙ্গে নেহেরু নিয়ে আলোচনা হবে তখনই আরও একটি প্রশ্ন জন্মাবে। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে সেখানকার ভারতীয়রা নেতাজিকে সম্বর্ধনা জানিয়ে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিলেন যা ওই বিমানে ছিল। এই বিপুল অর্থ কোথায় গেল, তা নিয়ে সকলের মনে সন্দেহ। শোনা যায় যে, ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট নেতাজির মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে নেহেরু সেখানে যান এবং ওঁর হাতে নেতাজির বিপুল অর্থ তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু, আপনি যদি ভারত সরকারের হিসেব দেখেন তাহলে আপনি জানবেন যে, অতি সামান্য অর্থের হিসেব দেখানো আছে। বাকিটা কোথায় তা নেহেরুর আত্মাই বলতে পারবেন।

তথ্যসূত্র :-

https://en.wikipedia.org/wiki/Death_of_Subhas_Chandra_Bose

http://www.dnaindia.com/india/report-netaji-files-the-real-story-behind-nehru-s-letter-calling-subhash-chandra-bose-a-war-criminal-2169596

More Articles