বাঙালির নিজস্ব প্রেমের 'আইকন'! ঐন্দ্রিলা সব্যসাচীর প্রেম কেন হার মানাবে সিনেমাকেও
Oindrila Sharma-Sabyasachi Chowdhury: "আমাদের জীবনে আর কোনও নির্দিষ্ট ভালোবাসার দিন নেই। জীবনেও তা পালন করব না,” লিখেছিলেন সব্যসাচী
সব ভালোবাসার গল্প রূপকথার হয় না! বরং কিছু গল্প লেখা হয় বাস্তবের রুক্ষ মাটিতেও। যদিও তাতে টান বা প্রেম কিছুই সেভাবে কমে না! বরং জীবনের চড়াই-উতরাই পার করে আরও খাঁটি হয়ে ওঠে। ঠিক এরকমই এক প্রেমের গল্প উপহার দিয়েছে টলিউড! তবে, রিল লাইফে নয়, এই প্রেম বাস্তবের! যেখানে অনেকেই একে অপরের হাত ছেড়ে দিচ্ছেন একটুতেই, সেখানে চারটে হাত যেন একে অপরকে আরও জাপটে ধরছে, ভালো থাকার জন্য, ভালো রাখার জন্য। মেয়েটির বয়স অল্প। সিরিয়ালে অভিনয় করেন, ঐন্দ্রিলা শর্মা। ছেলেটিও অভিনেতা। বিগত কয়েক বছর ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ হিসেবেই তাঁকে চিনেছেন দর্শক, সব্যসাচী চৌধুরী। গত বছরের ঘটনা। ক্যানসার আক্রান্ত ‘জিয়ন কাঠি’র নায়িকা ঐন্দ্রিলা শর্মার লড়াই প্রতি মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরতে শুরু করেন অভিনেতা-প্রেমিক সব্যসাচী চৌধুরী।
কীভাবে হয়েছিল আলাপ পরিচয়?
‘ঝুমুর’ সিরিয়ালের মাধ্যমেই প্রথম টিভি পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন ঐন্দ্রিলা। তার বিপরীতেই সেখানে অভিনয় করেন সব্যসাচী। সিরিয়াল চলাকালীনই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের শুরু। এরপর আরও দু’ একটা সিরিয়াল এবং ওটিটি সিরিজে কাজ করেছেন দু’জনে কিন্তু একে অন্যের বিপরীতে নয়। কিন্তু ঐন্দ্রিলা-সব্যর বন্ধুত্ব ছিল অটুট। তারপর সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসাতে পরিণতি পেতে বেশি সময় নেয়নি। বন্ধুত্ব দিয়েই শুরু হয়েছিল একে অন্যের পাশে থেকে তাঁদের পথচলা।
ঐন্দ্রিলা শর্মা এবং সব্যসাচী চৌধুরী- এই দুই নাম ও এঁদের জুটি প্রেমের এক অন্যতম উদাহরণ হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিককালে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যতই এঁদের দু’জনকে দেখে, ততই অবাক হয়। এই অনলাইন ডেটিংয়ের সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষ যখন চিরস্থায়ী সম্পর্কের থেকে প্রায় মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে, সেই সময়েই ব্যতিক্রম হিসেবে নিজেদের বারবার প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী ও ঐন্দ্রিলা। হালফিলের যুগলদের মধ্যে কমিটমেন্টের সমস্যা খুবই গুরুতর। নিজেদের ব্যস্ততায় সঙ্গীর পাশে দাঁড়ানো তো দূর, সময় দিতেই নারাজ অনেকে। সেই সময়ে অসুস্থ বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছেন সব্যসাচী চৌধুরী। সোশ্যাল মিডিয়ায় সব্যসাচীর এক একটি পোস্ট মুহূর্তেই ভাইরাল হয়েছে। ঐন্দ্রিলার অসুস্থতার সময় দিনের পর দিন তাঁর পাশে থেকেছেন সব্যসাচী চৌধুরী।
আরও পড়ুন- ‘মিরাকল’ না কি বিজ্ঞান, ঐন্দ্রিলা ফিরে এলেন মানুষের ইচ্ছাশক্তিতেই?
তাঁর দীর্ঘ লেখায় ভালোবাসার দিশা দেখতে পান অনুরাগীরা। ২০২১ সালে হঠাৎই জানা যায় ফুসফুসে ক্যান্সার রোগ বাসা বেঁধে বসে আছে ঐন্দ্রিলার। ক্যান্সারের সঙ্গে দ্বিতীয়বার আলাপ হয় তাঁর। ফলে লড়াই অচেনা নয়। শুরুতে চিকিৎসা করাতে চাননি কিন্তু করাতে হয়েছে। চারপাশের মানুষের আকুল ভালোবাসায় রাজি হতে হয়েছে তাঁকে। সেজেগুজে থাকা মিষ্টি হাসির ঝলমলে অভিনেত্রীর চেহারা পালটাতে থাকে। কিন্তু পালটাননি প্রেমিক সব্যসাচী। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর প্রেম। অনেকটা তাঁর কারণেই মনে জোর পেয়েছেন ঐন্দ্রিলা৷ লড়াইয়ে জিতেছেন।
দীর্ঘবছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেছেন ঐন্দ্রিলা শর্মা। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রথম এই অসুখের কথা জানতে পারেন তিনি। সেদিন তাঁর জন্মদিন ছিল। ৫ ফেব্রুয়ারি এই অসুখের কথা জানেন। সেই থেকে লড়াই শুরু। ঐন্দ্রিলার চিকিৎসা শুরু হয়। দিল্লিতে চিকিৎসা চলে তাঁর। একের পর এক কেমো চলতে থাকে। চলে ইঞ্জেকশনও। শেষে ২০১৬ সালে সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। এরপর টেলিভিশনে কাজও শুরু করেন। ২০১৭ সালে প্রথম ধারাবাহিকে কাজ করেন। ৫ বছর সবকিছুই ঠিক ছিল। ছন্দপতন হয় ২০২১-এ, ফের অসুস্থ হন ঐন্দ্রিলা। ফুসফুসে একটি টিউমার ধরা পড়ে। আবারও কেমোর পর কেমো নিতে হয় তাঁকে। এই সময়ে, একটি বড় অস্ত্রোপচারও হয় তাঁর। তবে ফিরে আসনে ঐন্দ্রিলা। সুস্থ হয়ে ওঠেন। কাজও শুরু করেন। ওয়েবসিরিজেও কাজ করার কথা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এক রাতে তাঁর শরীর আবার খারাপ হয়। আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসা চলেছে তাঁর। কোমায় ছিলেন অভিনেত্রী।
পাশেই ছিলেন সব্যসাচী
সহকর্মী থেকে অনুরাগী, সবাই তাঁর সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেছিলেন। আর সব্যসাচী? ঠিক আগের মতোই ঐন্দ্রিলার পাশেই রয়েছেন সব্যসাচী। ঐন্দ্রিলা শর্মা অসুস্থ আর সব্যসাচী চৌধুরী পাশে থাকবেন না, এরকম যেন হতে পারেই না। পাশে থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁদের পথচলা। একজন প্রকৃত বন্ধুর মতোই সব্যসাচী সব সময় আগলে রেখেছেন তাঁর প্রেমকে। অসুস্থতার সময়ে, মনখারাপের সময়ে হাত ধরেই ছিলেন ঐন্দ্রিলার। তাঁদের কিছু কিছু মুহূর্তের কথা ভাগ করে নিতেন সোশ্যাল মিডিয়ায়ও।
আরও পড়ুন-লড়ে দেখালেন ঐন্দ্রিলা, এভাবেও ফিরে আসা যায়
২০২২ সালে প্রেম দিবসের কিছুদিন আগেই সব্যসাচী তাঁর প্রাণের থেকে প্রিয় মানুষটির সম্পর্কে লিখেছেন, ‘১৪ই ফেব্রুয়ারি নাকি ভালোবাসার দিবস, আমি বড়ই কাঠখোট্টা মানুষ, এসব বিশেষ দিনে কিছুই করি না কখনও। কিন্তু ২০২১ সালে প্রথমবার তিনি বায়না করেছিলেন যে দিনটি মাসের দ্বিতীয় রবিবার, তাই দু’জনেরই ছুটি, অতএব রাতে রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে হবে। ভালো কথা, টেবিল বুক করা হল, বলল দুপুরে একটু ঘুমাচ্ছি, উঠে তৈরি হব। ঘুমাল কিন্তু আর উঠতে পারল না। পিঠের যন্ত্রণায় পরিত্রাহি চিৎকার করছে, এদিকে আমি বুঝতেই পারছি না যে কী হয়েছে.... পরের দিন জানা গেল ছয় বছর আগের সেই কালসদৃশ অসুখ আবার ফিরে এসেছে এবং ফুসফুসে এক লিটার রক্ত জমেছিল, আমরা কেউ তা বুঝিনি। এরপর থেকে, আমাদের জীবনে আর কোনও নির্দিষ্ট ভালোবাসার দিন নেই। জীবনেও তা পালন করব না।”
এই সময়ে ঐন্দ্রিলা ও সব্যসাচীর সম্পর্কের সঙ্গে আরও বেশি পরিচিত হন সবাই। এই কঠিন অসুখের সঙ্গে ঐন্দ্রিলার লড়াইয়ের জার্নির এক একটি কথাও জানাতেন সব্যসাচী। কেমোথেরাপির জন্য ঐন্দ্রিলাকে চুল কেটে ফেলতে হয়, সেই সময়ে সব্যসাচীকেও চুল কেটে ফেলতে দেখা যায়। মাথা কামিয়েছিলেন ঐন্দ্রিলার এক বান্ধবীও। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন ঐন্দ্রিলাও।
কিন্তু আবার নতুন করে বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঐন্দ্রিলা–সব্যসাচী। আর ঠিক আগের বারের মতো এইবারেও ঐন্দ্রিলার পাশে ছায়ার মতো আছেন তাঁর ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসা হয়তো এমনই হয়। কঠিন সময়ে পাশে থাকা, এটুকুই নির্যাস। বাকিটুকু সফর, প্রেমের, বন্ধুত্বের।