মোদির নিউ ইন্ডিয়া বনাম রাহুল গান্ধী, ম্যাচের ফলাফল?

এ সময় চরমপন্থী জাতীয়দাবাদের সময়। ‘দেশ’ নামক এমন এক ধারণার জন্ম হয়েছে যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কেবলমাত্র নিজেদের সম্পত্তি বলে মনে করে। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে রাহুল গান্ধীর সাম্প্রতিক বক্তব্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকেই। গত বুধবার রাহুল গান্ধী বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ এনেছেন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। এক অন্য ভরতের কথা বলেছেন তিনি। সেখানে প্রতিটি রাজ্য তার নিজের গুরুত্ব নিয়ে থাকে, নিজস্ব পরিচিতির পারস্পরিক সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে একটি জাতি গঠিত হয়। নতুন কোনও ধারণা নয়–এ ভারতের সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলিরই একটি। এমনকী সংবিধানের যে অংশটি ভারতকে ‘ইউনিয়ন অব স্টেটস’ ঘোষণা করে সেটির উল্লেখও করেন রাহুল।

বিজেপি সরকার ভারতকে দুটি ভারতে ভেঙে দিয়েছে, একটি ধনীদের, একটি গরীবের, বলছেন রাহুল। এবং সেই দু'টি ভারতের মধ্যে বেড়ে চলেছে দূরত্ব। সরকারি হিসেবের উল্লেখ করে তিনি জানান, শুধুমাত্র ২০২১-এই তিন কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বেকারের হার গত ৫০ বছরের নিরিখে সর্বোচ্চ এখন। খুচরো পুঁজি ও মধ্যম পুঁজি ধ্বংস করছে মোদি দরকার। মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি প্রজেক্ট কখনও বাস্তবে সফল হতে পারে না কারণ ২০১৪ থেকে উৎপাদন ক্ষেত্রে ৪৬% কাজ কমেছে। এই ক্ষেত্রগুলি নোটবন্দি, ভুলভাল জিএসটি ইত্যদিতে ভুগেছে। পাশাপাশি এই মহামারীর সময় এদের কোনো রকম সাহায্য করেনি মোদি সরকার। রাহুল আরও জানিয়েছেন, মোদি সরকারের আম্বানি আদানি প্রেম দেশের ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পগুলিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই একচেটিয়া মারাত্মক ক্ষতি করবে ভারতীয় অর্থনীতির। ইউনিয়ন বাজেটে কেন একবারও বেড়ে চলা বেকার সমস্যার কথা তোলা হল না, সমাধানের বিন্দুমাত্রও চেষ্টা হল না এই নিয়ে সরকারের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। “আজ দেশের শ'খানেক ধনী ব্যক্তির আয় ৫৫ কোটি ভারতীয়র মোট আয়ের থেকে বেশি। সবথেকে ধনী দশ ভারতীয়ের হাতে সমস্ত ভারতের ৪০%-এরও বেশি সম্পত্তি” —জানান রাহুল। ফলত মোদির বড় বড় ঘোষণা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া’ বা ‘নিউ ইন্ডিয়া’র ডাককে ব্যর্থ আষ্ফালন বলে মনে করছেন তিনি।

আরও পড়ুন-বাংলা গান যত দিন টিকে থাকবে ততদিন লতা থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে

এই সূত্রে কথা বলতে গিয়েই ভারতের দু'ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ তোলেন রাহুল। একটি ভারত গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্টের কাঠামো নিয়ে চলে। যেখানে প্রতিটি রাজ্যকে আগে গুরুত্ব দেওয়া দেওয়া হয়, এবং মত বিনিময় ও আলোচনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে এগোন হয়। আরেকটি একনায়কত্বের কথা বলে, রাজতন্ত্রের কথা বলে। সেখানে একটি ছড়িতে সমস্ত বিভিন্নতাকে শাসন করতে চায় শাসক, যা মোদি সরকার করছে বলে দাবি করেন তিনি। প্রথম কাঠামোটি নিজের রক্তের মধ্যে রয়েছে বলে দাবি করেন রাহুল। তাঁর প্রপিতামহ বছর পনেরো জেলে কাটিয়েছেন এই ব্যবস্থা আদায়ের জন্য, এই ব্যবস্থার রক্ষায় তাঁর ঠাকুমার বুকে বিঁধিয়ে দেওয়া হয়েছিল খান বত্রিশেক বুলেট, তাঁর বাবা হয়েছিলেন ছিন্নভিন্ন—ফলত খানিকটা হলেও এই ব্যবস্থাকে বোঝেন বলে দাবি রাহুলের। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বোঝাপড়ার কাঠামো বলেন তিনি।

বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে তামিলনাড়ু ও কেরালার নাম আনেন রাহুল। এদের ভাষা, সংস্কৃতি, মনন জগত সম্পূর্ণ নিজস্ব। কাজেই তাদের উপর কোনদিন কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। লোচনার মাধ্যমে, মত বিনিময়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণই একমাত্র ভারতীয় পথ। এ বিষয়ে ইতিহাসের ‘সাম্রাজ’ গুলির দিকে বিজেপিকে তাকাতে বলেন রাহুল। এবং খুব সুচারুভাবে যাতে  হিন্দিবলয় ও হিন্দিবলয়ের বাইরের রাজ্যের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির অভিযোগ না আসে, রাজস্থানের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তবে তাঁর ঝোঁক মূলত গোবলয়ের বাইরের রাজ্যগুলি ও আঞ্চলিক দলগুলিকে সমর্থন করার দিকেই ছিল।

এরপরে মণিপুরের প্রসঙ্গ আনেন তিনি। তাঁর বয়ান অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মণিপুরের এক বৈঠকে মণিপুরী নেতাদের নিজের বাসায় ডাকেন। সেখানে তাঁদের সবাইকে জুতো খুলে ঢুকতে বলা হয়। অথচ সভাস্থলে গিয়ে তাঁড়া দেখেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং জুতো পরে রয়েছেন। এতে মণিপুরের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত অপমানিত হয়েছেন বলে দাবি করেন রাহুল। এই বৈষোম্যমূলক আচরণও একনায়কতন্ত্রেরন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করছেন তিনি। 

আরও পড়ুন-আজও সুরের মসনদের রানি লতা মঙ্গেশকর

এছাড়াও বিদেশনীতির কড়া সমালোচনা করেন রাহুল। পাকিস্তান এবং চিনকে পরস্পর মৈত্রীশক্তিতে পরিণত করা ভারত সরকারেরই ভূল বিদেশনীতি—এমনটাই দাবি তাঁর। “আমার মতে আর এস এস এবং বিজেপি আমাদের দেশের ভিত দুর্বল করছে। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করছে। ভাষায় ভাষায় যোগাযোগ ছিন্ন করছে...দেশের গভীর বিপদ এখন। বাইরে ভিতরে শত্রু দেশের,” বলছেন রাহুল। তাঁর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২৭ কোটি মানুষকে ইউপিএ সরকার দারিদ্রতা থেকে উদ্ধার করেছিল, সেখানে মোদি সরকার ২৩ কোটি মানুষকে ফের সেই গণ্ডীতে ঠেলে দিয়েছে। রাহুল আরো জানান, “আমাকে অপমান করুন, কিন্তু দেশের মানুষকে অপমান করার অধিকার আপনাদের কেউ দেয়নি।” রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাহুলের এই ভোকাল টনিক ইউপি ভোটকে মাথায় রেখেই। তাছাড়া বহু অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত কংগ্রেসকেও একসূত্রে গাঁথতে চাইছেন তিনি, সেই কারণেই এই মঞ্চবাছাই। 

যদিও কংগ্রেসের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্মান করার দাবিকে মেনে নিতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। নেহেরুর চিন্তাকেও কেন্দ্রীয় ঝোঁক বলেই বর্ণনা করেছেন তাঁরা। শুধু তাই নয় ইন্দিরা গান্ধীর বিভিন্ন রাজ্যকে অবজ্ঞা ও এমার্জেন্সির ঘোষণার সময়কালকেও ভোলেনি মানুষ। যদিও এই সময়ে দাঁড়িয়ে, সর্বগ্রাসী একনায়কত্বের উদযাপনের বিরুদ্ধে, এক ভাষার দ্বারা সমস্ত আঞ্চলিক ভাষা গুলির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আলোচনার পরিসরকে অত্যন্ত গুরুত্ব বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

More Articles