ভক্তদের 'রামসেতু' আদৌ কি ছিল? কী রহস্য লুকিয়ে এই 'ভাসমান পাথরে'!

Truth of Ramsetu: রামভক্তদের বিশ্বাসে আঘাত লাগলেও ইহাই সত্য যে, এই পাথর বা শিলাখণ্ডগুলি ভাসমান নয়। কোনওদিন ছিলও না।

খুব সম্প্রতি ভারতব্যাপী বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে অভিষেক শর্মা পরিচালিত সিনেমা ‘রাম সেতু’। গল্পও ইতিমধ্যেই অনেকের জানা। তাও একটু সংক্ষেপে বলা যাক। সিনেমায় দেখা যায়, রামসেতুকে ‘শত্রুরা’ নিঃশেষ করার আগেই এক নাস্তিক প্রত্নতত্ত্ববিদ (অক্ষয় কুমার) রামসেতুর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে কোমর বেঁধে লড়েন। খুব বেশি না, যদি বছর পনেরো আগেও ফিরে যাই, ভূগোলের আস্তিক মাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “বল তো, এই যে রামসেতু, সেটা কি রামের বানানো?” ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, ‘না’। মাস্টারমশাই প্রসন্নচিত্তে বলেছিলেন, ‘গুড’! তখনও রামসেতু রামের হাতে তৈরি বললে স্রেফ লোক হাসানো হতো। এখন অবশ্য দেশবিরোধী তকমা, মৃত্যুর হুমকি, ভিসা বাতিলের ভয় কিংবা বাড়ির মা-বোন তুলে অশ্রাব্য গালিগালাজের আশঙ্কা মাথায় রেখেই বিজ্ঞান বা সত্য সম্পর্কে মুখ খুলতে হয়।

পাথর নির্মিত এই সেতুটির ভৌগোলিক উৎপত্তিকে নস্যাৎ করে, বর্তমানে সেই অবস্থান কেবল ধর্মীয়ই নয়, রাজনৈতিকও বটে। ভূগোল বলছে, রামসেতু আদতে তৈরি লাইমস্টোন বা চুনাপাথর থেকে এবং এর গড়ে ওঠা আদ্যোপান্ত প্রাকৃতিক। রামসেতু বা অ্যাডামস ব্রিজ ভারতের একদম দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রামেশ্বরম দ্বীপ (বা পম্বন দ্বীপ) এবং শ্রীলঙ্কার একদম উত্তর-পশ্চিমের মান্নার দ্বীপের মাঝে অবস্থিত। এই দুই দ্বীপের মধ্যবর্তী পক প্রণালীর যে অংশ দিয়ে খণ্ড খণ্ড শিলাভূমি বিস্তৃত রয়েছে, সেই অংশের গভীরতা অত্যন্ত কম। এমনকী কোথাও কোথাও সেই গভীরতা এক থেকে দশ মিটার মাত্র। তাই সহজেই চোখে পড়ে পাথরের উপরিতল এবং সে জন্যেই এদের ভাসমান পাথর বলা হয়। রামভক্তদের বিশ্বাসে আঘাত লাগলেও ইহাই সত্য যে, এই পাথর বা শিলাখণ্ডগুলি ভাসমান নয়। কোনওদিন ছিলও না।

আরও পড়ুন- ব্রাজিলের গদি উল্টোনো কতটা বাঁচাবে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনকে

ভারতে যে কয়টি কোরাল রিফ বা প্রবালপ্রাচীর রয়েছে, তার মধ্যে একটি বিস্তৃত রয়েছে পম্বন দ্বীপ বা রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা অবধি। যার মধ্যে পড়ছে মান্নার উপসাগর। এই তথাকথিত ‘ভাসমান পাথরের’ গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ প্রবাল দিয়ে তৈরি। আপাত দৃষ্টিতে শক্ত, কঠিন, পাথরের মতো দেখতে প্রবালে ছোটো ছোটো ছিদ্রও চোখে পড়ে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই ছিদ্রগুলি দেখে ভাববার কারণ নেই এরা যে জলে ভাসে বা ভাসতে পারে।

সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রবাল। প্রবাল নিজে বংশ বিস্তার করে, গুল্মশাখার মতো ব্যপ্ত হয়ে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর মাথা গোঁজার জায়গা গড়ে তোলে। মান্নার উপসাগরকে বলা যেতে পারে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বর্গ। প্রায় চার হাজার সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের বাস মান্নার উপসাগর এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলে। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে ১১৭ টি কোরালের প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে ২০২১ সালে। যার অন্তর্ভুক্ত রামসেতুও।

তবে দুঃসংবাদ এখানেই, এই প্রবালপ্রাচীর বা ভক্তদের রামসেতু কিন্তু ধ্বংস হচ্ছে দূষণের কারণে এবং সেই দূষণের নেপথ্যে, আর কেউ না, দায়ী কিন্তু আমি, আপনিই। প্রবাল প্রাচীর ধ্বংসের মূল কারণ সমুদ্রের সামগ্রিক তাপমাত্রার লাগামছাড়া বৃদ্ধি, সমুদ্রের জলে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অবশ্যই প্লাস্টিক দূষণ।

প্রথম দু’টি বিষয়ের জন্য ব্যপক হারে কোরাল ব্লিচিং শুরু হয়। কোরাল ব্লিচিং কী, খানিকটা বলা যাক সেই কথা। কোরাল বা প্রবাল সমুদ্রের কিছু কিছু অ্যালগির সঙ্গে মিথোজীবী বা সিম্বায়োটিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এই সম্পর্কে থাকাকালীন একে অপরের কিছু শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন পূরণ করে। এখানে অ্যালগি মূলত প্রবালের বাইরে আস্তরণ গঠন করে প্রবালকে তাপ, আলো, রাসায়নিক এবং সমুদ্রের জলের আঘাত থেকে রক্ষা করে। কোরাল ব্লিচিং হল এমন একটি অবস্থা, যখন কোরালের গা থেকে অ্যালগির আস্তরণ খসে গিয়ে, কোরাল ফ্যাকাসে বা ব্লিচড হতে শুরু করে। কোরাল ব্লিচিং শুরু হলেই যে কোরাল নষ্ট হয়ে যাবে তা কিন্তু না। তবে যদি দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলতে থাকে, অর্থাৎ এই প্রবালের প্রাচীর যদি দিনের পর দিন তাপ এবং জলে অ্যাসিডের প্রকোপ সহ্য করতে থাকে, তাহলে কিন্তু প্রবালগুলি একসময় মারা যাবে।

পম্বন দ্বীপ এমনিতেই সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার উপর ১৯১৪ সালে পম্বন এবং মণ্ডপম এই দু’টি স্থানের মাঝে পম্বন সেতু গড়ে তোলায় ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পম্বন দ্বীপের যোগাযোগ আরও ভালো হয়েছে। রেললাইনের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে জাতীয় সড়ক। ফলে পর্যটক এবং তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা বেড়েছে। বিগত কয়েক বছরে পম্বন দ্বীপের ধনুশকোঠী থেকে আরিচল মুনাই অর্থাৎ ভারতের একদম শেষ প্রান্ত অবধি গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় সড়ক- যাকে বলে ‘দ্য লাস্ট রোড অব ইন্ডিয়া’। এর ফলে সারা বছর পর্যটক সমাগম লেগেই থাকে। আর তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং সমুদ্র দূষণ।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর ফাইলসের পর রামসেতু! বিনোদনই তবে বিজেপির ব্রেনওয়াশের মূল অস্ত্র!

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে কেবল যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়ছে, তা নয়। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জলভাগের তাপমাত্রা। তার ধকলও সইতে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত প্রবাল প্রাচীরকে। বাদ যাচ্ছে না তথাকথিত রামসেতু সহ মান্নার উপসাগরের প্রবালপ্রাচীর। এর পাশাপাশি পর্যটক বা মৎসজীবীদের নৌকা অনেক সময় এই কোরালগুলির গায়ে আঘাত খায় কিংবা নোঙর ফেলার সময় ক্ষত সৃষ্টি করে প্রবালের গায়ে। অবাধে মাছ ধরা কিংবা চোরাশিকারিদের কচ্ছপ শিকারের ঘটনাও নতুন নয়। যেহেতু বাস্তুতন্ত্রের একটি জীব ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার অল্প-বিস্তর কুপ্রভাব সেই বাস্তুতন্ত্রের সমস্ত জীবকূলকেই সইতে হয়, তাই মাছ বা কচ্ছপের মতো বিপন্ন প্রাণীদের ধরলে প্রবালও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৈকি!

রাম ও রামসেতুর প্রতি ভয় ও ভক্তি অটুট রাখার ভাবনা চিন্তা তো অনেক হল। জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীবজগতের ধ্বংস নিয়ে ভয় এবং সচেতনতা কবে জন্মাবে, সব শেষে সেই প্রশ্ন রয়েই যায়।

More Articles