ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া দেশ আজ উন্নতির চূড়ায়! কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল দক্ষিণ কোরিয়া

South Korea: দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন, দেশের স্বার্থকে সব সময় এগিয়ে রেখেছেন।

স্যামসাং, এলজি, কে-পপ, গ্যাংনাম স্টাইল, কিমচি কিংবা কে ড্রামা- দক্ষিণ কোরিয়া এখন শুধুমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয় সমগ্র বিশ্বের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই এখন এই নামগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে। Samsung এবং LG এই দু'টি বিশ্ববিখ্যাত প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। Hyundai কোম্পানির গাড়ি জগতবিখ্যাত। অন্যদিকে, ২০১২ সালের জুলাই মাসে ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি গান যা পরবর্তীতে মাতিয়ে রেখেছিল গোটা বিশ্বকে, গানটির নাম ছিল গ্যাংনাম স্টাইল। ডিসেনডেন্টস অফ দ‍্য সান, ভিন্সেঞ্জো, কিংবা বিশ্ববিখ্যাত স্কুইড গেমস, সবকিছুর উৎসস্থলই এই দক্ষিণ কোরিয়া। আজকালকার তরুণীদের প্রথম পছন্দ BTS-এর শিকড়ও সেই দক্ষিণ কোরিয়াতেই। আধুনিকতার এই যুগে প্রযুক্তি যেখানে পুরো দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে, সেখানেই সাংস্কৃতিক বিকাশের গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। তথ্য এবং যোগাযোগ থেকে শুরু করে সমস্ত দিকেই এখন দক্ষিণ কোরিয়ার জয়জয়কার। এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশকে টেক্কা দিতে পারে না। আকারে-আয়তনে ভারতের তুলনায় অনেকটাই ছোট হলেও, দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের সবথেকে উন্নতশীল দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে একটি।

তথ্য এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সময়ে পৃথিবীর সবথেকে ভালো প্রযুক্তি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলি গবেষণার পিছনে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে থাকে প্রতিবছর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতাসম্পন্ন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এই দেশটির আধুনিক শহরগুলোর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত উন্নত। এই মুহূর্তে এশিয়ার চারটি দেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য হয়ে উঠেছে রোল মডেল। হংকং, তাইওয়ান এবং সিঙ্গাপুরের পাশাপাশি এই তালিকায় চতুর্থ দেশ হয়ে উঠেছে 'এশিয়ান টাইগার' দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু আজ থেকে ৭০ বছর আগেও এই চিত্র ছিল একেবারেই আলাদা। অনেক চড়াই-উতরাই প্রেরণের পর আজকের দক্ষিণ কোরিয়া একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে। একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষেরা দু'বেলা ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত পারতেন না। দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিল না ভালো বিদ্যুৎ পরিষেবা। সেখানেই আজ দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে ৩০ হাজার ডলারেরও বেশি। কীভাবে এই ব্যাপক উন্নতি করল দক্ষিণ কোরিয়া? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

ইতিহাসের দিকে একটু পিছনে ফিরে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ান উপদ্বীপ ছিল সাম্রাজ্যবাদী জাপানের একটি বিশাল বড় উপনিবেশ। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান জড়িয়ে পড়লে মিত্রপক্ষর পরাশক্তি দেশ আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের ওপর হামলা চালায়। পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয় এশিয়ার এই দেশটির ওপর। যুদ্ধ শেষ হলে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দু'টি দেশই নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল কোরিয়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা গোলটেবিল বৈঠকে বসে দীর্ঘ আলোচনার পর ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ান উপদ্বীপকে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। উত্তর কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠা হয় কমিউনিজম এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠা হয় পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্র। আগে যদিও দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া একটই দেশ ছিল। যখন দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীনতা পায়নি তখন, কোরিয়ার দক্ষিণ অংশটি ছিল একেবারেই দরিদ্র। উত্তর কোরিয়াতেই ছিল সমস্ত বড় বড় কোম্পানিগুলি। প্রথম থেকেই কোরিয়ার এই দু'টি অংশের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। সব সময় এক দেশ তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক আচরণ পোষণ করত। দুই দেশের মানুষ পরস্পরকে ঘৃণা করত।

আরও পড়ুন: জমি কেড়ে নেওয়া, পরের পর যুদ্ধ! পৃথিবী শাসন করা আমেরিকার ইতিহাস তাক লাগাবে

ফলে কোরিয়ার এই দু'টি অংশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এর পাশাপাশি বাইরের দেশগুলোর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের কারণে, কোরিয়ার আর্থিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে। একসময় ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়া তার প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণ করে বসলে যুদ্ধ পূর্ণমাত্রায় শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পৃথিবী যে স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করেছিল, সেই যুদ্ধের প্রধান প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ফলে কোরিয়ান উপদ্বীপের এই যুদ্ধ একটা নতুন মাত্রা নেয়। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এশিয়ার আরেক শক্তিশালী দেশ চিন। যেহেতু উত্তর কোরিয়ায় কমিউনিজম রয়েছে, তাই চিনের সাহায্য করাটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জাতিসংঘ এবং আমেরিকা।

তিন বছরের ব্যাপক যুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে যুদ্ধ শেষ হলে দু'টি দেশ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। কোনও দেশই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনি এবং সেই কারণে দু'টি দেশের প্রধান শহরগুলো কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়। শিল্প-কারখানাগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ স্রেফ উধাও হয়ে যায় দক্ষিণ কোরিয়া এবং উত্তর কোরিয়া থেকে। কিন্তু সেখান থেকে শুরু হলো দক্ষিণ কোরিয়ার লড়াই। উত্তর কোরিয়ার আধিপত্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের নতুন দেশ তৈরি করল দক্ষিণ কোরিয়া। সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিল প্রবল দারিদ্র। কিন্তু সেখানকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন অন্য মানসিকতার। মাত্র তিন দশকের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার হাল পুরো পরিবর্তন করে দিলেন তিনি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পর মাত্র তিন দশকের মাথায় শক্ত অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেল দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের সর্বৈব উপস্থিতি ঘোষণা করল এশিয়ার এই দেশটি। আর এই বিষয়টিকেই বিশেষজ্ঞের আখ্যায়িত করেছেন, 'মিরাকেল অফ দি হান রিভার' নামে।

তবে দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক উন্নতির ব্যাপারে আলোচনা করতে হলে সবার আগে কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করাটা প্রয়োজন। নতুবা দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আজকের দিনে স্যামসাংয়ের স্মার্ট ফোন কিংবা ল্যাপটপ সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে, এলজি কোম্পানির তৈরি উচ্চমানের রেফ্রিজারেটর এবং টেলিভিশন অসংখ্য মানুষের বাড়ি কিংবা দোকানে ব্যবহৃত হয়, হুয়ান্ডাই কোম্পানির গাড়ির কদর রয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিন্তু সবথেকে মজার ব্যাপার, প্রথমদিকে কিন্তু এই সমস্ত কোম্পানি এরকম জিনিস তৈরি করতই না। বরং, এই সমস্ত কোম্পানিগুলি কিন্তু আগে জাহাজ তৈরি করত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণকে কেন্দ্র করে এই সমস্ত কোম্পানির ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। একটা সময়ে স্যামসাং চিনি এবং উল উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এছাড়াও ছিল স্যামসাংয়ের জাহাজ তৈরির কারখানা। এলজি তৈরি করত বিভিন্ন প্লাস্টিক-জাতীয় পণ্য। অন্যদিকে, জাহাজ ছাড়াও চাল উৎপাদনের কাজ করত হুয়ান্ডাই। বহুজাতিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে জাতীয় গণ্ডিতে নিজেদেরকে আটকে রেখেছিল।

কিন্তু কোরিয়ান উপদ্বীপের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়া-র ক্ষমতা চলে যায় দক্ষিণ কোরিয়া-র সামরিক শাসক পার্ক চুং হি-র হাতে। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই দেশের অর্থনৈতিক উত্থানের পিছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তিনি যখন ক্ষমতা হাতে পেয়েছিলেন, তখন দক্ষিণ কোরিয়া রীতিমতো ধুঁকছিল। কোরিয়ার সমস্ত ব্যবসা কেন্দ্রীভূত ছিল উত্তর কোরিয়ায়, ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় তেমন কোনও ব্যবসা ছিলই না বলা যেতে পারে। দারিদ্রের কষাঘাতে দেশটির নাগরিকদের জীবন ছিল একেবারে বিপর্যস্ত। অধিকাংশ দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক দিনে একবেলা খাবার জোটাতে হিমশিম খেয়ে যেত। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ১৪০ মার্কিন ডলার, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল বছরে মাত্র ৯৪ ডলার। একদম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়া। সেই অবস্থায় দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন পার্ক চুং হি।

একদিকে প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার চোখরাঙানি এবং অপরদিকে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পার্ক বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যতীত কোনও কিছু সমাধান করা যাবে না। ‌সেজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁর দেশের সমস্ত বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সমস্তরকম সুবিধা তিনি দেবেন। তাদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা লাঘব করে দিলেন তিনি এবং পরিবহণ সুবিধা বাড়ানোর জন্য তৈরি করলেন ভালো রাস্তা। সেই সমস্ত কোম্পানিগুলির সঙ্গে তিনি নিজে গিয়ে কথা বললেন এবং তাদের অনুরোধ করলেন, যেন তারা তাদের উৎপাদন চালু রাখে তবে, দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের কাজ দেয়। এছাড়াও বাইরের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাজার দখল করে নিয়ে দেশের স্থানীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেন সমস্যা না তৈরি করে তার জন্য তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন কোনও পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি কখনওই। তার নেওয়া পদক্ষেপগুলোর জন্যই দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় অর্থনীতি, স্থানীয় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, সবকিছুর উন্নতি হয় দ্রুতগতিতে। ধীরে ধীরে দক্ষিণ কোরিয়ায় বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে।

১৯৭০ সালের আগে পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলি বাইরের দেশে ব্যবসার দিকে খুব বেশি নজর দেয়নি। কারণ গতানুগতিক কাপড়, জুতো ইত্যাদি রফতানির পিছনে সমস্ত পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল এই প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকার কারণে এবং পশ্চিমি দেশগুলি এই মার্কেটে ভালোভাবে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নেওয়ার কারণে সেই মতো সফলতা পায়নি সেই সংস্থাগুলি। Samsung এবং Hyundai এর মতো কোম্পানির কাছে জাহাজ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ইউনিট থাকলেও, সমস্ত কোম্পানির কাছে কিন্তু এই সুবিধা ছিল না। তাই এবার অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়ার নামজাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। সাতের দশকের প্রথম দিকে স্যামসাং নিয়ে আসে টেলিভিশন, রেডিও এবং ওয়াশিং মেশিনের মতো কিছু প্রোডাক্ট। ১৯৭৫ সালে Hyundai কোম্পানি তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গাড়ি নির্মাণ করে। প্রাথমিকভাবে রফতানির পর দেখা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে এই পণ্যগুলির বিশাল চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে পুরনো ব্যবসা পাল্টে এবার ইলেকট্রনিক্স পণ্যের দিকে বেশি বিনিয়োগ করতে শুরু করে এই সমস্ত কোম্পানিগুলি।

তবে ইলেকট্রনিক দ্রব্য তৈরি করতে গেলে সবার আগে যে জিনিসটির প্রয়োজন, সেটি হলো সেমিকন্ডাক্টর। এই মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়া সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে বিশ্বের সবথেকে বড় দেশগুলির মধ্যে একটি। তবে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই খেতাব ছিল শুধুমাত্র জাপানের কাছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলি প্রাথমিকভাবে জাপান এবং আমেরিকার সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এই ধরনের সেমিকন্ডাক্টর আমদানি করতো। কিন্তু এর কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছিল, যা দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একেবারেই ভালো ব্যাপার ছিল না। তাই, ১৯৮০ সালে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল দক্ষিণ কোরিয়ার বড় কোম্পানিগুলি।

Samsung এবং অন্যান্য প্রযুক্তি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলি শুরু করল সেমিকন্ডাক্টর তৈরির শিল্প। এর অংশ হিসেবে তারা জাপানি সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান Sharp এবং মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান Micron এর দ্বারস্থ হলো। তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি শিখে স্যামসাং ঠিক ছয় মাস পর তাদের নিজস্ব গবেষকদের মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর এর সাহায্যে ৬৪ কিলোবাইটের র‌্যাম চিপ তৈরি করল। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে এটি ছিল একটা যুগান্তকারী ঘটনা। এরফলে দেশটির রপ্তানি বাণিজ্য নতুন মাত্রা লাভ করতে শুরু করল। পৃথিবীর ইতিহাসের তৃতীয় দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া সেমিকন্ডাক্টর তৈরির কৃতিত্ব অর্জন করল।

তবে দক্ষিণ কোরিয়ার এই অর্থনৈতিক বিপ্লবের মূল কান্ডারী ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার শাসক পার্ক চুং হি। তার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল জাপানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। ১৯৬৫ সালে জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি নতুন চুক্তি করল এবং চুক্তির ফলে এই দেশটি জাপানের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে ৩০০ মিলিয়ন ডলার লাভ করল। এছাড়াও ঋণ হিসেবে জাপান দক্ষিণ কোরিয়াকে আরো ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করল। এই বিশাল অর্থ সরাসরি ব্যয় করা হলো দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে সামরিক সহায়তা, অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের বেতন এবং অর্থনৈতিক সহায়তার অংশ হিসেবে আমেরিকার কাছ থেকে দক্ষিণ কোরিয়া ৫ বিলিয়ন ডলার লাভ করলো। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ যুদ্ধরত দক্ষিণ কোরিয়া সেনারা দেশে প্রেরণ করেছিল, যা এই দেশের আয় বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুগুণ। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ভিয়েতনামের রণক্ষেত্রে যুদ্ধরত দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাদের প্রেরিত অর্থের দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জাতীয় আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ গুন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেরিত সৈন্যদের পাঠানো অর্থ থেকে শুধু যে দক্ষিণ কোরিয়া লাভবান হচ্ছিল, তা কিন্তু নয়, জনশক্তি রফতানির দিকেও কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার শাসক নজর দিয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে পূর্ব জার্মানির সাথে পার্ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তিতে জনশক্তি রপ্তানি বিষয়ে একটি বিধান রাখা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে অসংখ্য নারী এবং পুরুষ পূর্ব জার্মানিতে গিয়েছিলেন সেই সময়। নারীরা গিয়েছিলেন মূলত নার্স হিসেবে এবং পুরুষরা গিয়েছিলেন খনি শ্রমিক হিসেবে।

১৯৭০-এর দিক থেকেই দক্ষিণ কোরিয়াতে শুরু হয়েছিল শিল্পবিপ্লব। দক্ষিণ কোরিয়া ধীরে ধীরে ধনী হতে শুরু করেছিল এবং সেই কারণে নিজেদের দেশকে সাজানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছিল দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। এর মধ্যে একটি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় বাড়ি নির্মাণ। সরকার দেশের অত্যন্ত এলাকায় বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করার জন্য নিজেরা সিমেন্ট বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার কারণে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে উঠেছিল এশিয়ার সবথেকে বড় বড় কয়েকটি ইমারতের দেশ। এর মধ্যে বেশ কিছু ইমারত এমন ছিল যারা বিশ্বের নামি দামি অট্টালিকাকেও টেক্কা দিতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ইমারত তৈরি দেখে রীতিমত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলি। তারাও নিজেদের দেশে এরকম বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, এই সুযোগ লুফে নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। এই দেশটির রিয়াল এস্টেট কোম্পানিগুলি মধ্যপ্রাচ্যে বিনিয়োগ করতে শুরু করে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করার কাজ শুরু করে দেয়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভিজাত সমাজে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি-নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলির পণ্যের একটা বিশাল চাহিদা শুরু হয়, যা দক্ষিণ কোরিয়াকে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাতেও একটা নতুন জন্ম দেয়।

তবে দক্ষিণ কোরিয়া মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ কিন্তু প্রবল। ছোট থেকেই তাদের শেখানো হয়- ব্যক্তিগত ইচ্ছা নয়, বরং দেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে সব সময়। দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মলগ্ন থেকেই দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত জাতীয় সংগীত গাওয়া এবং জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য শপথ পাঠ করানো হয়। ১৯৮৭ সালে দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবার পরে এগুলিকে ঐচ্ছিক করে দেওয়া হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণেরা নিয়মিত একত্রিত হয়ে জাতীয় সংগীত গান। ১৯৯০ সালে যখন এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলির অর্থনীতিতে সংকট দেখা যায়, তখন ঋণের বেড়াজাল থেকে দেশকে বাঁচাতে দক্ষিণ কোরিয়ার অসংখ্য নাগরিক তাদের কাছে থাকা সোনা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকাংশ মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করেন না। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ এমন রয়েছেন যারা একেবারেই নাস্তিক, কিন্তু তাদের জাতীয়তাবাদ এবং জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা প্রবল।

এই দেশের মানুষের মধ্যে একতা এতটাই বেশি যে এই দেশের কর্পোরেট জগতেও সব সময় বোঝানো হয় ব্যক্তিগত সাফল্যের থেকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আজকের উন্নত দক্ষিণ কোরিয়ার পিছনে দেশটির জনগণের এই মনোভাব সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্ক চুং হি-কে অনেকেই 'দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিতা' বলে সম্বোধন করেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যতই কর্তৃত্ববাদী এবং কড়া শাসক হোন না কেন, তার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া যেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে সেজন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তার সব তিনি করেছেন। আজ সারা বিশ্বের মানুষ যখন ফাইভ-জি ইন্টারনেট নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে, সেই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ ফাইভ-জি ছেড়ে সিক্স-জি এর দিকে নজর দিতে শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া আজকে যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য সকলের মিলিত প্রয়াস ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশ মাত্র তিন বছরের পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল সেই দেশকে দুই দশকের মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে শক্ত অবস্থানে এনে দেওয়া মোটেও সহজ কাজ ছিল না। দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকরা একেবারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন, দেশের স্বার্থকে সব সময় এগিয়ে রেখেছেন। নিজের দেশকে গরিব দেশ বলে 'ব্রেন ড্রেন'-এ পা বাড়ানো নয়, বরং দেশের স্বার্থকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, দেশকে কীভাবে এগিয়ে রাখা যায়, সেদিকেই তাঁরা লক্ষ্য রেখেছেন সব সময়। আর ঠিক সেই কারণেই একদিন 'এদেশের কিছু হবে না' বলা মার্কিনিরাও আজ স্যালুট জানায় দক্ষিণ কোরিয়ার এই দৃঢ়তাকে।

More Articles