কর্নাটক থেকে ইরান, হিজাব বিতর্কই মেলালো দুই দেশের মুসলিম নারীদের?

Hijab controversy Iran: এই বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইরানে প্রচলিত কিছু  রীতি রেওয়াজ, যা বছরের পর বছর ধরে দমিয়ে রেখেছিল সে দেশের নারীদের। ইরানে জনপরিসরে নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরাসহ রয়েছে কঠোর পর্দাবিধি।

সাত মাস পরে আবারও ফিরেছে হিজাবকেন্দ্রিক গণআন্দোলন। তবে এবারের ঘটনাস্থল কিন্তু ভারত নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশ ইরান। সেই দেশের তেহারাম প্রদেশের কাছে সংঘটিত হয়েছে এমন এক বিক্ষোভ, যা এক সূত্রে গেঁথেছে কর্নাটককেও। ইরানের পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ২২ বছর বয়সে কুর্দিশ নারী মাহাসা আমিনীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের বেশকিছু শহরে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। অষ্টম দিন হয়ে গেলেও এখনো বিক্ষোভের আঁচ রয়েছে একই রকম গনগনে। ইরানের বেশ কিছু শহরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়েছেন। আগুনে হিজাব পুড়িয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সেদেশের নিপীড়িত মহিলারা।

সংবাদ সংস্থার রয়টার্স জানাচ্ছে, এখনো পর্যন্ত এই সমস্ত সংঘর্ষে ৩০ জনের কাছাকাছি মানুষ হত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে কিছু নাবালিকাও। অন্য সূত্র মারফত যদিও এই সংখ্যাটা ৫০ এর উপর পৌঁছে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। ইরানের সংবাদমাধ্যম এবং স্থানীয় আইনজীবীরা জানিয়েছেন গত দুই দিনের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে এবং এর অংশ হিসাবে ইরানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়েছে।

শুরুতে ইরানের কুর্দি-জনবহুল উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে এই বিক্ষোভ কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরে খুব দ্রুত দেশব্যাপী এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ইরানের অন্তত ৫০টি শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এরকম ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল ইরানে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, এরপর আর এত বড় বিক্ষোভ ঘটেনি দেশটিতে। চলমান বিক্ষোভটি ২০১৯ সালের বিক্ষোভের তুলনায় আরো বেশি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই। দেশটির মানবাধিকার সংগঠন হেঙ্গাওয়ের তথ্য অনুযায়ী ইতিমধ্যেই ৪০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ৭০% মানুষকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাই। ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তারা বলছেন, বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র ভিন্নমতাবলম্বীদের গুলিতে মারা যেতে পারেন।

কিন্তু কেন এহেন বিক্ষোভে নামলেন ইরানের নারীরা? আদতে এই বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইরানে প্রচলিত কিছু  রীতি রেওয়াজ, যা বছরের পর বছর ধরে দমিয়ে রেখেছিল সে দেশের নারীদের। ইরানে জনপরিসরে নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরাসহ রয়েছে কঠোর পর্দাবিধি। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামিনি সে দেশের সর্বময় কর্তা হওয়ার পরে ইরানের নারীদের উপরে এরকম কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। প্রায় ৪৫ বছর কেটে গেলেও সে দেশের নারীদের অবস্থা এখনো ঠিক একই রকম। আর এই বিধি কার্যকর হচ্ছে কিনা তা তদারক করার জন্য দেশটিতে রয়েছে একটি 'নৈতিকতাবিষয়ক' পুলিশ।

এই বিধির আওতায় ইরানের এই নীতি পুলিশের একটি দল গত সপ্তাহের মঙ্গলবার মাহাসা আমিনী নামের এক তরুণীকে তেহেরান থেকে আটক করে। আমিনি তার পরিবারের সঙ্গে তেহরান সফরে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে সে দেশের সংবাদ মাধ্যম। আটক হওয়ার পর তিনি থানায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তেহরানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে শুক্রবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। ইরান পুলিশ দাবি করে, আমিনি সেই সময়ে অসুস্থ ছিলেন এবং সেই কারণ এই তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই এতটা সহজ? ইরানের নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে ফিফটিন হান্ড্রেড তাভসির চ্যানেল। সেই চ্যানেলের সূত্র মারফত, পুলিশে হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে আমিনী মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এবং সেই আঘাতের কারণেই মৃত্যু হয়েছে তার। এই খবর সামনে আসা মাত্রই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পর্দা প্রথার প্রতিবাদ করে রাস্তায় নামেন লক্ষ লক্ষ ইরানি নারী। প্রশ্ন তোলেন, তাদেরকে কেনো সবসময় হিজাব পরতে হবে? শুধুমাত্র মাথায় থাকা হিজাব একটু সরে যাওয়ার কারণেই কি কাউকে এভাবে নীতিপুলিশির আওতায় ফেলা যায়? তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায়?

বিক্ষোভের ঝড়

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু ছবিতে দেখা গেছে, যে হাসপাতালে আমি নিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার সামনে জমেছে ভিড়। পুলিশ তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। এমনকি সরকারের নির্দেশে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলিও চালানো হয়েছে বিক্ষোভকারীদের উপর। তেহরানে লোকজনকে সরকার বিরোধী স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা গিয়েছে। আমিনীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন মহিলারা। হিজাব পুড়িয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন ইরানের লক্ষাধিক মহিলা।

আরও পড়ুন-হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত

একটি প্রতিবেদনে আননেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানাচ্ছে, নিরাপত্তা হেফাজতে ২২ বছর বয়সী তরুণী মাহসা আমিনির সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনায় নির্যাতন এবং অন্যায় আচরণের যে সমস্ত অভিযোগ উঠেছে অবশ্যই তার তদন্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইরান বিষয়ক দূত রবার্ট ম্যালি একই টুইটার পোস্ট করে জানিয়েছেন, এই মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহীর আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে আমিনির মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইরানের আইনজীবী সাইদ দেহগান। তিনি বলেছেন, আমি নেই মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন এবং তার মাথার খুলির মূল অংশ ফেটে গিয়েছিল।

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে দেখা গিয়েছে, একটি বিশাল হলরুমের ভেতর অনেক নারীর সঙ্গে আছেন আমিনী। পোশাকের ব্যাপারে নির্দেশনা দানকারী এক নারীর সঙ্গে তিনি তর্কে জড়িয়ে পড়েছেন এবং একপর্যায়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছেন তিনি। এই সমস্ত ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাপে পড়ে ইরান প্রশাসন। অনুপযুক্ত পোশাক পরার অভিযোগে নৈতিকতা পুলিশের এরকম যে আচরণ, তাকে খন্ডন করার চেষ্টা করে ইরান সরকার। মার্কিন অর্থ দপ্তরের সূত্রের খবর, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনের ক্ষেত্রে নিয়মিত সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারা ইরানের সুশীল সমাজের সদস্য এবং রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী, নারীর অধিকার কর্মী এবং বাহাই সম্প্রদায়ের লোকজনের উপরে সহিংস দমনপীড়ন চালিয়ে এসেছে বহু বছর ধরে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও এই ঘটনার কড়া নিন্দা করা হচ্ছে। একটি বিবৃতিতে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলছেন, 'মাহসা আমিনি একজন সাহসী নারী ছিলেন। নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে তার মৃত্যু নিজ দেশে জনগণের বিরুদ্ধে ইরান সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর আরেকটি বর্বরতার কাজ।' তিনি আরো বলছেন, 'আমরা এই অবিবেচনা প্রসূত আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই। নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং তাদের উপরে চলমান বন্ধে ইরান সরকারের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।' অন্যদিকে তেহেরান পুলিশ প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেন রাহিমী গত সোমবার বলেছিলেন, আঁটোসাঁটো পায়জামা পরা এবং হিজাব ঠিক মতো না পরার কারণে মাহাসাকে আটক করা হয়েছিল। তবে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করার অভিযোগটি একেবারেই মিথ্যা। ইরানের কয়েকটি শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় পুরো এলাকায়।

তবে হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিন্তু ইরানে এই প্রথম নয়। ২০০৫ সালেও যখন ইরানে এই নীতি পুলিশি চালু করা হয়, সেই সময়ও এই একইভাবে হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল ইরানে। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিক্ষোভ থেকে শুরু করে রাস্তায় নেমে আন্দোলন, ইরানীয় মহিলাদের প্রতিবাদ ক্রমেই ঝাঁঝালো থেকে ঝাঁঝালোতর হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা এবং তাদেরকে জেলে বন্দি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে ইরান সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু কোন কিছুতেই তারা যেন দমতে চাইছেন না।

কিন্তু এই বিক্ষোভকে কর্ণাটকের হিজাব বিক্ষোভের সঙ্গে তুলনা করা কি সত্যিই শ্রেয়? ডানপন্থী মতবাদীরা যেভাবে কর্ণাটকের বিক্ষোভের সঙ্গে ইরানীয় বিক্ষোভ এক সূত্রে বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন, সেটা কি সত্যিই রূপ নেওয়ার যোগ্য? কর্ণাটকের মহিলারা যেখানে হিজাব পরিধানের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন, সেখানেই ইরানীয় মহিলারা লড়াই করছেন হিজাব পরিত্যাগের জন্য। কোনভাবে কি এই দুটি বিক্ষোভকে একসাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়? এই বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে, আসলে কি দাবি রাখতে চান বিশ্বের নানা দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বী মহিলারা?

ফ্রিডম অফ চয়েস

হিজাবকেন্দ্রীক এই দুই বিক্ষোভ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আলোচনায় উঠে আসে পছন্দের স্বাধীনতার কথা। দুই ক্ষেত্রেই হয়েছে একই রকম অধিকার ভঙ্গ। ভারতে যেখানে, মুসলিম ধর্মাবলম্বী নারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন, সিস্টেমের আরোপ করা একটি নীতির বিরুদ্ধে; সেখানেই, ইরানে আন্দোলন হয়েছে সরকারের অবৈধ নীতি পুলিশির বিরুদ্ধে। ভারতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী নারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল হিজাব খুলে ফেলার জন্য। সেখানেই, ইরানে বিষয়টা উল্টো। সে দেশে জোরপূর্বক নারীদের জনসমক্ষে হিজাব পরার জন্য বাধ্য করা হতো। আর কোন নারী সেই আদেশ অমান্য করলে, ছিল ৭২ বার বেত্রাঘাতের নির্দেশ।

দুই ক্ষেত্রেই নারীদের উপর জোরপূর্বক আরোপ করা হয়েছিল বিধি নিষেধ। আর সেই আরোপিত বিধি নিষেধের প্রতিবাদ করতেই আজ এগিয়ে এসেছেন দুই দেশের নারীরা।

ইরান একটি সম্পূর্ণরূপে মুসলিম রাষ্ট্র এবং ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়ার কর্মীরা এবং হিজাব বিরোধী দলের সদস্যরা দুটি ভিন্ন সমাজনীতির এবং রাজনীতির দেশকে এক আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। দুটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এক করে দেখার কোন কারণ নেই। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই ইরানে হিজাব পরিধান নারীদের জন্য হয়ে ওঠে বাধ্যতামূলক। চার দশক পরে, গেরুয়াধারী তথাকথিত সমাজকর্মীরা করলেন হিজাবের বিরোধিতা। তবে এবারে হিজাব খুলতে বলা হলো মুসলিম নারীদের। স্কুল ও কলেজে তাদের যেতে বাধা দেওয়া হলো। গেরুয়া স্কার্ফ পরে পথে নামলো আরএসএস। আর ইরানের মতই ভারতেও একইভাবে লঙ্ঘিত হলো নারীস্বাধীনতা।

৮০-র দশকের ইরান বা ২০২২ এর কর্ণাটক, সর্বত্রই একটি বিশেষ আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীদের পোশাক বিধিকে কেন্দ্র করে। প্রো-হিজাব এবং অ্যান্টি-হিজাব দুই ক্ষেত্রেই একইরকমভাবে বঞ্চনার শিকার মুসলিম সমাজের নারীরা। রাস্তায় নেমে সরকারের এই শাসনের বিরুদ্ধে গলা উ উঁচিয়ে প্রতিবাদকেই তাই বারবার আপন করে নিয়েছেন নারীরা।

মুসলিম নারীরা কি চাইছেন?

হিজাব বিষয়টা মুসলিম নারীদের শুধুমাত্র একটি পোশাক নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু জটিল বিষয়। ইচ্ছা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ধর্মের একটি জটিল সংযোগস্থলে অবস্থান করে হিজাব। তাই এই হিজাবকে ব্যবহার করে মুসলিম নারীর মৌলিক অধিকারকে খর্ব করাটা কোন সরকারের আওতার মধ্যে পড়ে না। যারা এই হিজাব পরতে চান, তাদের নির্দ্বিধায় এই পোশাক পরার অনুমতি দেওয়া উচিত। আর যারা এটি পরতে রাজি নন, তাদেরকেও কোন দেশের সরকার বাধ্য করতে পারে না হিজাব পরতে। জেলে বন্দি করে সেইসব মহিলাদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে অত্যাচার সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক।

হিজাব সম্পূর্ণরূপে একজন নারীর ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকার। অনেক নারী এমন রয়েছে যারা মুসলিম হলেও হিজাব পরেন না। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে কোনভাবেই জোর করা যায় না, এই হিজাব পরিধানের জন্য। ধর্মের দিক থেকে ইসলাম হওয়া মানেই যে সমস্ত নারীদের এই পোশাক পরতে হবে, এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

ভারতের ক্ষেত্রে বিতর্কটা অন্যরকম। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের হিজাব পরিধানে বাধা দেওয়া হয়েছিল। জোরপূর্বক তাদের হিজাব পরিত্রানে বাধ্য করেছিল কর্নাটকের কিছু হিন্দুত্ববাদী প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির যুক্তিতে, হিজাব 'নিপীড়নমূলক'। কিন্তু ভারতের এই হিজাব কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রক নিয়মে একটা দিক তারা ধর্তব্যের মধ্যে রাখেনি। ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের পাশাপাশি শিক্ষার অধিকার থেকেও একটি সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করছিল এই আইন। তাই অবশ্যই মাহসা আমিনীর মৃত্যুর নিন্দা করার পাশাপাশি, সরকারগুলিকেও বিশেষ কিছু সম্প্রদায়ের পোশাক এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতার দিকটাও ভেবে দেখা উচিত।

মুসলিমবিরোধী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই

কর্ণাটকের মুসলিম বিরোধী হিজাব ইস্যুতে একটি বিষয়ে স্পষ্ট, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে অত্যাচার এবং তাদের অধিকার খর্ব করা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি বিশেষ অঙ্গ হয়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছর যাবৎ। কর্নাটকে মুসলিম নারীদের হিজাব বিরোধী আন্দোলন আদতে ছিল মুসলিম বিরোধী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটা লড়াই, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, পছন্দের স্বাধিকার অর্জনের একটা লড়াই।

অন্যদিকে, ইরানে মুসলিম নারীদের লড়াইয়ের কারণটাও ছিল প্রায় একই রকম। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের সমানাধিকারের দাবি নিয়ে চলছে এই আন্দোলন। শুধুমাত্র পোশাকের কারণে কেন একজন নারীকে জেলে বন্দী করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হবে? কেন সে দেশে বসবাসকারী কোন নারী নিজের ইচ্ছে মতো পোশাক পরতে পারবেন না? দুই দেশে দুই আন্দোলনের মধ্যে অনেকটাই সদৃশতা বিদ্যমান। তবে, এদেশের বিশেষ কিছু সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের থেকে শুরু করে এদেশের ডানপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা যেভাবে দুই আন্দোলনকে এক সূত্র গেঁথে ফেলেছেন সেটা ঠিক নয়। এই দুটি আন্দোলনই হিজাবকেন্দ্রিক। দুই ক্ষেত্রেই আন্দোলন সিস্টেমের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তবে, দুই আন্দোলনের গভীর কারণটি হলো নারীর অধিকার, যে অধিকারের দাবিটাই মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দিয়েছে ইরান ও কর্নাটকের মহিলাদের মনন-চিন্তনকে।

More Articles