শরীরে তিল তিল করে বাড়ছে মারণ ফ্যাটি লিভার, কী ভাবে বুঝবেন, প্রতিরোধ সম্ভব?

ব্যস্ততার কারণে প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যায়াম,সঠিক ডায়েট মেনে খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া সম্ভব হয় না আমাদের অনেকেরই। এর ফলে শরীরে দানা বাঁধছে একাধিক রোগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের রোগকে লাইফস্টাইল ডিজিজ বলে। এমনই একটি রোগ ফ্যাটি লিভার, ব্যস্তসমস্ত আধুনিক পৃথিবীতে যার বাড়বাড়ন্ত দেখে রীতিমতো প্রমাদ গুণছেন চিকিৎসকরা। কারণ লিভার বা যকৃৎ হল আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। খাবার হজম থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন দূষিত পদার্থ দূর করায় লিভারের ভূমিকা রয়েছে। এদিকে অনেকেই নিজের অজান্তে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাই জেনে নিন এ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। 

ফ্যাটি লিভার কী?

এক কথায় বললে লিভার বা যকৃতের কো অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়াকেই ফ্যাটি লিভার বলা হয়। পূর্ব বর্ধমান জেলার ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার ও চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী মতে, বিভিন্ন কারণেই লিভারে ফ্যাট জমা হতে থাকে তবে এক দিনেই এই রোগ হওয়া সম্ভব নয় । তাঁর মতে দীর্ঘ কয়েক বছরের অনিয়মের ফলেই শরীরে এই রোগ সৃষ্টি হয়। 

ফ্যাটি লিভারের প্রকারভেদ-

মূলত দু'প্রকারের ফ্যাটি লিভার রয়েছে - 

১.নন - অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার
২. অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার, একে অ্যালকোহলিক স্টেটোহেপাটাইটিসও বলা হয়।

১. নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার: 

এক্ষেত্রে যাঁরা অ্যালকোহল বা মদ্যপান করেন না তাঁদের লিভারে চর্বি জমা হয়। চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর মতে, বিভিন্ন কারণে শরীরে চর্বি জমতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে এই ধরনের ফ্যাটি লিভার খুবই লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও যাঁদের স্থূলতা বা ওবেসিটি রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রেও এই রোগটি দেখা যায়। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় জাঙ্ক ফুড থাকলে, কিম্বা অতিরিক্ত খাবার খেলে বা ব্যয়াম না করলে এই ধরনের ফ্যাটি লিভারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

২. অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার:

এক্ষেত্রে অত্যধিক মদ্যপানের ফলে যকৃতে বা লিভারে ফ্যাট জমা হয়। অ্যালকোহল লিভারে গিয়ে ফ্যাটি অ্যাসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়ে তা লিভারে জমতে শুরু করে। ফলে দীর্ঘদিন অতিরিক্ত মাত্রায় মদ্যপানের ফলে এই ধরণের ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে।

তবে এই দু'ধরনের ফ্যাটি লিভারের মধ্যে অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার অনেকক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তবে চিকিসকের মতে, আজকাল নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও যথেষ্ট বেশী কারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসই বদলে গেছে। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও এখন সবুজ শাকসবজির বদলে জাঙ্ক ফুড খাচ্ছেন ফলে এই রোগের প্রবণতাও বেড়ে চলেছে সময়ের সঙ্গে। দু'ধরনের ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রেই অন্তিম পর্যায়ে লিভারে সিরোসিস দেখা দেয় এবং এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এমনকী ক্যানসারের মত মারাত্মক রোগেরও কারণ হতে পারে ফ্যাটি লিভার। 


এই রোগের লক্ষণগুলি কী কী?

চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়," প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের কোনও লক্ষণ শরীরে প্রকাশ পায় না। লিভারে ফ্যাট জমতে থাকলেও রোগী কোনও ব্যথাবেদনা অনুভব করেন না। কারণ মানুষের লিভারে ব্যথা অনুভবকারী রিসেপ্টরগুলিই অনুপস্থিত থাকে।" তবে ফ্যাটের পরিমাণ বাড়তে থাকলে যে যে উপসর্গ দেখা যায়-

১. ক্ষুধামান্দ্য বা খিদে কমে যেতে থাকে। 
২. সারাক্ষণ বমি বমি ভাব থাকে। 
৩. এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হজম শক্তি একেবারেই কমে যায়। ফলে যে কোন খাবার খেলেই অ্যাসিডিটি যায়। 
৪. সারাদিনই খুব ক্লান্তি অনুভব করেন রোগীরা। 
৫. দেহে অতিমাত্রায় ফ্যাট জমা হলে জন্ডিসের লক্ষণও প্রকাশ পায়। অর্থাৎ ত্বক এবং চোখ হলুদ হয়ে যায়। 

আপানার শরীরে এসব লক্ষণগুলি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

কী উপায়ে চিহ্নিত করা যায় ফ্যাটি লিভার?

ফ্যাটি লিভার চিহ্নিত করার একাধিক উপায় রয়েছে।

১. ইউএসজি (আলট্রা সোনোগ্রফি) : যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় না সেক্ষেত্রে ইউএসজির মাধ্যমে তা নিশ্চিত করে বোঝা সম্ভব হয়।

২. লিভার বায়োপসি: লিভার বায়োপসির মাধ্যমে এই রোগের তীব্রতা বোঝা যায় সহজেই। লিভারের কোষে ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রাই রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করে।

৩. এম আর আই - এম আর আই বা ম্যাগনেটিক রেসনেন্স ইমেজিং এর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই এই রোগ চিহ্নিত করা যায় ‌

৪. লিভার ফাংশন পরীক্ষা: এই পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারে উপস্থিত বিভিন্ন উৎসেচকের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।ফ্যাটি লিভারসম্পন্ন ব্যক্তির রিপোর্টে উৎসেচকের পরিমাণে তারতম্য লক্ষ্য করা যায় যা থেকে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন। 

চিকিৎসা পদ্ধতি:

বর্তমানে ফ্যাটি লিভার রোগের চিকিৎসার জন্য কোনো ওষুধ অনুমোদিত হয়নি।  চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। শরীরের ওজন কম করতে হবে তবেই লিভারের বাড়তি মেদ ঝড়বে।

এক্ষেত্রে জাঙ্ক ফুড একেবারেই চলবে না।

ব্যায়াম, মর্নিং ওয়াকের মতো ফিজিক্যাল ট্রেনিং ওজন কমাতে সাহায্য করে।

অ্যালকোহল এড়িয়ে চলাই ভালো।  

যেহেতু প্রাথমি ভাবে এই রোগের কোনও লক্ষণ প্রকাশ করা পায় না তাই ওবেসিটি, ডায়াবেটিস রয়েছে যাঁদের সেসব মানুষদের নিয়মিত লিভার চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে।

বছরে অন্তত একবার ইউএসজি করানো উচিত।

সল্টি ফুড বা নোনতা খাওয়ার এড়িয়ে যাওয়া উচিত।

খাওয়া চলবে না কেক পেস্ট্রি জাতীয় খাবার। চকোলেটকে বাদ দিতে হবে।

হাই স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকায় ঘি মাখনও বর্জনীয়।

পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতেই হবে।

ফ্লেক্সসিড, চিয়াসিড ডায়েটে যোগ করুন। 

ভিটামিন-ই সমৃ্দ্ধ খাবার ডায়েটে রাখুন। থাকুক সোয়া-জাতীয় খাওয়ারও।

More Articles