সারা ভারতের লোকনৃত্য এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান

লোক নৃত্য হ'ল এমন একটি নৃত্য যা একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের মানুষের জীবনকে প্রতিফলিত করে। যদিও সমস্ত জাতিগত নৃত্যকে লোক নৃত্য বলা যায় না, উদাহরণস্বরূপ, কোনও আনুষ্ঠানিক নাচ বা আনুষ্ঠানিক উৎসবের নৃত্যগুলি লোকনৃত্য হিসাবে বিবেচিত হয় না। কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যে নাচ হয় তাদের সাধারণত "ধর্মীয় নৃত্য" শ্রেণীতে ধরা হয়। এথনিক বা জাতিগত নাচ এবং ট্র্যাডিশনাল বা পরম্পরাগত নাচ শব্দগুলি তখনই ব্যবহৃত হয় যখন কোনও নাচের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হয়। এই অর্থে, প্রায় সমস্ত লোক নৃত্য বা folk dance ই এথনিক। ভারতীয় লোক নৃত্য, যা সাধারণত অল্প কয়েকটি স্টেপ বা শারীরিক ভাবভঙ্গি দিয়ে হয়ে থাকে, তা বিশেষত পরিবেশন করা হয় যে কোনও অনুষ্ঠানে, যেমন বিবাহ, সন্তানের জন্ম, সাধ এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে। কিছু ভারতীয় লোক নৃত্যে পুরুষ এবং মহিলা পৃথকভাবে পরিবেশনা করেন; আবার কয়েকটিতে তারা একসাথে নাচ করেন। সাধারণত folk বা লোক নৃত্যে নৃত্য শিল্পীরা সঙ্গীতজ্ঞদের সাথে একসাথে গান করেন, বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র দিয়ে তাদের সঙ্গ দেন। লোক নৃত্যের জন্য সাধারণত আঞ্চলিক পোশাক ব্যবহার হয়, সাথে আঞ্চলিক সাজ সজ্জা।

 

এবার জানা যাক সারা ভারতের কিছু নাম করা folk নৃত্য সম্পর্কে এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। অন্ধ্রপ্রদেশের কুচিপুড়ি, ভারতব্যাপী নাম খ্যাত এই নাচটি অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়ারা নামক একটি জায়গা থেকে খানিক দূরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম থেকে এসেছে। ভামাকল্পম , যে নাচটি কুচিপুড়ি নৃত্যের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়, এবং এটি শ্রী কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামাকে ঘিরে পরিবেশন করা হয়। এছাড়া এই রাজ্যের ভিরানাট্যাম, দপ্পু, তাপেটা গুল্লু নাচগুলি বিখ্যাত। অরুণাচল প্রদেশের মনপা জাতির আজি লামু, সিংহ এবং ময়ূরের নাচ, নকটে জাতির চালো, আপাতানি জাতির হিরি খানিং, মিশমি জাতির বুইয়া। আসামের বিহু, বাগুরুম্বা, ঝুমুর।

যার মধ্যে বিহু নাচ শুধু আসাম বা উত্তর পূর্ব ভারত নয়, সারা ভারতে তথা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিখ্যাত। বিহু আসামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অসমীয়া উৎসবে দেখা যায়, প্রথমটি এপ্রিল মাসে রঙ্গালী বা বেহাগ বিহু হিসেবে পরিচিত, অক্টোবরে কঙ্গালী বা কাতি বিহু এবং জানুয়ারি মাসে ভোগালী বা মগ বিহু পালন করা হয়। বসন্ত উৎসবে উদযাপিত রঙ্গালি বিহু এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিহারে বিদেশিয়া, ডমকাচ, ফাগুয়া এবং ঝুমরির কথা অনেকেই জানেন। বিদেশিয়া নাচটি ভিখারী ঠাকুর বলে একজন নাপিত তৈরি করেছিলেন, যিনি আবার থিয়েটার ভালবাসতেন। ঝুমরি নাচটি বিহারের গড়বা নাচের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। ছত্তিসগড়ের প্রধান লোক নৃত্য যেমন সায়লা নৃত্য, কর্মা, সু নাচ, পান্থি নৃত্য, রাউত নাছা, গেন্ডি ইত্যাদি। ছত্তিশগড়ের লোকনৃত্য পরিবেশন করতে লোকেরা বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করে, যেমন ঢোল, করতাল, মনজিরা, মন্দার। এছাড়া মহারাষ্ট্রের লাভনি, গোয়ার ধালো, ফুগদি, দেখ্নি, মুস্সোল, গুজরাটের গড়বা, দান্ডিয়া, হিমাচলের নাটি, হরিয়ানার ঝুমার, ঘুমার, চৌপায়া, সাং, রাগিণী, কর্নাটকের ভরতনাট্যম, কেরালার থেইয়ামের, তিরুবাথিরাকালি, ছকিয়র কূথু কুদিয়ত্তম, এবং ওত্তামথুলাল বিশিষ্ট নৃত্য। যদিও ক্লাসিকাল দুটি নাচ 'কথাকলি' এবং 'মহিনিয়ট্যম' এর জন্য কেরল জনপ্রিয়, যা বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। পাঞ্জাবের ভাংরা, রাজস্থানের ঘুমর, তামিলনাড়ুর কর্কট্যাম, কুম্মি, এবং উত্তরপ্রদেশের রাসলীলা প্রসিদ্ধ। এছাড়াও আরও অনেক জায়গা এবং নাচের কথা বলা যায়।

 

এবার আসা যাক বাংলার লোক নৃত্যের তালিকায়। পশ্চিমবঙ্গ তার উৎসব, সংস্কৃতি এবং শিল্প সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত। কথায় বলে বাঙালির নাকি শিরায় শিরায় গান, সুর, ছন্দ বর্তমান। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর ধরণের লোক সংগীত এবং নৃত্য প্রচলিত রয়েছে। নির্বাচিত কয়েকটির মধ্যে, বৃত বা ভৃত নাচ গ্রামাঞ্চলে বেশ পরিচিত, এই নাচের কোনও সঠিক বিবরণ আক্ষরিক অর্থে না পাওয়া গেলেও রাজ্যের বাইরেও এই নাচ মাঝে মধ্যেই আলোচনায় থাকে। গম্ভীরা নৃত্য, পশ্চিমবঙ্গের লোকনৃত্যগুলির মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। এই নাচ দৃষ্টিনন্দন, এই নৃত্যে ব্যবহৃত পোশাক এবং সাজ সজ্জার জন্য এই নাচ আরও রঙিন হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে, লোকজ নৃত্যগুলি ছিল কৃষি বা ভক্তিমূলক। ধীরে ধীরে ভক্তি এবং ধর্মের নৃত্যগুলি কৃষি নৃত্যগুলির স্থান নিয়ে নিয়েছে। বাংলার অন্যতম বিখ্যাত ভক্তিমূলক নৃত্য গম্ভীরা। এবার আসে পুরুলিয়া তথা পশ্চিমবঙ্গের ছৌ নাচ। ছৌ নৃত্য ভারতের অন্যতম খ্যাতিমান উপজাতি নৃত্য। নাচটি ঝাড়খণ্ডে সেরাইকেল্লা ছৌ, উড়িষ্যায় ময়ূরভঞ্জ ছৌ এবং পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়া ছৌ নামে পরিচিত। যেহেতু এই নাচের সূচনা হয়েছিল পশ্চিমবাংলার পুরুলিয়া জেলায়, তাই এটি রাজ্যে শুধু ছৌ হিসেবেই পরিচিত এবং পুরুলিয়া ছৌ নাচটি অন্য ছৌ নাচের থেকে বেশ আলাদা। সাঁওতাল নৃত্য, ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত উপজাতিনৃত্যগুলির মধ্যে একটি। সাঁওতাল উপজাতির মানুষদের একটি বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ডে পাওয়া যায়। সাঁওতাল উপজাতি একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বংশ এবং এদের নিজস্ব সংহতি রয়েছে। এর সদস্যরা মূলত ঈশ্বরের ভক্ত, এবং বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তারা সংগীতে প্রকৃতির গৌরব উদযাপন করে, বিভিন্ন সামাজিক বার্তা পরিবেশন করেন এবং প্রার্থনা

করেন। বীরভূমে টুসু নাচ বিখ্যাত হলেও, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এই নাচ প্রসিদ্ধ এবং এর সাথে একটি নির্দিষ্ট লোক নৃত্য ও সংগীত থাকে। এই নাচ মূলত উৎসবের কিছু নির্দিষ্ট মরসুমের সাথে সম্পর্কিত। এটি মূলত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসগুলিতে, পৌষ উৎসবের সময় সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। লাঠি নাচ, নাচ ভাব প্রকাশের এক অনন্য উপায়। নাচে একাধারে উদযাপন, অনুশোচনা, ক্রোধ, প্রেম বা বেদনা প্রকাশ করতে পারে, আবার নাচের চালগুলি প্রতিটি অভিব্যক্তিকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের লাঠি নাচ তাদের মধ্যে একটি। সাধারণত মহররমের সময় এই নাচ দেখা যায়, এই নাচে এই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত অনুশোচনা এবং ক্ষোভের অনুভূতিকে আবদ্ধ করা হয়। মহররমের প্রথম দশ দিনের মধ্যে লাঠি খেলোয়াড়রা বেশ কয়েকটি জায়গায় তাদের শিল্প প্রদর্শন করে থাকেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বাউল, ভাদু, ঝুমুর নাচ সহ আরও অনেক লোকনৃত্য দেখা যায়।

 

যুগ যেহেতু বিজ্ঞানের, তাই আস্তে আস্তে সংস্কৃতি, সৌহার্দ্য, উৎসবের সেই আমেজ কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু ভারত সাংস্কৃতিক দিক থেকে জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে একথা হলফ করে বলা যায়। আপনি ছোট্ট ট্রিপে বীরভূমের শান্তিনিকেতন যান আর পুরুলিয়া, বড় প্ল্যান করে আসাম যান অথবা রাজস্থান, দেশের সংস্কৃতি আপনাকে জড়িয়ে রাখবেই এবং জড়িয়ে রাখার দড়ি গুলির অন্যতম কিন্তু লোকনৃত্য।

Source :

  • https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_Indian_folk_dances
  • http://www.bharatonline.com/west-bengal/dance/index.html
  • https://www.iasgyan.in/blogs/statewise-list-of-folk-dances-of-india-andhra-pradesh

More Articles