ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস .............অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ। সময়টা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষে মোটেই সুবিধার যাচ্ছে না।প্রথম অ্যংলো-মারাঠা যুদ্ধে মারাঠা অধিপতির কাছে কোনওক্রমে হার বাঁচানো গেছে। আর দক্ষিণভারতে হায়দার আলির কাছে তো হারই স্বীকার করতে হলো কোম্পানীকে। ওদিকে যখন লন্ডনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট স্বাধীন কর্মকান্ড করার অধিকারকে সঙ্কুচিত করে দিলো,তখন কোম্পানীর রাজত্বে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরে। সেখানে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসন-যন্ত্রের ওপর প্রবল চাপ ........কী উপায়ে আরও দক্ষতা এবং দ্রুততার সঙ্গে গোপনে রাজনৈতিক কার্য্কলাপ জারি রাখা যায়? সেই চাপ কমানোর জন্য কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর Board of Directors -এর একটা জরুরী বৈঠক বসল। তারিখটা ছিল ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর। সেই বৈঠকে তাঁরা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে...... দক্ষ অফিসারদের নিয়ে একটি নতুন বিভাগ খুলতে হবে, যারা শাসন-যন্ত্রের ওপর ক্রমবর্দ্ধমান চাপ লাঘব করতে সদা-তৎপর থাকবে |

কোম্পানীর সেই নবনিযুক্ত বিভাগ অনতিবিলম্বে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিল, কূটনীতি ও কূটনৈতিক কাজকর্মে হাত পাকালো। সেই বিভাগ-ই কালক্রমে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (IFS ) বা ভারতীয় পররাষ্ট্রে দপ্তরে রূপান্তরিত হলো।

তখন ১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দ, ভারতের বুকে ব্রিটিশরা তাদের ক্ষমতার জাল বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই বিস্তার করে ফেলেছে। জয় করতে বাকী শুধু পাঞ্জাব। এইরকম সময়ে ব্রিটিশরা উপলব্ধি করল যে দক্ষতর প্রশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই বিদেশ বিভাগটিকে পুনর্গঠন করা দরকার। তখন ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন এলেনবোরো। তিনি প্রশাসনিক সংস্কারের কাজ শুরু করলেন এবং চারটি নতুন বিভাগ সৃষ্টি করলেন, 'বিদেশ দপ্তর, স্বরাষ্ট্র দপ্তর, অর্থ দপ্তর এবং সেনাবিভাগ'।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ২রা অগস্ট, ১৮৫৮-য় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে 'India Act ' পাশ হয়ে ভারত সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে আসে এবং কোম্পানীর আমলের অবসান হয়।তখন থেকেই লন্ডনে 'ইন্ডিয়া অফিস' থেকে ভারতের শাসনকাজ পরিচালিত হতো।

১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস, ভারত তখন স্বাধীনতা লাভের দ্বারপ্রান্তে | তখন এই উদীয়মান স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য একটি পৃথক কাঠামো গঠন করার প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভব করা শুরু করেন রাজনৈতিক মহলের মানুষেরা।তারপরই বহির্বিশ্বে ভারতের কূটনৈতিক রাষ্ট্রদূত সম্পর্কীয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধিত্বের সম্যক ব্যবস্থাপনার জন্য ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের সৃষ্টি হলো ৯ই অক্টোবর, ১৯৪৬। পৃথিবীতে যত দেশে যত সিভিল সার্ভিস চালু আছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার কাজে, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতামূলক সার্ভিস হলো Indian Foreign Service ; যার উৎকর্ষ সারা বিশ্বের কূটনৈতিক মহলে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে।স্বাধীনতার পর থেকে একটি সু-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বিভাগ পররাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ব্যবস্থাপনাগুলি হলো, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা এবং ভারতের হয়ে দর কষাকষি করা; পররাষ্ট্রগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা; বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেসব বিষয় দ্রুত নিজ দেশের শাসন, কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা | প্রকৃতপক্ষে এই সকল সংবাদ ও তথ্যই দেশের পররাষ্ট্রনীতি গঠনের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। IFS অফিসারেরা হলেন এই ব্যবস্থাপনার মেরুদন্ড বিশেষ। তাঁরা একাধারে বৈদেশিক রাষ্ট্রে ভারতের স্বার্থের বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন এবং তার পাশাপশি শান্তি ও সমৃদ্ধিকে ত্বরান্তিত করেন। এই কাজ করতে গিয়ে IFS অফিসারদের বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে উচ্চ পৰ্যায়ের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার স্তরে নিজের দেশের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে কূটনৈতিক লড়াই চালাতে হয় এবং স্বদেশের নাগরিকেরা যখন বিদেশ ভ্রমণে যান, তখন তাদের সুরক্ষা ও সহায়তা দানে সদা-তৎপর থাকতে হয়।

বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় ভারত রাষ্ট্র একটি অগ্রণী শক্তিরূপে জেগে উঠেছে। এই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে একটি কার্য্যকরী ফরেন সার্ভিসের ভূমিকা যে কতটা প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না |

বর্তমানে IFS ক্যাডারে প্রায় ৮৫০ জন অফিসার নিযুক্ত আছেন যাঁরা স্বদেশ ও বিদেশের প্রায় ১৯৩টি অফিস থেকে তৎপরতার সঙ্গে কাজ করছেন।দ্বিপাক্ষিক স্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সুনিশ্চিত করা ; বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তারের ব্যবস্থা করা ও স্বদেশের ব্যাবসা-বাণিজ্য-শিল্পে বৈদেশিক মূলধনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা; রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের আদান-প্রদান বৃদ্ধি এবং সংবাদ-মাধ্যমের যোগসূত্র ও আদান-প্রদান বৃদ্ধি ইত্যাদি বহুবিধ দায়িত্ব তাঁদের ওপর বর্তায় |

তার নির্যাস হিসাবে বলা যায় ....একজন IFS অফিসারকে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে ও হাইকমিশনে ভারতের প্রতিধিত্ব করতে হয়; রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন দপ্তরে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়; বিদেশে বসবাসকারীও ভ্রমণরত NRIS (Non Resident Indians), PIOS ( People of Indian Origin ) -এদের স্বার্থরক্ষা করতে হয়; বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক- বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থরক্ষা দেখতে হয় ; বিদেশের মাটিতে লব্ধ যাবতীয় সংবাদ ও তথ্য সম্পর্কে নিজ দেশের রাষ্ট্র - পরিচালকদের অবগত করার কাজটিও করতে হয়।

কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে বর্তমানে Ministry of External Affairs (পররাষ্ট্র দপ্তর)-এর পরিচালনাধীন IFS অফিসারদের সংখ্যা উল্লিখিত দায়িত্বপালনের গুরুভার বহনের পক্ষে যথেষ্ট নয় | নতুন অফিসার নিয়োগ খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। IFS অফিসার হিসাবে ভবিষতে চাকরি করতে ইচ্ছুক যুবক-যুবতীরা কিন্তু সরাসরি পররাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন পাঠাতে পারেন না।তাঁদের অন্যান্য সিভিল-সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের সঙ্গেই যোগ্যতা বিচারের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। বাস্তব দৃষ্টি-ভঙ্গি নিয়ে বিচার করে বলা যায়, এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে গুণমানের অফিসাদের প্রয়োজন হয়, তার থেকে অনেক ভিন্ন গুণমানের অফিসারদের প্রয়োজন পররাষ্ট্রনীতি ও তৎসংক্রান্ত বিষয়গুলির দেখভাল করার জন্য | অতএব IFS অফিসারদের নিয়োগনীতির পরিবর্তন বিশেষ ভাবে প্রয়োজন |

এ প্রসঙ্গে আমাদের IFS অফিসারদের কিছু উজ্জ্বল সাফল্যের নিদর্শন তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। তাঁদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও কূটনৈতিক দক্ষতার ফলে ২০২১-২০২২ সালের গঠিত সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের ( Security Council ),সকল প্রকার বিরুদ্ধতা কাটিয়ে সর্বাধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে ভারত এবং আসন লাভ করেছে। IFS অফিসারেরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে 'বন্দে ভারত মিশন' প্রকল্পের সাহায্যে 'করোনা' রোগের প্রাদুর্ভাবে বৈদেশিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়া বহু সংখক ভারতীয়কে স্বদেশে নিরাপদে ও সসম্মানে ফেরাতে পেরেছেন। একই ভাবে ভারতে আটকে পড়া বিদেশিদের সসম্মানে ও নিরাপদে নিজ নিজ দেশে ফেরাতে পেরেছেন |
আর একদিকে তাঁরা নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে বিদেশের সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি স্বাস্থ-কর্মী সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রেখে ১৫০টি অধিক দেশে 'করোনা' রোগের ওষুধ, ভ্যাকসিন ও COVID -19 Protective Equipment সরবরাহ করতে সমর্থ হয়েছেন। এ কাজে তাঁদের পাহাড়প্রমাণ বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছিল |
বর্তমানে বিশ্বে কোনও দেশই বিচ্ছিন্নভাবে চলতে পারেন না,কারণ তাদের পারস্পরিক নির্ভরতার বাতাবরণে বাস করতে হয়। এ অবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্রের পক্ষে সুচিন্তিত পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা খুবই জরুরী। যাতে করে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষাবিষয়ক ও কূটনৈতিক সুসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং সেই প্রকার সম্পর্ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির (NGO ) কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয় সাধারণ মানুষের সুখবিধানের উদ্দেশ্যে | অতএব IFS -এর সাফল্যের ইতিহাসের নিরিখে বলা যায় যে ভবিষতে তাঁরা আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় ভারতের জন্য নিরাপদ এবং সম্মৃদ্ধিপূর্ণ অবস্থান সুনিশ্চিত করবেন |

 

তথ্য সূত্র : লেখক এর নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles