নেহেরু নন, ইনিই ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী

যেকোনো ছোট্ট স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক যে কোন সাধারণ মানুষ, যাকে জিজ্ঞেস করবেন না কেনো, সেই কিন্তু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহেরুর কথা বলবেন। এবং সেটা বলাই স্বাভাবিক। আজ অব্দি স্কুল সিলেবাস থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গাতেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জহরলাল নেহেরুর নাম লেখা রয়েছে। ১৯৪৭ সালে যখন ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ভারত স্বাধীন হল, তখন থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু। কিন্তু ভারতে এমন কিছু ঐতিহাসিক নথিপত্রে রয়েছে, যা প্রমাণ করে '৪৭ এর স্বাধীনতার আগেই ভারতে প্রথম সরকার গঠিত হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন সময়ের ভারতের একটি রাজনৈতিক দল এই সরকার গঠন করেছিল। সেই দলের থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ। ইংরেজদের দ্বারা সেই সরকার ভেঙে ফেলা হলেও, ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয়েছে, ওই সরকার ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীন সরকার। রাশিয়া থেকে শুরু করে আফগানিস্তান, জাপান এবং তুর্কমেনিস্তানের সাহচর্য লাভ করে ওই সরকার গঠন করা হয়েছিল।

 

তখনকার সময়ে এই সরকারের ক্ষমতা এতটা বেশি হয়ে গিয়েছিল যে ইংরেজ শাসকরা ওই সরকার ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল। অত্যন্ত স্বল্প মেয়াদী সরকার হলেও এই সরকারটিকে ভারতের প্রথম সরকারি হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং এই সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর এই সরকার গঠন করেছিল তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত অন্যতম রাজনৈতিক দল গদর পার্টি। ১৩ মার্চ ১৯১৩ সালে গদর পার্টি স্থাপিত হয়েছিল। তারপরে ১২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে একটি বিশাল বড় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল গদর পার্টির তরফ থেকে। সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সবে সবে শুরু হয়েছে। ভারতের মধ্যে গদর পার্টির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে শুরু করলো। সেই সময় এই দলের সঙ্গে যুক্ত হলেন শোহন সিং বহুকনা এবং লালা হরদয়াল এর মত বেশকিছু স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে ধংস করা এবং গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করে গদর পার্টি।

 

শুধু ভারত নয়, ভারতের বাইরেও ধীরে ধীরে এই গদর পার্টির জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলো। সেই সময় এই পার্টির সংস্থাপক মৌলানা বরকতউল্লাহ একটি সাপ্তাহিক গদর প্রকাশন তৈরি করলেন। সেখান থেকে আগামী দেড় বছর পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্রান্তিকারী লেখা ছাপানো শুরু হলো। সেই সময় থেকেই একজন ক্রান্তিকারী লেখক এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বরকতউল্লাহ জনপ্রিয় হতে শুরু করলেন। গদর প্রকাশন এর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলে এই পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন চম্পক রামন পিল্লাই, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এর মত ব্যক্তিরা। ভারতের সাধারণ মানুষকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু করলো গদর প্রকাশন। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার লেখা এবং বরকতউল্লাহর দুর্দান্ত বাচনভঙ্গি গদর পার্টির এই পত্রিকাকে আমেরিকা থেকে জার্মানি পর্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলল।

 

আস্তে আস্তে সাপ্তাহিক গদর পত্রিকার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করলো। তার সাথে সাথেই এই সমস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা নিতেও শুরু করলেন। কিন্তু, পত্রিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে গদর পার্টির বিরুদ্ধে তখনও তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে পরিস্থিতি সমস্যাজনক হয়ে পড়লে তখন যখন বরকতউল্লাহ খান এবং রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ এর প্রচেষ্টায় ইংরেজদের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করা সৈনিকেরা ইংরেজদের হয়ে কাজ করতে মানা করতে শুরু করলেন। অথৈ জলে পড়ল ব্রিটিশ সরকার। এই পদক্ষেপকে ব্রিটিশ সরকার অনেকটা বেইমানির চোখে দেখতে শুরু করলো। এই পদক্ষেপের পরেই বরকতউল্লাহ এবং রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে লোহা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তুর্কমেনিস্তান, বাগদাদ এবং আফগানিস্তান সফরে গেলেন। কাবুলে এই দুই নেতাকে ব্রিটিশ সৈন্যরা নজরবন্দি করে ফেলল। কিন্তু অন্যদিকে তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলো আফগানিস্তানের সাধারণ জনতা এবং জার্মানি সরকার।

 

ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের দুজনকে মুক্ত করতে বাধ্য হল। কিন্তু তখন থেকেই এই দুই নেতা ফন্দি আঁটতে শুরু করলেন যে কোনোভাবেই হোক ব্রিটিশ সরকারকে দেশ থেকে সরাতে হবে। এবং তার জন্য সবার আগে লাগবে একটি অস্থায়ী সরকার। যেমন ভাবা তেমন কাজ, ১৯১৫ সালে জার্মানি সরকারের সাহায্য নিয়ে কাবুলে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করে ফেললেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ। জার্মানির সরকারের তরফ থেকে ভারতের এই অস্থায়ী সরকার কে সাহায্য করা হয়েছিল। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বরকতউল্লাহ খান এবং রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ। এছাড়াও ভারতীয় গৃহ মন্ত্রী হয়েছিলেন উবেদ আল সিন্ধি, যুদ্ধমন্ত্রী হয়েছিলেন মৌলবি বশীর এবং বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন চম্পক করন পিল্লাই। 

 

তবে জানিয়ে রাখা ভাল, বরকতউল্লাহ খানের এই সরকার কিন্তু ভারতের মাটিতে তৈরি হয়নি, বরং গঠিত হয়েছিল আফগানিস্তানের মাটিতে। তাই সবার আগে আফগানিস্তানের সঙ্গে বরকতুল্লাহ একটি চুক্তি করেছিলেন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আফগানিস্তান তাদেরকে সাহায্য করবে। আফগান সরকারের সমস্ত আশ্বাসন লাভ করে ভারতের ওই অস্থায়ী সরকার ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিজেদের আক্রমণ আরো জোরালো করতে শুরু করে। অন্যদিকে রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ চীন, মঙ্গোলিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশকিছু দেশের সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে শুরু করলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর সংগ্রামের পর রাশিয়ায় জারশহী পরাজিত হলেন।

 

১৯১৯ সালে মস্কো গিয়ে সেখানে বরকতুল্লাহ দেখা করলেন লেনিনের সঙ্গে। লেনিনের আশ্বাসনের পর সোভিয়েত রাশিয়ার তরফ থেকে ভারতকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করা শুরু হলো। কিন্তু, ১৯১৯ সালের শেষের দিকে ইংরেজ সরকার বুঝতে পারল, এই গদর পার্টি ইংরেজ সরকারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হল এই পার্টির সংবাদপত্র। সাথে সাথেই রাশিয়া এবং আফগানিস্তানের সঙ্গেও এই সরকারের সম্পূর্ণ যোগাযোগ স্তব্ধ করে দিলো ব্রিটিশ সরকার। ফলপ্রসূ কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের প্রথম অস্থায়ী সরকারের পতন হলো। কিন্তু এই সরকার জন্ম দিয়েছিল বাঘাযতীন, লালা হরদয়াল, শচীন সান্যাল, রাজবিহারী বসু, এবং ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এর মত লোকেদের যারা পরবর্তীতে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্য জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন।

তথ্যসূত্র -

  • https://hindi.news18.com/news/knowledge/barkatullah-khan-was-the-first-prime-minister-of-india-instead-of-nehru-1973446.html

More Articles