ক্ষমতার বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই! কেন দেখতেই হবে ইন্দুবালা ভাতের হোটেল?

Indubala Bhater Hotel Review: আসলে অতীতকে মনে রাখা হলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই। স্মৃতিই মানুষকে বিদ্রোহে এগিয়ে দেয়।

ঋত্বিক ঘটক বলতেন, "বাংলার আবার এপার ওপার কী!" কিছুতেই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দেশভাগের বাস্তবতা কেউ অস্বীকারও করতে পারি না। আজও আমাদের পূর্বসূরিরা দেশভাগের অন্ধকার বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। অসংখ্য মানুষ রাতারাতি বাস্তুহারা হয়ে ঠাই খুঁজে নিয়েছিলেন এদেশের অলিগলি বা রেললাইনের ধারের বস্তিতে। তারপর শুরু হয় টিকে থাকার লড়াই। আমাদের ঠাঁইনাড়া পূর্বপুরুষরা ধীরে ধীরে নিজেদের গোছাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে। সারা দেশজুড়ে সাড়ম্বরে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন হয়েছে। এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই দেশভাগের স্মৃতি শুধুই রোমান্টিসিজম। ঠিক এরকম স্মৃতিহীনতার সন্ধিক্ষণে দেশভাগের নির্মম অভিঘাত এই কিছুদিন আগেও টের পাওয়া যায় যখন পশিমবঙ্গে এনআরসি হওয়ার ভয়ে মানুষজন আত্মহত্যা করেন। এমন এক সময় পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য নির্মাণ করেছেন ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’-এর মতো ইতিহাস খননকারী সিরিজ। লেখক কল্লোল লাহিড়ী লিখিত এই উপন্যাস ইতিমধ্যেই অসংখ্য পাঠকের ভালোবাসা কুড়িয়েছে। এমন এক জনপ্রিয় বইয়ের চলচ্চিত্রায়ণ সহজ ব্যাপার নয়। পাঠকরা লেখার সঙ্গে সিনেমার গল্পের মিল খুঁজতে চান লাইন ধরে ধরে। এক্ষেত্রে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য অবশ্য নিরাশ করেননি।

‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ সিরিজটি সময়ের পলি খনন করে খুঁজে চলে স্মৃতির ইতিহাস। গল্পটি আবর্তিত হয় ঠাঁইনাড়া মেয়ে ইন্দুকে কেন্দ্র করে। ইন্দুবালার (শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়) জন্ম খুলনার কলাপতায়, অধুনা বাংলাদেশ। কপোতাক্ষের টলটলে পানি ইন্দুর বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যায়। সে জেনে এসেছে, একমুঠো চাল গৃহস্থের বেশি নিতে হয় যাতে কেউ এলে খালি পেটে ফিরে না যায়। ভাইবোনে মিলে দিনরাত সেখানে খুনসুটি। ইন্দুর বড় হওয়ার সঙ্গেই তার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। দেশভাগের অনিবার্যতায় চারপাশের পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ইন্দুর ভ্রমরবেলার প্রেম মণিরুলকে ছেড়ে বৈবাহিক সূত্রে চলে আসে কলকাতার ছেনু মিত্তির লেনে। বিয়ের পর গাঢ় সবুজ রঙের ট্রেনে থেকে মহানগর কলকাতায় পা দেওয়া মাত্রই ইন্দুর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ধূসর হতে শুরু করে। মাস্টার রতনলাল মল্লিকের (প্রতীক দত্ত) সঙ্গে যন্ত্রণাময় জীবন ইন্দুকে শুধু দিতে পেরেছিল গ্লানি, অপমান, দুই সন্তান ও একটা বাড়ি। একদিন কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে চাওয়া ইন্দুবালাকে বাঁচিয়ে রাখল একফালি সাদা চাঁদ। স্মৃতির হাত ধরে কুয়োর জলে ভাসমান চাঁদ এক লহমায় ঠাকুমার হাতে বানানো সাদা চন্দ্রপুলির রূপ ধারণ করল। একদিন ইন্দুর অপটু হাতে বানানো যে চন্দ্রপুলি অকস্মাৎ মণিরুল মুখে পুরে ফেলে। ইন্দুর জীবনের প্রথম প্রেম, মণিরুল! ধানক্ষেতের বুকে পরিণতি না পাওয়া সেই প্রেম কখনও ফিরে আসে ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়’ সুরের মূর্ছনায়! আবার কখনও কাশের সমুদ্রে দুই কিশোর-কিশোরীর খুনসুটিতে।

আরও পড়ুন- পড়াশোনা ছেড়ে আন্দোলনে! ভারতীয় ছবির ‘রস’ প্রথম বুঝিয়েছিলেন দেবকী বসুই

ইন্দুবালার গল্প শুধুই তো রান্নার গল্প নয়; হোটেলের রন্ধনশালা থেকে ভেসে আসা গন্ধের স্রোতে সাঁতরে স্মৃতির উপাখ্যান খুঁজে চলা। স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের পুনঃপাঠ। কোনও জাতির স্মৃতিশক্তি যত গভীর ঠিক ততোধিক শক্তিশালী তার ইতিহাস চেতনা। এদেশে এসে ইন্দুবালাকে মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়ে হাজার অপমান। একদিন দুই সন্তানকে বুকে আগলে ইন্দুবালার পিঠ ঠেকে যায় কাবুলিওয়ালার অত্যাচারে। ঠিক সেই সময় ঈশ্বরের দূত হয়ে তাঁর জীবনে মছলিয়ালি লছমির (স্নেহা চট্টোপাধ্যায়) আবির্ভাব! সেদিন একবেলা খেয়ে সে ইন্দুর বাকি জীবনের বেঁচে থাকার পাথেয় ‘ভাতের হোটেলের’ সূচনা করে দিয়ে যায়। পাটকাঠি দিয়ে জ্বলে ওঠা ধিকধিকি উনোনের আঁচে তৈরি হতে থাকে স্মৃতির সুস্বাদু ইতিহাস। লছমি হয়ে ওঠে এই বাড়ির আপনজন; যেন তার মায়ের পেটেরই বোন। ইন্দুকে রাঁধতে দিয়ে যায় ঝোপ-জঙ্গল থেকে উপড়ে আনা মানকচু। পাষাণের শিলনোড়ায় বাঁটা হয় সর্ষে কাঁচালঙ্কা। ঝাঁঝে-স্বাদে জিভে জল আনা কচুবাটা লছমি পরম তৃপ্তিতে খায়। ইন্দুবালার মনে পড়ে কলাপোতায় ভাইয়ের সঙ্গে মিলে অঝোর বৃষ্টির দিনে কচু তোলার স্মৃতি। একদিন ঠিক যেমন করে বিভূতিবাবুর উপন্যাসে ভিজেছিল অপু-দুর্গা। দুর্গা বেঁচে থাকলে যেন ইন্দুবালাই হতো।

শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই ইন্দুকে শুনতে হয়েছিল, তার ভাষা বস্তিতে উঠে আসা রিফিউজিদের মতো। সময়ের সঙ্গে সে শিখে নিয়েছিল শান্তিপুরি বাংলা। কিন্তু মন থেকে ভুলতে পারেনি মাটিকে। সেই টুকরো টুকরো স্মৃতিকে অবলম্বন করেই যে বেঁচে থাকা! এদেশে এসে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থেকেও দিব্যি বেঁচে থেকেছে নিজের জন্মভুমির কথা মনে করে। ইন্দুবালার বাড়ি হয়ে ওঠে সহায় সম্বলহীন তথাকথিত সমাজের নিচুতলার মানুষের আশ্রয়। অনেক দৃশ্য হৃদয়কে মোচড় দেয়। বিশেষ করে ইন্দুবালা আর লছমির সম্পর্ক! দু'জন আসলে একজনই, অথবা একই দেহেই দুইজনের বাস।

একে একে বাংলার মা-ঠাকুমার রান্নার রেসিপি আচ্ছন্ন করে তার হোটেলে খেতে আসা মানুষজনকে। গন্ধের সঙ্গে স্মৃতির যোগ আছে। ঠিক যেমন আমরা প্রত্যেকেই মায়ের আঁচলের গন্ধ আলাদা করে চিনে নিই। আঁচলের গন্ধে ভেসে ঘুরে আসি শৈশবে। লেখক কল্লোল লাহিড়ীকে কুর্নিশ জানাতে হয় প্রায় ভুলতে বসা বাঙালির রান্নাকে কেন্দ্র করে এমন উপন্যাস উপহার দেওয়ার জন্য। এই প্রজন্ম যখন রকমারি বাইরের খাদ্যে আচ্ছন্ন হয়ে নিজদের হেঁসেলের দৈনন্দিন খাবার প্রায় ভুলতে বসেছে, সেখানে সুচিন্তিতভাবে বেছে বেছে কচুবাটা থেকে চিংড়ির হলুদগোলা ঝোলের তালিকা আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির প্রতিবাদ; শিকড়ের ঝুঁটি নেড়ে দেওয়া।

ইন্দুবালার স্মৃতি এক এক করে ইতিহাসের ফেলে আসা পাতায় চোখ বুলিয়ে যেতে থাকে। স্মৃতির পর্দায় দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে বাঙালির শেষবারের মতো বুক চিতিয়ে লড়াই নকশাল আন্দোলন  ছেপে উঠতে থাকে। কলাপোতার গ্রামে কাশের সমুদ্রে কিশোরী ইন্দু ও মণিরুলের প্রেম আশ্রয় খোঁজে জসিমুদ্দিনের কবিতায়। সমাজ তো আর হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেম মেনে নেওয়ার মতো আধুনিক নয়, তখনও না, এখনও না, তাই সেই প্রেম আজীবন ইন্দুবালার সুখস্মৃতি হয়ে থাকে। তাই আরেক নকশাল ছেলের মুখে ভাত তুলে দিয়ে সে খুঁজতে থাকে তার ফেলে আসা প্রেমকে। নকশাল আন্দোলন করা ছেলে অলোক যখন ইন্দুবালাকে বোঝায় মুক্তিযুদ্ধ ও নকশাল আন্দোলনের তফাৎ তখন ইন্দুবালা অনায়াসে বলে ওঠে, যুদ্ধ বলতে সে শুধু বোঝে স্মৃতির সঙ্গে মানুষের লড়াই!

আরও পড়ুন- দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, যাদের ছবি ধরা রইল না ক্যামেরার লেন্সে

সাধারণত এই ধরনের পিরিয়ড ছবিতে ক্যামেরা সুস্থির থাকে। পরিচালক সম্পূর্ণ ছবি জুড়ে হ্যান্ড-হেল্ড ক্যমেরা ব্যবহারের সাহস দিখিয়েছেন। আশ্চর্যভাবে সেই পরীক্ষা সফলও হয়েছে। সিরিজে তিনটি সময়কাল সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলে। এর আগেও দেবালয় ভট্টাচার্য তাঁর ‘ড্রাকুলা স্যার’ ছবিতে এভাবে গল্প বেশ দক্ষতার সঙ্গেই বলেছিলেন। অনেকদিন পর সত্যিই বাংলা ছবিতে গানের এমন যথাযথ প্রয়োগ দেখতে পাই। গানের অধিক ব্যবহার সিরিজের গতিরোধ তো করেই না, উপরন্তু গল্পের পালে হাওয়া দিয়ে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে যায়। অতুলপ্রসাদ, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গানের চমৎকার ব্যবহার। এই ছবির গান নিয়েই দীর্ঘ আরেকটি আলোচনা লেখা যায়; গানবিহীন এই সিরিজ কল্পনা করাই অসম্ভব। সঙ্গীত পরিচালক অমিত চট্টোপাধ্যায়ের সুর সিরিজকে উচ্চতর আসনে বসিয়েছে। এই ছবির আরেক সম্পদ হলো দেবালয় ভট্টাচার্য ও তৃষা নন্দীর যৌথভাবে লিখিত চিত্রনাট্য এবং সংলাপ।

কিশোরী ইন্দুর চরিত্রে পারিজাত চৌধুরী চমৎকার। চোখে-মুখে তাঁর গ্রামের বালিকার সারল্য। বাকি দু'টি বয়সের চরিত্রে শুভশ্রী দুর্দান্ত। বিশেষ করে কম বয়সের ইন্দুবালার চরিত্রে তিনি অসাধারণ। বৃদ্ধা বয়সের গলার স্বর ও মেকআপের সামান্য ত্রুটি বাদ দিলেও শুভশ্রী ভালোই। সিরিজের পর্ব যত এগিয়েছে, ইন্দুর বয়সের অভিনয় পরিণত হয়। ধনার চরিত্রে দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের নিপুণ অভিনয় মন কাড়ে। দেবদত্ত রাহার চোখ মুখের অভিব্যক্তি সাহিত্যের পাতা থেকে রক্তমাংসের মণিরুলকে নির্মাণ করে সিরিজে।

ইন্দুবালা বৃদ্ধা অব্দি নিজের স্মৃতিকে ছাড়তে পারেননি। দেশত্যাগ করে এদেশে এসেও তার দেশ কলাপোতাই থেকে গেছে। আসলে অতীতকে মনে রাখা হলো ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই। স্মৃতিই মানুষকে বিদ্রোহে এগিয়ে দেয়, অন্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন যুদ্ধে নামিয়ে দেয়। সিরিজের একদম শেষে ইন্দুবালার প্রতিবাদী কণ্ঠ বলে- "ওটা আমার দেশ। ওখানে টুরিস্ট হয়ে যাব না!" ইন্দুবালার নিজের দেশে টুরিস্টদের মতো ফিরতে না চাওয়া কি দেশভাগের কারিগরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ নয়? আমরাই ঠিক করব স্মৃতিকে নিজেদের অস্ত্র ভেবে শান দেব না ‘আচ্ছে দিন’- এর মিথ্যে বিজ্ঞাপনে মজে বিস্মৃতির পথে হব আত্মঘাতী।

সিরিজ - ইন্দুবালা ভাতের হোটেল

পরিচালক - দেবালয় ভট্টাচার্য

ওটিটি - হইচই

ক্যামেরা - রম্যদীপ সাহা

সুরকার - অমিত চট্টোপাধ্যায়

More Articles