এই মন্দিরের আদলেই নির্মিত দক্ষিণেশ্বর! হুগলি জেলার ইতিহাস বিস্মিত করে

কথিত আছে, একবার রানি রাসমণি বারাণসী থেকে ফেরার পথে এই সোমড়া বাজারে আসেন বিশ্রাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে। তখন তিনি আনন্দময়ী মায়ের মন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই আদলে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি করেন।

সুখারিয়া গ্রাম, হুগলি জেলার সোমড়া বাজার ও বলাগড়ের মাঝামাঝি অবস্থিত। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত মা আনন্দ-ভৈরবী মন্দির। পশ্চিমবঙ্গে টেরাকোটার কাজ করা পঞ্চবিংশতির অথবা ২৫ চূড়ার যে পাঁচটি মন্দির রয়েছে, তার মধ্যে এটি রয়েছে চতুর্থ স্থানে। ১৮১৪ সালে (মতান্তরে ১৮১৩) মন্দিরটি নির্মাণ করায় স্থানীয় জমিদার বীরেশ্বর মুস্তাফি। মন্দিরটি 'আনন্দ-ভৈরবী' এবং 'আনন্দময়ী' দু'টি নামেই পরিচিত।

কথিত আছে, একবার রানি রাসমণি বারাণসী থেকে ফেরার পথে এই সোমড়া বাজারে আসেন বিশ্রাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে। তখন তিনি আনন্দময়ী মায়ের মন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই আদলে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি করেন। সেই কারণেই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এবং আনন্দময়ী মায়ের মন্দির একইরকম দেখতে। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর লেখা 'হুগলী জেলার পুরাকীর্তি' গ্রন্থে মন্দিরটিকে 'আনন্দ-ভৈরবী' নামে উল্লেখ করেছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র এবং বিশ্বভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ) ডেভিড ম্যাকাচ্চন তাঁর লেখা 'লেট মিডিয়েভাল টেম্পল অফ বেঙ্গল' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেখানে তিনিও এটিকে 'আনন্দ-ভৈরবী' মন্দির নামে উল্লেখ করেছেন। স্থানীয় মানুষজনের কাছে অবশ্য এটি 'আনন্দময়ী' মন্দির নামে পরিচিত।

মুস্তাফি পরিবারের আসল পদবি ছিল 'মিত্র'। এঁদের পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই বংশের আদি বাস ছিল নদিয়া জেলার উলা গ্রামে, যা বর্তমানে বীরনগর বলে খ্যাত। এই বংশের আদি বংশধর কালিদাস মিত্র ছিলেন 'পঞ্চকায়স্থ'-দের একজন। তিনি পূর্বে কনৌজে থাকতেন সেখানে থেকে বাংলায় এসে আধিপত্য বিস্তার করেন। এই বংশের ১৯তম জমিদার রামেশ্বর মিত্রমুস্তাফি মুর্শিদকুলি খাঁ-র আমলে সুবে বাংলার রাজস্ব বিভাগের 'মৌস্তাফি' পদে আসীন হন। কারও কারও মতে, এই রামেশ্বর মিত্র ছিলেন আওরঙ্গজেবের হিসাবরক্ষক এবং তিনিই রামেশ্বর মিত্রকে 'মৌস্তাফি' উপাধি প্রদান করেন।

আরও পড়ুন: আজও বিস্ময়! ব্রিটিশদের থেকে আত্মগোপন ক‍রতে এই রাজবাড়িতে ছিলেন নজরুল

সেই আমলের নায়েব, কানুনগো বা মৌস্তাফি-রা বৃহৎ ক্ষমতাধর এবং সামাজিক প্রতিপত্তির ও প্রতিষ্ঠার অধিকারী ছিলেন। তাঁরা স্থানীয় জমিদারি ভোগ করতেন, যার ফলে সম্পদশালী হয়ে উঠতেন। রামেশ্বর মিত্রর প্রথম পুত্র রঘুনন্দন মিত্র আটিশেওড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন তিনি এই স্থানটির নামকরণ করেন শ্রীপুর। রামেশ্বর মিত্রর আর এক পুত্র অনন্তরাম মিত্র কাছাকাছি সুখারিয়াতে বসবাস শুরু করেন। ১৭৯৫ সালে রেগুলেশন ৩৪ ধারা অনুযায়ী বর্ধমান জেলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়,ফলে উত্তরদিকের অংশটি বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দক্ষিণ অংশটি হুগলি জেলা হিসেবে পরিচিত হয়। শ্রীপুর, সুখারিয়া ইত্যাদি অংশগুলি মিত্রমুস্তাফি-দের দখলে আসার আগে বর্ধমান রাজাদের অধিকারে ছিল। সুবীরকুমার মিত্রর লেখা 'হুগলী জেলার ইতিহাস' (২-য় খণ্ড) পড়লে জানা যায় নদিয়ার অধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রর সঙ্গে অনন্তরাম মিত্রমুস্তাফির কোনও কারণে মনোমালিন্য হয়। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজা ছিলেন তিলকচাঁদ মেহতাব। তিনি অনন্ত নামের বাসস্থান নির্মাণের জন্য সুখারিয়া, গোপিনগর, পুনুই প্রভৃতি স্থানগুলি তাঁর পুত্রের নামে কোবালা লিখে দেন ১৭৫৭ সালে। আনন্দ-ভৈরবী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বীরেশ্বর মিত্রমুস্তাফি। তিনি ছিলেন অনন্তরাম মিত্রমুস্তাফির পুত্র, শম্ভুরাম মিত্রমূস্তাফির সুযোগ্য সন্তান।

বর্তমানে এই মিত্রমুস্তাফি পরিবার বিশ শতকের শুরু থেকেই কলকাতার বাসিন্দা। তাঁরা এখন শুধুমাত্র মুস্তাফি পদবিটি ব্যবহার করেন। জমিদারি অভিজাত্যের চিহ্নস্বরূপ সুখারিয়া-র আনন্দময়ীর দিঘির উত্তর পাড়ে অবস্থিত বড় বড় থামওয়ালা ভগ্নপ্রায় মিত্রমুস্তাফিদের বসতভিটে 'রাধা কুঞ্জ'। এই রাধা কুঞ্জ তৈরি করেছিলেন শম্ভুরাম মিত্রমুস্তাফির প্রপৌত্র রামজীবন মিত্রমুস্তাফি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাসাদটি এখন জীর্ণ ভগ্নদশায় পরিণত হয়েছে। প্রাসাদটির ভেতরে আছে চকমিলানো দুর্গা দালান। দক্ষিণমুখী আনন্দ-ভৈরবী মন্দিরটির উচ্চতা ৭০ ফুট ৮ ইঞ্চি। উঁচু বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির প্রতিটি দিক ৩৬ ফুট অর্থাৎ বর্গাকার। জনশ্রুতি আছে, বীরেশ্বর মুস্তাফি তৎকালীন সময়ে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি ত্রিতল ২৫-চূড়া মন্দির। মন্দিরের গঠনশৈলী অসামান্য। (১২+৮+৪+১)- এই ধাঁচে মন্দিরের চূড়াটি তৈরি। প্রথম তলে প্রতিটি কোণে তিনটি করে মোট ১২টি, দ্বিতীয় তলে প্রতিটি কোণে দু'টি করে ৮টি, চতুর্থ তলে একটি করে মোট ৪টি এবং এবং সর্বোচ্চ একটি মূল চূড়া। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কালনার কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের মতো এর গঠন অর্থাৎ সবগুলো একই সমতলভূমির ওপর অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য পঁচিশ চূড়া মন্দিরগুলির বিগ্রহ বা শিলামূর্তি বৈষ্ণব মতে প্রতিষ্ঠিত। ব্যতিক্রম, আনন্দ-ভৈরবী মন্দির, এখানে পূজিতা হন প্রস্তরনির্মিত দেবী কালিকা। এই কালীমাতার মূর্তির বিশেষত্ব হলো, দেবী মা এখানে শিবের বুকের ওপর বসে আছেন।

এখানকার অনেক টেরাকোটার কাজ নষ্ট হতে বসেছে, নতুন করে রং করা এবং সংস্কার করতে গিয়ে কিছু কারুকাজ নষ্ট হয়ে গেছে। ১৮৯৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পে আনন্দময়ী মায়ের মন্দিরের চারটি চূড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। প্রবেশপথটি দক্ষিণ দিকের বারান্দার দিকে। তিন খিলানযুক্ত একটি অসাধারণ প্রবেশপথ, মাঝখানের দেওয়াল রাধাকৃষ্ণ, সিংহবাহিনী, গণেশ-জননী, রাম রাজা ইত্যাদি টেরাকোটার ফলক আছে। কিছু কিছু জায়গায় দেওয়ালে ফ্রেসকো-র কাজ ছিল, তা দেখলেই বোঝা যায়। পিলারের একেবারে নিচে প্যানেলের বেশিরভাগ টেরাকোটা নষ্ট হয়ে গেলেও এখনও কিছু টিকে আছে, যেমন বকাসুর বধ, পুতনা বধ, কংস বধ, কালীয়-দমন। এছাড়া তখনকার দিনের বাবুবিলাস, গড়গড়া-বিলাস, শিকারের দৃশ্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

পশ্চিমবাংলায় মোট পাঁচটি পঞ্চরত্ন বা পঁচিশ চূড়া মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনাতেই অবস্থান করছে তিনটি মন্দির। কালনার মন্দিরগুলি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণের অধীনে আছে, সেই কারণে যথাযথভাবে নিয়ম মেনে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু সুখারিয়া-র মন্দিরগুলি যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণের নিয়ম না মেনেই মন্দিরে প্লাস্টার এবং রং করা হয়েছে, বারংবার সংস্কারের ফলে বেশিরভাগ টেরাকোটার ফলক নষ্ট হয়ে গেছে। তবু সেই মন্দিরের চার দেওয়ালে টেরাকোটার কারুকার্যগুলি এখনও অপূর্ব। মন্দিরের দেওয়ালের টেরাকোটা গণেশের মূর্তির আধিক্য চোখে পড়ে‌। এছাড়া আছে কালী, দুর্গা, সিংহবাহিনী, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি। মন্দিরটির সামনে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দু'দিকের সারিতে একটি করে পঞ্চরত্ন এবং পাঁচটি করে আটচালা মন্দির আছে। পূর্বদিকের সারির মন্দিরগুলি কিছুটা হেলে গেছে প্রাকৃতিক কারণে। পশ্চিম দিকের প্রথম পঞ্চরত্ন মন্দিরের সামনের অংশে রয়েছে জগদ্ধাত্রী, মকর বাহিনী, বিদেশি সৈন্য, বংশীবাদক কৃষ্ণ ইত্যাদি। রামনিধি মিত্রমুস্তাফি নির্মাণ করান 'হরসুন্দরী মন্দির', যা এখনও ভগ্নদশা নিয়ে টিকে রয়েছে।

[তথ্য সূত্র: http://wbpwd.gov.in, সোমড়া বাজারের ইতিহাস ও নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর 'হুগলী জেলার ইতিহাস']

More Articles