'পুরস্কার দিয়ে কাজ বিচার বন্ধ করা উচিত', কথাবার্তায় বিজ্ঞানী দীপক ধর

পরিসংখ্যানগত পদার্থবিদ্যা চর্চার পরিসরে তিনি স্বনামধন্য। গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের জন্য প্রথম ভারতীয় হিসেবে দীপক ধর বোলৎজ়ম্যান পুরস্কার পেলেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এবার স্রেফ নোবেলের অপেক্ষা। আম-বাঙালি ভাবছে, নিশ্চয়ই উনি বাঙালি! এই সব সাতপাঁচের মধ্যেই নিরহং মানুষটি সময় দিলেন ইনস্ক্রিপ্টকে। ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার পরিবেশ থেকে শুরু করে তাঁর কাজের পরিসর--সব নিয়েই এই অকপট আড্ডা।

প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসেবে বোলৎজ়ম্যান পুরষ্কার পেয়েছেন। যারা বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথে যুক্ত তাঁদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, খুব সাধারণ মানুষ, যারা সে ভাবে বিজ্ঞানের শক্ত তত্ত্বের জগত থেকে আপাত ভাবে দূরে, সেই মানুষগুলোও আপনাকে নিয়ে গর্বিত। কেমন লাগছে আপনার?

আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না। পুরষ্কার পেয়ে আমার তো মনে হয় না কিছু বদলেছে আমার কাছে ….

 আপনি তো পদার্থবিদ্যার একাধিক বিষয়ে কাজের জন্যে এই পুরষ্কার পেয়েছেন ...

আমার গবেষণার বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হল স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজি়ক্স, সেল্ফ অর্গানাইজ় ক্রিটিক্যালিটি, স্পেক্ট্রাল ডায়মেনশন অফ ফ্র্যাক্টাল, এনিউমারেশন অফ ক্লাস্টার অন ল্যাটিসেস, রিল্যাক্সেশন উইথ ডিসঅডার্ড ফেরোম্যাগনেটিক ইম্পিউরিটিজ় ইত্যাদি।

একটু বিজ্ঞানের বাইরে বেরিয়ে একটা প্রশ্ন করি? বেশ কিছু বাংলা পত্র-পত্রিকা দেখছি আপনাকে বাঙালি বলছে।  যখন আপনার সঙ্গে কথা হল ই-মেইলে, আমি প্রথম জানতে পারলাম আপনি উত্তর প্রদেশের মানুষ। ধর পদবি বাঙালিদেরও হয়, জানতে ইচ্ছে করছে বাংলার সঙ্গে আপনার কোনো যোগ আছে কিনা।

(ঠাট্টার ছলে) হ্যাঁ, বর্তমান তত্ত্ব অনুযায়ী তো আফ্রিকা থেকে ভারতীয়দের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন, সেই দিক থেকে দেখলে তো নিশ্চয়ই বাঙালিদের সাথে নিশ্চয়ই আমার কোনো সম্পর্ক আছে, তবে সত্যি বলতে  বাংলার সঙ্গে কোনো সরাসরি যোগাযোগ নেই। আমরা আসলে উত্তরপ্রদেশীয়।

এই প্রসঙ্গে যখন কথা উঠল, তোমাকে একটা মজার কথা বলি (হেসে ফেলে)। ১৯৯১ সালে আমি ভাটনগর পুরষ্কার পাই, এবং মোট পাঁচটি বিষয়ে  আমাকে মিলিয়ে দশ জন পুরষ্কার পান। বাংলার বেশ কিছু খবরের কাগজে এই খবর বেরোয়। তখন কোনো সংবাদ পত্রিকাকেই দেখিনি বাকিদের নাম প্রকাশ করতে, শুধু আমার নাম উল্লেখ করে বলা হয় একজন বাঙালি পদার্থবিদ্যায় ভাটনগর পুরষ্কার করেছেন। আমাকে তো ১৯৯১ সাল থেকেই বাঙালি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে!

বিজ্ঞান গবেষকরা বলাবলি করছেন বোলৎজ়ম্যান পুরস্কার পাওয়া মানে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার থেকে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা। অনেকেই বোলৎজ়ম্যান পুরষ্কার পাওয়ার পর নোবেল পেয়েছেন। আমরা ভারতীয়রা কি তাহলে পদার্থবিদ্যায় নোবেল আশা করতে পারি

আমার তো মনে হয় না আমি আদৌ এমন কিছু কাজ করেছি, যার জন্যে নোবেল পুরষ্কার পাব। অনেকেই আমার থেকে ভালো কাজ করছেন বিজ্ঞান নিয়ে। আমার আগেও অনেকে অনেক ভালো কাজ করে গেছেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজি়ক্সে!

তবে কী বলো তো, আমার মনে হয় না নোবেল পুরষ্কারের মোহে গবেষণা করা কিন্তু সব সময় বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যে খুব ভালো। অনেকেই ভালো কাজ করছেন, কিন্তু তারপরেও তাঁরা নোবেল পাবেন না, তার মানে তো এই নয় তাঁদের কাজটা কোনো অংশে কম ভালো! আমি পুরষ্কার পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞান-সাধনা করি না। হ্যাঁ, যদি নোবেল পাই সে তো ভালোই লাগবে।

বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করার অনুপ্রেরণা কে দিল আপনাকে? বিজ্ঞানের প্রতি এই ভালোবাসা জন্মেছে কি শৈশব থেকেই?

হ্যাঁ, শৈশব থেকেই বলা ভালো। আমার বাবার হাত ধরেই বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে আমার। বাবাকে দেখতাম ছোটোবেলায় আমার জন্যে অনেক পপুলার সায়েন্সের বই কিনে আনতেন, সেখান থেকে সূত্রপাত বলতে পারো। তারপর ধীরে ধীরে যখন স্কুলে বিজ্ঞান পড়া শুরু করলাম, দেখলাম যে বিষয়টাকে বেশ লাগছে, বুঝতেও পারছি। তারপর ভাবলাম এই বিষয় নিয়েই পড়াশুনো করলে কেমন হয়!

বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু কবে থেকে?

ছোটোবেলায় পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে তখনও বলা হত ডাক্তার হও, ইঞ্জিনিয়ার হও, নিদেন পক্ষে আইএএস হও। আমি ভেবে দেখলাম আইএএস হওয়ার থেকে বরং আমি বিজ্ঞানীই হবো। এটুকুই! এর থেকে বেশি কিছু ভাবিনি আমি।

পদার্থবিদ্যায় তো আবার অনেক দিক রয়েছে, আপনি যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে আজ এত বড় পুরষ্কার পেলেন, সেই বিষয় নিয়ে কাজ করার পেছনে অণুপ্রেরণা কী ছিলো?

যখন এমএসসি করছি, আমি দেখলাম অ্যাস্ট্রোফিজি়ক্স, পার্টিকল ফিজি়ক্সের মত বিষয় শুনতে বেশ গ্ল্যামারাস। তাই তরুণ ছাত্ররা আকৃষ্ট হতো বিষয়গুলোর প্রতি। প্রত্যেকেই হকিং-এর মতো হতে চাইতো (মুচকি হেসে)। কিন্তু আমি দেখলাম আমি আবার এই বিষয়গুলো খুব ভালো বুঝি না, পার্টিকল ফিজি়ক্স তো একেবারেই না। আমি তো ইলেক্ট্রনের নাম শুনেছি, বাকিদের মতো। তখনও জানি না পায়োন কী বস্তু, কী ভাবে তারা একে-অপরের সাথে আদানপ্রদান করে। আমি ভাবলাম  এই পার্টিকল বা কণাগুলোকে  আমি চোখে দেখতেও পাবো না, তাদের কাজকর্ম বুঝতেও পারব না। তাই এই বিষয় নিয়ে আমি পড়ব না। আমি এমন কিছু নিয়ে পড়তে চাইছিলাম যা অন্তত খানিকটা হলেও নিজে বাস্তবে উপলব্ধি করতে পারব। তাই স্ট্যাটিস্টিক্যাল ফিজি়ক্সকে বেছে নেওয়া।

    

এসব শুনে তো আপনার ছাত্রজীবনের গল্প আরও শুনতে ইচ্ছে করছে। ছাত্রাবস্থায় আপনার মেন্টর কারা ছিলেন?

এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে যখন বিএসসি করছি, তখন এমন শিক্ষকরা আমায় আকৃষ্ট করতেন, যারা একটু সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে কথা বলতেন। বালকৃষ্ণ অগরওয়াল ছিলেন এমন একজন মানুষ। এছাড়াও আমি পেয়েছি এইচ.পি. দীক্ষিতের মতো প্রফেসরকে। ওঁদের অবদান মনে রাখার মত। 

তারপর যখন আইআইটি-কানপুরে গেলাম, তখন এইচ.এস. মানি, ডি.সি. খানের মত মানুষের হাত ধরে আমার পদার্থবিদ্যার প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়তে থাকে।

ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে যখন পিএইচডি করতে গেলেন তখন কারা আপনার মেন্টর ছিলেন?

প্রথম বছরে তো আমি রিচার্ড ফাইনম্যানকে পেয়েছিলাম প্রফেসর হিসেবে, দ্বিতীয় বছরে আমি ওনার টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টও ছিলাম। আমি ওনার থেকে শিখেছিলাম কী ভাবে ভাবতে হয়, কী ভাবে বিজ্ঞান-বিষয়ক সমস্যার সমাধান করতে হয়।

পরবর্তী কালে আমার পিএইচডির গাইড ছিলেন জন ম্যাথিউস। খুব ভালো মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক এবং ছাত্রদের স্বাধীনভাবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করার রাস্তাটা উনি খোলা রাখতেন।

এর ফলে আমিও অবাধে নানান বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করতাম ল্যাবে, অবাধ জ্ঞানচর্চার পরিবেশ ছিল। এমন পরিবেশে, যেখানে চিন্তাভাবনাকে বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয় না, সেখানে কাজ করলে কেবল যে  চিন্তাশক্তি বাড়ে এমনই নয়, জ্ঞান অর্জনের পথেও কোনো বাধা থাকে না।

পিএইচডির পরে দেশে কত সালে ফিরলেন আপনি?

আমি ফিরলাম ১৯৭৮-এ।

১৯৭৮! মানে তো ভারতবর্ষে তখন  জরুরি অবস্থা পরবর্তী সময়!  ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির মত জায়গা থেকে পিএইচডি করে, রিচার্ড ফাইনম্যান এবং জন ম্যাথিউসের মতো মানুষদের সাথে কাজ করে হঠাৎ দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন?  এদিকে দেশেও সঙ্কটময় অবস্থা তখন। গবেষণার অনেক বেশি সুযোগ তো বিদেশেই পেতে পারতেন ..

আমি পিএইচডি করার পরেই TIFR-এ (টাটা ইন্সস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ) পোস্ট ডক্টরেট করার সুযোগ পাই। তখন যা সুযোগ পেয়েছিলাম নিয়ে নিয়েছি, এত বেশি ভাবিনি দেশে ফেরার সময়ে। আর পোস্ট ডক্টরেট পদে আবেদন করার সময়ে খুব বেশি প্রতিযোগীও ছিল না, ফলে TIFR-এ সুযোগ পেতে সমস্যা হয়নি খুব বেশি।

পদার্থবিদ্যা তো এখন একটা আন্তঃবিভাগীয় অভিমুখ নিয়েছে - এখন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, চিকিসাবিদ্যা, অঙ্ক, কম্পিউটার সায়েন্স সব কিছুর একটা সুন্দর মেলবন্ধন গড়ে তুলে গবেষণা হচ্ছে। আপনার কি মনে হয় ভারতবর্ষের আন্তঃবিভাগীয় বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে, বিদেশের উন্নত দেশগুলির আন্তঃবিভাগীয় বিজ্ঞানচর্চার তুলনা করা যায় এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে?

হ্যাঁ, তুলনা করা যায়। আন্তঃবিভাগীয় বিজ্ঞানচর্চার দিক থেকে ভারতবর্ষও অন্যান্য দেশগুলির সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছে। কিন্তু আমি বলব, ভারতবর্ষে সেই গবেষণার প্রয়োগ ভারতে অনেক কম অন্যান্য দেশের তুলনায়; প্রয়োগের সুযোগও সীমিত এ দেশে।

যেহেতু ভারতে বর্তমান বিজ্ঞানচর্চার পরিস্থিতি নিয়ে অলোচনা হল, সেই প্রসঙ্গেই জানতে চাইছি ... দেশে আমরা হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছি কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতি, মেরুকরণের মত বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। আমি রাজনীতির প্রসঙ্গ আনতে না চাইলেও, এই বিষয়গুলি অন্তত বর্তমান সময়ের সঙ্গেই সম্পৃক্তআপনার কি মনে হয় আমরা কোনো কারণে বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

আমার তো মনে হয় তিরিশ বছর আগে যতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয়রা ছিল, এখনও অল্পবিস্তর সেরকমই রয়েছে। তবু বলব, তিরিশ বছর আগে, জহরলাল নেহরুর সময়েও দেশে বিজ্ঞানচর্চা বা বিজ্ঞানমনষ্কতার আবহাওয়া ছিল। দেশের নেতা-মন্ত্রীরা তখন সেই আবহাওয়া তৈরি করার দিকে নজরও দিতেন। ওদের বিজ্ঞানের প্রতি সম্মানও অনেক বেশি ছিল। আমার মনে হয় না, সেই উদ্দ্যেশ্য বা প্রচেষ্টা  এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আর আছে।

আমার এক বন্ধু একবার অনেক বছর আগে আমায় বলেছিল, তোমার পদার্থবিদ্যার চর্চার কোনো মূল্য নেই। বরং জ্যোতিষচর্চা করলে লাভ বেশি, কারণ মানুষ ওই বিষয় নিয়েই বেশি উৎসাহী, ব্যবসায়িক লাভও বেশি। আমার তো মনে হয়, ঠিক সেরকমই যে দিকে জোর দিলে সরকারের লাভ বেশি সেদিকেই এখন জোর দেওয়া হয়। 

তাহলে কি আমরা বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

একেবারেই না! এই তো যারা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভাবতেও অনিচ্ছুক বা বিজ্ঞানকে অবহেলা করে, তাদের হাত থেকে সেলফোনটা কেড়ে নাও, ঘরের এসিটা বন্ধ করে দাও, দেখবে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাচ্ছে। তারা তো সেই ঘুরেফিরে বিজ্ঞানের সাহায্যই নিচ্ছেন - আর প্রযুক্তি তো বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে হয় না। আমি বলব আমরা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি থেকে দূরে সরছি না, বিজ্ঞানমনষ্কতা থেকে দূরে সরছি।

আচ্ছা, বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ তো খুব প্রশস্ত নয়, তার থেকেও বড় কথা এই ক্ষেত্রে সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার মুখোমুখি বেশি হতে হয়। অনেক গবেষক আছেন, যারা গবেষণা ছেড়ে দেন হতাশ হয়ে। তাদের অণুপ্রেরণার অভাব হয় বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হতে। তাদের গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার অণুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যে আপনি কী বলবেন?

আমার মনে হয় আমাদের পুরস্কার পাওয়ার প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক একটা কারণ। দেখো, ভালো কাজ যদি সবাই করেও, প্রথম স্থানাধিকারী হবে একজনই। তার মানে তো এই নয় বাদবাকি যারা এত পরিশ্রম করেছে তাদের কাজ মূল্যহীন হয়ে গেল, কেবল সে পুরষ্কার পেল না বলে। আমাদের কিন্তু এই পুরষ্কারের প্রতি ছোটা বা পুরস্কারের নিরিখে কাজ বিচারের প্রবণতা বন্ধ করার সময়ে এসেছে। বরং ভালো কাজ করার দিকে মন দেওয়া যাক না!                                                                                                        

More Articles