নাৎসিদের হাত থেকে ২৫০০ শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন, জেদের অন্য নাম ইরিনা...

সময়টা ভয়ঙ্কর। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। যুদ্ধের সাজোয়া গাড়ি দাপাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। আর নাৎসি জার্মানি শুরু করেছিল এই পৈশাচিক হত্যালীলা। কিন্তু পৃথিবীর সেইসব অন্ধকার দিনগুলিতেও কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা নিজেদের প্রাণের পরোয়া না করেই বিশ্ববাসীকে আলো দেখিয়েছিলেন। তাঁদের অনেককেই মনে রাখিনি আমরা।

ইতিহাস আমাদের খুব ভাল অথবা খুব খারাপের গল্প বলে। কিন্তু এই ভালো-খারাপের মাঝে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাদের গল্পগুলি না বলাই থেকে যায়, অথবা অল্পশ্রুত অবস্থাতেই বাতাসে মিলিয়ে যায়।। ইরিনা সেন্ডলার সেরকমই একজন মানুষ, অন্তর্মুখ এক মহিয়সী যিনি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নাৎসিদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন আড়াই হাজার ইহুদি শিশুকে। 

পোল‍্যান্ড অধিবাসী ইরিনা জন্ম ১৯১০ সালে। ইরিনার হয়ে ওঠা অনেকটাই তাঁর বাবার হাত ধরে। ১৯১৭ সালে টাইফাস নামক এক ছোঁয়াচে এবং প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পতে থাকে পোল‍্যান্ডবাসীর মধ‍্যে। ক্রমেই তা পরিণত হয় এক ভয়ঙ্কর দেখা মহামারীতে। সেইসময় পোল্যান্ডের সমস্ত চিকিৎসক এই রোগের চিকিৎসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও ইরিনার বাবা একনিষ্ঠভাবে  ইহুদিদের  চিকিৎসা চালিয়ে যান। মহামারী শেষে প্রাণ কেড়েছিল তাঁর‌ও। মৃত‍্যু অবধারিত জেনেও তিনি সেদিন অসহায় মানুষের প্রতি বিমুখ থাকেননি। বছর সাতেকের ছোট্ট ইরিনার মনে এই ঘটনার যে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তা বোধহয় আর বলার অবকাশ রাখে না। এরপর ইরিনা মায়ের সঙ্গে চলে আসে ওয়ারশে। ওয়ারশ-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি দেখলেন সেখানে ইহুদি এবং অ-ইহুদিদের মধ‍্যে এক বিস্তর বিভেদ। ইহুদি পড়ুয়াদের সঙ্গে ক্লাসে কথা বলা কিংবা তাদের সঙ্গে বাইরে ঘোরা সেখানে নিষিদ্ধ। তিনি এই বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং যথারীতি চিরাচরিত নিয়ম ভাঙার অপরাধে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয় ।

পড়া শেষেই তিনি যুক্ত হন সমাজসেবার কাজে।  ইতিমধ‍্যেই পৃথিবীর বুকে ঘনিয়ে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাত্সিরা সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে পোল‍্যান্ড দখল করল আর শুরু হল ইহুদিদের এক নরক জীবন। ইরিনা তখন ওয়ারশ’তে ‘পোলিশ সোশ‍্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট’- এ কর্মরত। এরপর এক বছর যেতে না যেতেই প্রায় পাঁচ লক্ষ ইহুদিকে আটক করা হল ঘেটো-তে। অনাহার এবং ঘেঁটোর মধ্যেকার অস্বাস্থ্য পরিবেশে, নানান ব‍্যাধির কারণে অসংখ‍্য ইহুদি এইসময় থেকে মারা যান। ইরিনা এই গোটা বিষয়টি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেন। তিনি বলেছেন,

“When Germans invaded Warsaw in 1939, I had a wide circle of Jewish friends and acquaintance who suddenly found themselves in a dramatic situation, unable to provide for their basic needs.”

 সমাজসেবী হ‌ওয়ার সুবাদে তাঁর কাছে একটি স‍্যানিটারি পাস ছিল, এই ছাড়পত্রের সুবাদেই তিনি ঘেঁটোতে পা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঘেঁটোর মধ্যে ইরিনা ঝাঁপিয়ে পরেন নিজে্র ইহুদি বন্ধুদের প্রাণরক্ষার কাজে। তিনি বন্ধুদের খাবার এবং ওষুধ সরবরাহ করতে থাকেন।  

এইসময় থেকে ইরিনার জোরকদমে ইহুদিদের প্রাণরক্ষার কাজ শুরু করেন । ১৯৩৯-১৯৪২ সালের মধ‍্যে ইরিনা এবং তাঁর বন্ধুরা প্রায় তিন হাজার জাল নথিপত্র বানিয়ে ফেলেছিল, যার সাহায‍্যে ইহুদিরা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে সক্ষম‌ও হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বন্দি ইহুদিদের মধ‍্যে তিন হাজার সংখ‍্যাটা নিতান্তই নগণ‍্য। তাই এতে মন ভরে না ইরিনার। ইহুদিদের সার্বিকভাবে সাহায‍্য করার সুযোগটা এল ১৯৪২ সাল নাগাদ। নাত্সিদের চোখে ধুলো দিয়ে ইহুদিদের সাহায‍্য করার জন‍্য তৈরি হল এক গোপন সংস্থা। নাম ‘জেগোটা’। ইতিমধ‍্যেই প্রায় তিনলক্ষ ইহুদিদের পাঠানো হয়েছে ট্রেব্লিংকার কনসেনট্রেশন ক‍্যাম্পে। ইরিনাকে অনুরোধ করা হল সংস্থার শিশু উদ্ধারের কাজটি গ্ৰহণ করতে। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান ইরিনা এবং শুরু হয় তাঁর নতুন এক জীবন সংগ্ৰাম।

আরও পড়ুন-চোখ ধাঁধানো সাজ, একটি টিকিটের দাম ৩৮ লাখ টাকা, ভারতের রাজকীয় ট্রেনের অন্দরে চলুন

প্রথম দিকে ঘেটোর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অনাথ শিশুদের উদ্ধারের কাজ শুরু করা হয়। তারপর পাসের মাধ‍্যমে ঘেটোর বদ্ধ কোয়ার্টার থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুদের। এইসময় তিনি জোলান্টা ছদ্মনাম নিয়ে কাজ চালাতেন। জার্মানরা মনে করতেন তিনি হয়তো এসেছেন অসুস্থ ইহুদিদের দেখাশুনার কাজে। এই উদ্ধার কাজে তাঁর সঙ্গী ছিল জনাদশেক মানুষ। ঘেটোর অপর প্রান্তে অবস্থিত পুরানো কোর্টহাউস এবং ক্যাথলিক চার্চের মধ‍্যে দিয়ে উদ্ধার করা শিশুদের পাচার করার কাজ চলাতো তাঁদের এই দল। যারা বয়সে একটু বড়ো সেইসব শিশুদের শিখিয়ে দেওয়া হত ক‍্যাথলিক প্রার্থনামন্ত্র আর গা থেকে খুলে নেওয়া হত হলুদ তারা। কোনও মতেই যেন নাৎসিদের সামনে তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ না পায়, তারই আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হত। যারা একেবারে ছোট, মুখে বুলি ফোটেনি তখনও, তাদের পিঠের ব‍্যাগে কিংবা আলুর বস্তায় এমনকি কফিনে করে অবধি পাচার করা হত। এইভাবে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি শিশুকে উদ্ধার করেছিলেন ইরিনা এবং তাঁর দল। যুদ্ধ শেষে একদিন সেইসব শিশুদের তাদের মা-বাবার কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার আশায়, তিনি বন্ধুর আপেল গাছের তলায় প্রতিটি শিশুর পরিচয় লিখে, সেগুলকে কাঁচের বয়ামে ভরে পুঁতে রেখেছিলেন। কিন্তু ভাগ‍্য নিষ্ঠুর। যুদ্ধ শেষে দেখা গেছিল আড়াই হাজার শিশুর প্রত‍্যেকের মা-বাবার প্রাণ‌ই যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে। তারা প্রত‍্যেকেই তখন অনাথ।

 এরপর ১৯৪৩ নাগাদ ধরা পড়েন ইরিনা। প্রচণ্ড অত‍্যাচারে শরীরের হাড় ভেঙে গেলেও তিনি রা’ কাড়েননি। বিচারে আদেশ দেওয়া হয় মৃত‍্যুদণ্ডের। কিন্তু ইরিনার বন্ধুরা অতি গোপনে তাঁকে জেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তাঁর কৃতিত্বের কথা জেনেছিল বিশ্ববাসী। ইরিনা স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘মা-বাবা শিখিয়েছিলেন, কোন মানুষ যখন ডুবতে বসে, তখন তাকে সাহায‍্য করতেই হবে, সে তার ধর্ম, রাষ্ট্র যা-ই হোক না কেন।’

আজ এত বছর পরেও ইরিনার কথা হয়তো খুব কম মানুষ‌ই জানেন। আসলে মান্য ইতিহাস অনেক সময়েই  আমাদের গোলা বারুদের কথা বলে, বলে না সেইসব ঘটনার কথা, যেখানে ধ্বংসলীলার ছাইয়ের পুরু আস্তরণের উপরে কিছু সুন্দর ফুল ফুটেছিল।

 

তথ্যসূত্র-

১ আড়াই হাজারের মা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ নভেম্বর ২০১৯

২ ইরিনা স্লেন্ডার.ওআরজি

More Articles