দূরত্ব রাখছেন মমতাও? মুকুলের মতো বিস্মৃত হয়ে যাবেন পার্থ?

পার্থকে নিয়ে আইনি টানাপড়েনের মধ্যে, আকারে-ইঙ্গিতে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল (TMC) নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)।

চিটফান্ড কেলেঙ্কারিই হোক, কোনও নেতার বেফাঁস মন্তব্য হোক বা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, এত দিন তৃণমূলের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ ছিলেন তিনি। দলের অন্দরে সমাদরও পেয়ে এসেছেন বরাবর। কিন্তু স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ দুর্নীতি (SSC Recruitment Scam) মামলায় কার্যতই নিঃসঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। কলকাতা হাই কোর্ট তাঁর মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছে ইতিমধ্যেই। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও সম্ভাবনার কথা জানা না গেলেও, পার্থকে নিয়ে আইনি টানাপড়েনের মধ্যে, আকারে-ইঙ্গিতে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল (TMC) নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। সাফ জানিয়েছেন, 'কুকর্ম’ যাঁরা করেন, তাঁদের ভালবাসেন না তিনি। সরাসরি নাম না করলেও, মমতার এই মন্তব্য তৃণমূলে এবং রাজ্য রাজনীতিতে পার্থর ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

 

এর আগে, আইকোর মামলাতেও পার্থকে ডেকে পাঠায় সিবিআই। ওই ভুয়ো লগ্নিকারী সংস্থা থেকে তিনি সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকী, নাকতলায় যে পুজো কমিটির সদস্য পার্থ, সেখানেও আইকোর থেকে টাকা গিয়েছে বলে দাবি করা হয়। এখনও সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি, তার মধ্যেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছেন পার্থ। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি চাকরির নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ। তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেই সময় বেআইনিভাবে ৩৮১ জনকে চাকরির সুপারিশপত্র দেওয়া হয় এসএসসি-র উপদেষ্টা কমিটির তরফে, যাঁদের মধ্যে ২২২ জন লিখিত পরীক্ষায় পাশই করতে পারেননি। নাম ছিল না ওয়েটিং লিস্টেও।

 

তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থর অনুমোদনে গঠিত এসএসসি-র উপদেষ্টা কমিটিকেও বেআইনি বলে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারীরা। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে চাকরি দেওয়ার পিছনে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। পার্থকেও বলতে শোনা গিয়েছে, দুর্নীতির প্রশ্নে জড়িয়ে থাকে অর্থও। তিনি কোনওরকম লেনদেনে যুক্ত ছিলেন না। তাই দুর্নীতির অভিযোগই খাটে না তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, পার্থ নিজে টাকা না নিলেও, তালিকায় নাম না থাকা সত্ত্বেও তাঁর অনুমোদিত কমিটি যখন নাম সুপারিশ করেছে, তলে তলে কি আর্থিক লেনদেন হয়নি? এত ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্টের দায় কি এড়াতে পারেন পার্থ?

 

আরও পড়ুন: সবুজ শিশির গেরুয়া হবেন রাজ্যসভায় গিয়ে?

 

এই প্রশ্নের সারবত্তা কিন্তু যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছেন মমতা। তার জন্যই গত ৬ মে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা করে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ে তাঁর সরকার। এমনকী, গত কয়েক দিনে দলের কর্মিসভার মঞ্চ থেকে প্রকাশ্যে ‘ভুলচুক’ মাফ করে দেওয়ার আর্জি জানাতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। খোদ সরকারের মন্ত্রীর নাম যখন উঠে আসছে দুর্নীতিতে, সচেতনভাবেই পার্থর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছেন তৃণমূলের সকলে। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ শুরু থেকেই তাই পার্থর কোর্টে বল ঠেলে এসেছেন। সাফ জানিযেছেন, দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠছে, তার প্রায় সবই পার্থ শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন হয়েছে। তাই এই নিয়ে জবাবদিহি করার দায়ও পার্থরই। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর এর সঙ্গে কোনও যোগ নেই বলে ব্রাত্যকে ক্লিনচিট দিয়ে, পার্থকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন কুণাল।

 

শুধু কি তাই! কোনও রাখঢাকে না গিয়েই কুণাল সাফ জানিয়েছেন, মমতার নেতৃত্বে রাজ্য সরকার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জনমুখী প্রকল্প রূপায়ণ করছে। ৯৯% ক্ষেত্রে ভাল কাজ হচ্ছে। কোথাও কোনও ভুল হলে, চাকরি-প্রার্থীরা বঞ্চিত হলে, যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সরকার বা দল কোনওভাবেই এর দায় নেবে না। মুখপাত্র হিসেবে দলের বার্তা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়াই কাজ কুণালের। অর্থাৎ দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে পার্থকে নিয়ে দলের অবস্থানই যে তিনি তুলে ধরেছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

পার্থকে নিয়ে টানাপড়েন চলাকালীন, গত কয়েক দিনে একবারের জন্যও তাঁর নাম উচ্চারণ করেননি মমতা। বগটুই কাণ্ডের আগে বীরভূমের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে যখনই ডেকেছেন গোয়েন্দারা, যখনই তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা হয়েছে, ততবারই ‘কেষ্ট’কে ফাঁসানো হচ্ছে, এমন বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। বরং গত কয়েক দিনে লাগাতার দলকে এসবের বাইরে রাখার চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। তাই বলতে শোনা যায়, “মনে রাখবেন, কিছু লোক আছে, সবাই নয়, এটা ০.১ শতাংশও হবে না। এটা সব জায়গাতেই আছে। হরিণ যেমন মুখটা লুকিয়ে রেখে ভাবে আমার পিছনটা আর কেউ দেখতে পারছে না, আমার শরীরটা কেউ দেখতে পারছে না, কিন্তু শরীরটা তো সবটাই বাইরে আছে, মুখটা তো শুধু ঢাকা আছে।’’

 

কলেজজীবনে ছাত্র পরিষদ করা পার্থর সঙ্গে মমতার বোঝাপড়া আজকের নয়। একটা সময় সংসার, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও, কংগ্রেস-পরিত্যাগী মমতা তৃণমূলের সূচনা করলে, মোটা মাইনের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াতে দু’বার ভাবেননি পার্থ। মমতাও পার্থকে বরাবর তার মর্যাদা দিযে এসেছেন। পার্থর জন্যই তৃণমূলে ‘মহাসচিব’ পদটির আমদানি করেন তিনি। দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির মাথায় বসান। প্রার্থীতালিকা তৈরি থেকে খুঁটিনাটি সব বিষয়ে পার্থ কার্যত দলের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু কোথাও না কোথাও পুরভোটের আগে থেকে এই বোঝাপড়ার তাল কাটতে শুরু করে বলে মত রাজ্য রাজনৈতিক মহলের।

 

পুরভোটের প্রার্থীতালিকা নিয়ে জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ দেখা দিলে, পার্থর বিরুদ্ধেই সরাসরি আঙুল তোলেন দলের বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। ‘‘পার্থ চট্টোপাধ্যায় দলের ছেলেদের চেনেন বলে মনে হয় না,’’ এমন মন্তব্য করেন মদন। অভিযোগ, অনুযোগ, যা আছে, প্রকাশ্যে ঢাক না পিটিয়ে, বিক্ষুব্ধদের দলের অন্দরে কথা বলতে বলেন পার্থ। তার পাল্টা মদন বলেন, “শুনছিলাম, যার যা বিক্ষোভ তা দলের মধ্যে বলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, দলের মধ্যে কোথায়, কাকে বলতে হবে। তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে। কারণ কর্মীরা বলছেন, তৃণমূল ভবনে একমাত্র সুব্রত বক্সি ছাড়া কাউকে পাওয়া যায় না।”

 

এরপর পুরভোট মামলা নিয়ে শাসক-বিরোধী তরজা আদালতে গেলে করোনা পরিস্থিতিতে ভোট স্থগিত রাখার পক্ষে নিজের ‘ব্যক্তিগত’ মতামত জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে অভিষেকের ওপর চটেন তৃণমূলের প্রবীণ শিবির। অভিষেকের মন্তব্য দলের পরিপন্থী, অভিষেক নন, একমাত্র মমতাকেই নেতা মানেন বলে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তা নিয়ে আবার তাঁকে ছেঁকে ধরেন অভিষেক-অনুগামী বলে পরিচিত কুণাল, অপরূপা পোদ্দাররা। সেই পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা কমিটির তদানীন্তন চেয়ারম্যান হিসেবে দলের এই বিভাজন প্রকাশ্যে আসা রুখতে পার্থ যথেষ্ট সক্রিয়তা দেখাননি বলেও অভিযোগ ওঠে। এমনকী, প্রবীণ বনাম নবীন যুদ্ধে প্রবীণ শিবিরের প্রতি তিনি নরম বলেও শোনা যায়।

 

এসএসসি বিতর্কের মধ্যেই তার আঁচ মেলে খানিকটা। মমতার উত্তরসূরি নিয়ে প্রশ্ন করলে পার্থ সাফ জানান, অভিষেক অবশ্যই তরুণ প্রজন্মের অন্যতম মুখ। কিন্তু মমতার পথ অনুসরণ করলেও, সকলের পক্ষে মমতা হওয়া সম্ভব নয়। তবে পার্থ বরাবরের মতো মমতাকে এগিয়ে রাখলেও, এই মুহূর্তে পার্থর থেকে দলের দূরত্ব তৈরি করাতেই জোর দিচ্ছেন মমতা। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সম্প্রতি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান পদ থেকেও পার্থকে ছেঁটে ফেলেন মমতা। তাঁর জায়গায় বসানো হয় সুব্রত বক্সিকে। তাঁকে না জানিয়ে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির বৈঠক হয়ে যাচ্ছে, তিনি কাগজ পড়ে জানতে পারছেন বলে তার আগে অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন মমতা।

 

এর আগে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে কাটমানি অভিযোগ সামাল দিতে বেগ পেতে হয়েছিল তৃণমূলকে। নিজে পথে নামলেও সারদা, নারদ কাণ্ডেও দলের গায়ে আঁচ লাগার টের পেয়েছিলেন মমতা। তাই মদন মিত্র জেল থেকে ফেরার পর তাঁকেও আর মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দেননি। এসএসসি কাণ্ডে পার্থর ক্ষেত্রেও তিনি একই নীতি নিয়ে চলছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ সিবিআই দপ্তরে হাজিরা দিতে গেলেও, সেখানে তৃণমূলের কোনও নেতা-মন্ত্রীকে পার্থর সঙ্গে দেখা যায়নি। পার্থ খুব বেশি সংবাদমাধ্যমের সামনে আসুন, তাঁকে নিয়ে নেতা-মন্ত্রীরা ফলাও করে বিবৃতি দিন, মমতার তাতে সায় নেই বলেও জানা গিয়েছে। সেই কারণেই সিবিআই-এর সামনে হাজিরা দিয়ে বেরনোর পর পার্থ সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলার গরজ দেখাননি বলে মনে করা হচ্ছে।

 

এর পিছনে অভিষেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নও জড়িয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। গুরুতর মামলায় নাম জড়ানো নেতাদের সঙ্গে বরাবরই দূরত্ব বজায় রাখেন মমতা। কিন্তু এক্ষেত্রে অভিষেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েও মমতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাই পার্থর সামনে কঠিন পরীক্ষা বলে মনে করছেন তাঁরা। পার্থ যদিও অত দূর ভাবছেন না বলেই মত বঙ্গ-রাজনীতির অনেকেরই। কারণ সম্প্রতি নিজে মুখেই পার্থ জানান, মমতা যতদিন আছেন, তিনিও ততদিনই আছেন। তবে অভিষেক জমানায় থাকুন বা না-ই থাকুন, মমতার সামনে পার্থর নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ যে রয়েছে, সেই যুক্তি খণ্ডন করতে পারছেন না কেউই। আবার মুকুল রায়ের মতো সব রাস্তা বন্ধ না হয়ে যায়, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ।

More Articles