দূরত্ব বাড়াচ্ছে দল, পিছু ছাড়ছে না সিবিআই || কী হতে চলেছে অনুব্রতর ভবিষ্যৎ?
এবার অনুব্রত ?
সিবিআইয়ের নিশানায় থাকা বা হেফাজতে যাওয়া- একাধিক নেতার সঙ্গেই অতীতে দূরত্ব বাড়িয়েছিল তৃণমূল৷ এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে একাধিক৷ অনেকের ক্ষেত্রে সেই দূরত্ব এতটাই বেড়েছে যে, তাদের আর দেখাই যায়নি ঘাসফুল শিবিরের কাছাকাছি৷ তাঁদের ক্ষেত্রে, সাময়িকভাবে হলেও, হয়তো দলের মনে হয়েছে অভিযোগের যৌক্তিকতা রয়েছে৷ এঁদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালেও অন্য কয়েকজনকে নরমে-গরমে রেখেছে তৃণমূল৷ অনেকটা 'ছেড়ে রেখে ধরে রাখা' ফরমুলা৷
দলের নজরে এবার বীরভূম তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল৷ গত কয়েক মাস ধরেই সিবিআইয়ের সঙ্গে স্নায়ুর লড়াই চলছে বীরভূমের এই দাপুটে তৃণমূল নেতার। গরু পাচার, কয়লা পাচার, ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস, বগটুই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বারবার তাঁকে তলব করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু অনুব্রত একবারও ওমুখো হননি। অনুব্রত ওরফে কেষ্টর এই আচরণে দল হয়তো যথেষ্টই অস্বস্তিতে৷ কারণ, এর ফলে বিরোধীদের নিশানায় গোটা দল৷ সব মিলিয়ে আপাতত যা দৃশ্যমান, তা হলো, অনুব্রত ওরফে কেষ্টর পাশ থেকে খুবই ধীর পায়ে সরে যাচ্ছেন দলীয় সতীর্থরা৷ অন্তত প্রকাশ্যে তো তেমনই মনে হচ্ছে৷ যেদিন থেকে আস্তিন গুটিয়ে আসরে নেমেছে সিবিআই, সেদিন থেকেই দল আর অনুব্রতর মধ্যে থাকা ফাঁকা জমির আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তবে এখনই পুরোপুরি ব্রাত্য হয়তো করা হয়নি৷ দলের কেউ সম্ভবত দায়িত্ব আছেন ফোনে কেষ্টর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার৷ তবে এটা স্পষ্ট, সর্বশেষ সিবিআই তলব ও এসএসকেএমে ভর্তি হওয়ার আগের অনুব্রত আর এখনকার অনুব্রত দলের নজরে ভিন্ন মানুষ৷ ৬-৭ বার যেভাবে সিবিআইয়ের ডাক এড়িয়েছেন কেষ্ট, তা হয়তো ভালোভাবে নেয়নি তৃণমূল৷
আরও পড়ুন: মমতা কি দলেই কোণঠাসা? অভিষেক নিয়ে কুণালের বার্তায় কোন ইঙ্গিত?
শুধু দলের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিচার করলে বলা হতে পারে এটা স্রেফ অনুমান৷ সেক্ষেত্রে সামনে আনতে হয় তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতার মন্তব্য৷ যেমন, কিছুদিন আগে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অনুব্রত-ইস্যুতে বেশ ইঙ্গিতবাহী এবং কৌশলী মন্তব্য করেন৷ সেদিন তিনি বলেছিলেন, "ওঁর (অনুব্রত'র) শরীর অসুস্থ হলে চিকিৎসকরা বুঝবেন৷ তবে আমায় সিবিআই, ইডি ডাকলেই গিয়েছি।" সিবিআইয়ের ডাক এড়ানো প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "অনুব্রতকে ওঁর আইনজীবীরা কী পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না।” এছাড়াও এপ্রিলের মাঝামাঝি, এমপি-এমএলএদের বিশেষ আদালতে হাজিরা দিয়ে কুণাল বিচারকের সামনে অনুব্রতের নাম উল্লেখ না করে বলেছিলেন, "আমার দাঁতের চিকিৎসা করা হয়নি, অথচ প্রভাবশালীদের উডবার্নে চিকিৎসা হয়। উডবার্ন কি হাসপাতাল, না কয়েদিদের আশ্রয়খানা?" প্রসঙ্গত, ওই সময়ই এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন অনুব্রত ৷ দলীয় মুখপাত্রের এই মন্তব্যেই ধরা যায়, অনুব্রত'র এই তলব এড়ানো বিষয়টি পছন্দ করছে না দল৷
বীরভূমের 'বেতাজ-বাদশা' কেষ্ট মণ্ডলকে এড়িয়ে থাকার যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এই মুহূর্তে তৃণমূল দিচ্ছে, তা অনুমান করেই এবার আসরে নেমেছেন বিধায়ক মদন মিত্র৷ মদন মিত্রকে এর আগে অর্থলগ্নি সংস্থার মামলায় হেফাজতে নিয়েছিল সিবিআই৷ তার পর থেকে দীর্ঘদিন দলের মূল স্রোতে তাঁকে সামিল হতে দেওয়া হয়নি৷ প্রসঙ্গত,কুণাল ঘোষও একই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন৷ কেষ্টকে খোঁটা দিতে এবার এগিয়ে এসেছেন তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রও৷ যে দাবি এতদিন বিরোধীরা করছেন, সেটাই যেন কিছুটা শোনা গিয়েছে মদনের গলায়। অনুব্রত এবং সিবিআই প্রসঙ্গে বিতর্ক উসকে মদন মিত্রের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, "সিবিআই যখন আসে, তখনই অনুব্রত মন্ডল অসুস্থ হয়ে যায়। আবার অনুব্রত মন্ডল অসুস্থ হলেই সিবিআই আসে। কখন অনুব্রত-র পা ফুলছে, সেই খোঁজও রাখে সিবিআই।” মদন মিত্র নিজে সারদা-কাণ্ডে জেলবন্দি থাকাকালীনও যে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন, সেকথাও উল্লেখ করে বলেন, তাঁর শরীরে '১৩ রকমের রোগ'-এর সন্ধান পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। এরপর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ টেনে মদন বলেন, "অভিষেকও সিবিআইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অনুব্রতর উচিত সিবিআইকে ফেস করা। অভিষেক যদি মাথা উঁচু করে সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে পারেন, তাহলে অনুব্রত কেন পারবেন না?" পরে অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে ফের তৃণমূলের এই বিধায়ক বলেন, "অনুব্রত আমার ছোট ভাই। সুস্থ হলে ও অবশ্যই সিবিআই দফতরে যাবে।" প্রকাশ্যে মদন মিত্রর এইসব মন্তব্য নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে হয়তো অস্বস্তি কিছুটা বেড়েছে।
রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এটা স্পষ্ট হয়েছে, দল আজ সেইভাবে অনুব্রতর পাশে নেই৷ এর পর আগামী যে কোনও দিন সিবিআই গোয়েন্দারা যদি অনুব্রতকে জেরার মুখে বসাতে পারেন, তাহলে তো দল আরও পাশে থাকবে না৷ সে কারণে এখন থেকেই দূরত্ব বাড়াচ্ছে তৃণমূল৷
ওদিকে সিবিআই তলব নিয়ে দল যে সেভাবে তাঁর পাশে নেই, তা বেশ টের পাচ্ছেন অনুব্রত মণ্ডল৷ দলীয় সতীর্থদের তির্যক মন্তব্য কানে যাচ্ছে তাঁর৷ কিন্তু চমকপ্রদ কথা বলার 'মাস্টার' কেষ্ট এই স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখই খুলছেন না৷
বৃহস্পতিবার তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংগঠনিক বৈঠকে বসছেন দলের নেতাদের সঙ্গে৷ তিনি যেহেতু বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি, তাই অনুব্রতর এই বৈঠকে থাকার কথা৷ দলের অন্দরের জল্পনা, বৈঠকে দলের সর্বভারতীয় কর্মসমিতির সদস্য কেষ্ট মণ্ডলকে অফিসিয়ালি ডাকা হলেও, তিনি আসবেন না৷ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সিবিআইয়ের কাছ থেকে ৪ সপ্তাহ সময় নিয়েছেন কেষ্ট৷ কলকাতার চিনার পার্ক এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে এই মুহূর্তে অনুব্রত চিকিৎসকদের নজরবন্দি৷ শরীর ঠিক না থাকায় সিবিআই দফতরে যিনি যেতে পারছেন না, তিনি দলের বৈঠকে হাজির থাকলে এমন বার্তা যাবে, যা কেষ্টর পক্ষে সুখকর নাও হতে পারে৷ অন্দরের জল্পনা, দল সেভাবে চাইছেও না কেষ্ট যোগ দিন এই বৈঠকে৷
ফলে, ধরেই নেওয়া যায় ফের কবে বাংলার মানুষ সেই দাপুটে অনুব্রত মণ্ডলকে ফের দেখতে পাবে, তা সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছে সিবিআইয়ের ওপর৷ ততদিন পর্যন্ত তাঁকে ঘিরে নানা জল্পনা নিশ্চিতভাবেই পল্লবিত হতেই থাকবে৷