ইউক্রেন কি এবার আত্মসমর্পণ করবে রাশিয়ার কাছে?

ইস্তানবুলে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মুখোমুখি বৈঠককে যুদ্ধ-শেষের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখেছিলেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। কিন্তু যত দিন গেছে, পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হয়েছে। ২১ এপ্রিল ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেছেন, মারিয়ুপোলের দখল নিয়েছে রুশ সৈন্যরা। পুতিন তাঁর সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন মারিয়ুপোলকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে, যাতে ইউক্রেনের সেনাদের কাছে বাইরে থেকে কোনওরকম সাহায্য পৌঁছতে না পারে। এছাড়াও তিনি ইউক্রেনের সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করার সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার চোখরাঙানি ইউক্রেনকে সম্পূর্ণভাবে দমিয়ে দিতে পারেনি। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রুশ হানাদার বাহিনীর চোখে চোখ রেখে লড়ছে ইউক্রেনের সৈন্যরা। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভালদিমির জেলেন্সকি যেন পরোক্ষভাবে ঘোষণা করছেন যে তিনি ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ নীতিতেই চলার পক্ষপাতী। কিন্তু ইউক্রেনের প্রবল সাহসিকতা সত্ত্বেও বাস্তব পরিস্থিতি অন্যরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংকটের মুখোমুখি পড়ছে জেলেন্সকির দেশ। রুশ সৈন্যদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে তাদের রসদ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, এছাড়াও দেখা দিয়েছে অস্ত্রের অভাব। এমতাবস্থায় জেলেন্সকির সৈন্যরা কি রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে?

যুদ্ধের শুরু থেকেই হাইপারসনিক অস্ত্রের সাহায্যে ইউক্রেনে বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি ঘটিয়েছিল রাশিয়া। প্রতিবেশী দেশের বেশ কিছু অংশে নিয়মিত মিসাইল আক্রমণও চালায় পুতিনের সেনাবাহিনী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ফলে ইউক্রেনের সৈন্যদের হাতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে অস্ত্র এসে পৌঁছয়। বাইডেন সরকারের কাছ থেকে তারা পায় ৫০০০ এফজিএম-১৪৮ জ্যাভলিন এবং ১৪০০ স্ট্রিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র। এর ফলে পুতিনের সৈন্যদের জোর টক্কর দিতে শুরু করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। ইতিপূর্বে ইউক্রেনের শহরাঞ্চলকে টি-৯০ এবং টি-৭২ ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল রুশ সৈন্যরা। এবার বাইডেন সরকারের দেওয়া এটিজিএম জ্যাভলিনের দৌলতে সেই ট্যাঙ্কগুলোই গুঁড়িয়ে দিল জেলেন্সকির সেনাদল।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেনের সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন বহু মানুষ। তবে এবার যেন সেই সাহসিকতাতেই খানিক ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ২১ এপ্রিল মেজর সারহি ভলিনা নামে এক সেনা কর্তা মারিয়ুপোল থেকে ‘শেষবারের’ মতো বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আর্তি জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন রুশ সৈন্যরা চতুর্দিক দিয়ে মারিয়ুপোলকে ঘিরে ফেলার ফলে রসদের ঘোরতর সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের। তাঁর সাহায্য প্রার্থনার ভিডিও গত কয়েকদিনে ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আরও পড়ুন: ভয়াবহ মারণাস্ত্র রাশিয়ার হাতে, ফিরে আসছে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি?

ইতিপূর্বে ন্যাটোর অন্তর্গত অধিকাংশ দেশ নৈতিকভাবে সমর্থন জানিয়েছে ইউক্রেনকে। গত ১০ এপ্রিল ইউনাইটেড কিংডমের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আচমকাই সাক্ষাৎ করেন ভালদিমির জেলেন্সকির সঙ্গে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকের পর তিনি জানান, জেলেন্সকির দেশকে সমস্তরকমভাবে সাহায্য করবে ইউকে। যদিও তাদের তরফ থেকে কোনওরকম সাহায্য ইতিমধ্যে এসে পৌঁছয়নি। ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করলেও তার পাশে দাঁড়িয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নামেনি জো বাইডেনের দেশ। রাশিয়াকে কূটনৈতিক চালে একঘরে করার নীতিই তারা আপাতত অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ, পুতিনের দেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেন কার্যত একা। এমতাঅবস্থায় ইউক্রেনের সৈন্যরা কি তাহলে বুঝতে পারছে, রাশিয়ার মতো একটা শক্তিশালী দেশের সঙ্গে অনন্তকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন? সেই জন্যই কি সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের দুরবস্থার কথা জানাতে ভিডিও করছেন তাঁরা? প্রশ্ন থেকেই যায়। তার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা সম্ভবনার প্রসঙ্গও এসে পড়ে। রাশিয়া কি শুধুমাত্র ইউক্রেন দখল করে থামবে, না কি এস্তোনিয়া, লাতভিয়া এবং লিথিউনিয়ার মতো বলটিক দেশগুলোর দিকেও হাত বাড়াবে? 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে উঠেছিল লাতভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিথিউনিয়ার মতো দেশগুলো। তারপর ’৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর তারা স্বাধীনতা লাভ করে এবং ঠিক তার এক দশক বাদে ২০০৪ সালে ন্যাটোর সদস্য হয়। স্বাভাবিকভাবেই তারপর থেকে ন্যাটোর মিত্র দেশগুলোর ছত্রছায়াতে তাদের শাসনব্যবস্থা চলেছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সিঁদুরে মেঘ দেখছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের গোড়ার দিকে সারা দেশে এমার্জেন্সির ঘোষণা করেছিলেন লিথিউনিয়ার রাষ্ট্রপতি। এছাড়াও লাতভিয়ার সরকার নিজেদের দেশের বেশ কিছু রুশ টিভি স্টেশনের ওপর ভুয়া খবর ছড়ানোর অভিযোগে দ্রুত নিষেধাজ্ঞা নামিয়ে এনেছিল।

বলটিক দেশগুলোর সরকারের তরফে একটাই আশঙ্কা রয়েছে, এখনই যদি পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো পুতিনকে উচিত শিক্ষা না দেয়, তাহলে রাশিয়া ফের তাদের আক্রমণ করে পুরনো সোভিয়েত গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। ইতিপূর্বে ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লাতভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিউথেনিয়ার মতো দেশগুলোর আলাদা হয়ে যাওয়াকে রাশিয়ানদের ট্র্যাজেডি হিসেবেই দেখেছিলেন। যদিও তাদের পুনর্দখল প্রসঙ্গে কিছুই বলেননি তিনি, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেওয়া যায় না।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের অন্যতম কারণ ছিল ন্যাটো। ইউক্রেন এখনও পর্যন্ত ন্যাটোর অংশ নয় ঠিকই, কিন্তু ইতিপূর্বে তারা ন্যাটোর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছে। পুতিন মনে করেছিলেন, ইউক্রেনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের মধ্য দিয়ে ন্যাটো আসলে রুশবিরোধী এক আঁতাত গড়ে তুলতে চাইছে। এবার দেখে নেওয়া যাক এর শুরুটা কোথায়।

সোভিয়েত পতনের পর থেকেই ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশকে গ্রাস করতে আরম্ভ করে। তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও আনা হয়েছিল যে, পূর্ব ইউরোপের বন্ধু দেশগুলোকে আসলে তারা উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপে সস্তার শ্রমিক সরবরাহের কাজে ব্যবহার করছে। মাথায় রাখতে হবে, ন্যাটোয় প্রায় তিরিশটার কাছাকাছি দেশ অংশগ্রহণ করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই তাদের মূল হর্তাকর্তা। নয়ের দশক থেকে শক থেরাপির মধ্য দিয়ে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আনার চেষ্টা করছিল। এর ফলে সদ্য খণ্ডিত হওয়া রাশিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়ল। ২০০৮ সালে জার্মানি আর ফ্রান্সের আপত্তি সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্জিয়াকে ন্যাটোর অংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ঠিক পরেই জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার কোন্দল শুরু হয়, ফলত, তার ন্যাটোর মিত্রশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভবনায় ইতি পড়ে।

পূর্ব ইউরোপের ‘ওয়েস্টার্নাইজেশন’-এর আগাগোড়া বিরোধিতা করে এসেছে রাশিয়া। পুতিনের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলেই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি দিন দিন অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে। এমতাবস্থায় যে সকল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ন্যাটোর মিত্রস্থানীয়, তাদের শুদ্ধিকরণ করার কথা মনে হতেই পারে রাশিয়ার। সেক্ষেত্রে লাতভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিথিউনিয়ার মতো দেশগুলোও তার আক্রমণের প্রকোপ থেকে বাদ পড়বে না। এছাড়াও পুতিন যদি চান প্রাচীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু কিছু অংশ পুনর্দখল করতে, তাহলেও তা বলটিক দেশগুলোর জন্য ঘোর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, সেই সম্পর্কে কোনওরকম নিদান এখন থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। দিনে দিনে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। এমতাবস্থায় দুই দেশের রাষ্ট্রনেতারা পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধানসূত্র বের না করলে সাধারণ মানুষকে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

 

 

More Articles